সলিমুল্লাহ খান যখন 'সাম্প্রদায়িকতা' নিয়ে প্রবন্ধ লিখে বললেন রবীন্দ্রনাথও মুক্ত ছিলেন না সাম্প্রদায়িকতা থেকে।(১) তখন অনেকেই সেটা হজম করতে পারেন নাই। কেমনে কি, রবীন্দ্রনাথ কিভাবে সাম্প্রদায়িক হয়? রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা থেকেই আমরা তার সাম্প্রদায়িক মনের পরিচয় পাই। তবে সেটা বঙ্কিমের মত শক্ত (hard) হয়ত নয়, সেটা ছিল নরম (soft) সাম্প্রদায়িকতা। শুরুতে দেখে নেয়া যাক, সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা কি। মূলধারা বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা বলতে বুঝায়;
''যে গোষ্ঠী চেতনা বৃহৎ সমাজকে পাশ কাটিয়ে, ক্ষুদ্র গোষ্টিগত স্বার্থে অন্য ধর্ম, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কেবল বিরোধিতাই নয় বরং অন্যের অধিকার দিতে অস্বীকার করে এবং ক্ষতি করতে করতে নিযুক্ত থাকে। পাশাপাশি যে চেতনা বা বিশ্বাস অন্য সম্প্রদায় বা ধর্ম বিশেষের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা কিংবা অন্য জাতির ঐতিহাসিক ও সম্মানিত চরিত্রকে হীন বা বিকৃত রূপে উপস্থাপন করতে নানাবিধ প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে তাকেই সাম্প্রদায়িকতা বলে।অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানোও সাম্প্রদায়িকতার অন্তর্ভুক্ত। যে বা যারা এই চেতনার লালন, পালন, বাস্তবায়ন ও প্রচার চালায় তারাই সাম্প্রদায়িক।'' (২)
এবার এই সংজ্ঞার সাথে রবী ঠাকুরের নিজের লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও নাটক থেকে উদৃতিগুলো দেখে নেয়া যাক।
প্রবন্ধ
''কিছুদিন হইল একদল ইতরশ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখণ্ডহস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপদ্রবের লক্ষটা বিশেষরূপে ইংরাজেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে, ইঁটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়; কিন্তু মূঢ়গণ ইঁটটি মারিয়া। পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল। অপরাধ করিল, দণ্ড পাইল; কিন্তু ব্যাপারটা কী আজ পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝা গেল না। এই নিম্নশ্রেণীর মুসলমানগণ সংবাদপত্র পড়েও না, সংবাদপত্রে লেখেও না। একটা ছোটোবড়ো কাণ্ড হইয়া গেল, অথচ এই মূক নির্বাক্ প্রজাসম্প্রদায়ের মনের কথা কিছুই বোঝা গেল না।''(৩)
গল্প
'' ‘আল্লা হো আকবর’ শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিনলক্ষ যবনসেনা, অন্যদিকে তিনসহস্র আর্যসৈন্য। বন্যার মধ্যে একাকী অশ্বত্থবৃক্ষের মতো হিন্দুবীরগণ সমস্ত রাত্রি এবং সমস্ত দিন যুদ্ধ করিয়া অটল দাঁড়াইয়া ছিল কিন্তু এইবার ভাঙিয়া পড়িবে, তাহার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। এবং সেইসঙ্গে ভারতের জয়ধ্বজা ভূমিসাৎ হইবে এবং আজিকার ঐ অস্তাচলবর্তী সহস্ররশ্মির সহিত হিন্দুস্থানের গৌরবসূর্য চিরদিনের মতো অস্তমিত হইবে।
হর হর বোম্ বোম্! পাঠক বলিতে পার, কে ঐ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশজন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত অসি হস্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বজ্রের ন্যায় শত্রুসৈন্যের উপরে আসিয়া পতিত হইল? বলিতে পার, কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবনসৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল?— কাহার বজ্রমন্দ্রিত ‘হর হর বোম্ বোম্’ শব্দে তিনলক্ষ ম্লেচ্ছকণ্ঠের ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল? কাহার উদ্যত অসির সম্মুখে ব্যাঘ্র-আক্রান্ত মেষযূথের ন্যায় শত্রুসৈন্য মুহূর্তের মধ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়নপর হইল? বলিতে পার, সেদিনকার আর্যস্থানের সূর্যদেব সহস্ররক্তকরস্পর্শে কাহার রক্তাক্ত তরবারিকে আশীর্বাদ করিয়া অস্তাচলে বিশ্রাম করিতে গেলেন? বলিতে পার কি পাঠক। ইনিই সেই ললিতসিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুবনক্ষত্র।'' (৪)
নাটক
প্রতাপাদিত্যঃ কাল কী আদেশ করেছিলুম ?
মন্ত্রীঃ মহারাজ আদেশ করেছিলেন , যখন রাজা বসন্ত রায় যশোরে আসবার পথে শিমুলতলির চটিতে আশ্রয় নেবেন , তখন-
প্রতাপাদিত্যঃ তখন কী ? কথাটা শেষ করেই ফেলো।
মন্ত্রীঃ তখন দুজন পাঠান গিয়ে-
প্রতাপাদিত্যঃ হাঁ-
মন্ত্রীঃ তাঁকে নিহত করবে ।
প্রতাপাদিত্যঃ নিহত করবে! অমরকোষ খুঁজে বুঝি আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না ? নিহত করবে! মেরে ফেলবে কথাটা মুখে আনতে বুঝি বাধছে ?
মন্ত্রীঃ আজ্ঞে মহারাজ আমি-
প্রতাপাদিত্যঃ তুমি শিশু! খুন করাকে তুমি জুজু বলে জান! তোমার বুড়ি দিদিমার কাছে শিখেছ খুন করাটা পাপ। খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ, এটা এখনো তোমার শিখতে বাকি আছে। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে,তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম। পিতৃব্য বসন্ত রায় নিজেকে ম্লেচ্ছের দাস বলে স্বীকার করেছেন। ক্ষত হলে নিজের বাহুকে কেটে ফেলা যায় ,সে-কথা মনে রেখো মন্ত্রী।''(৫)
রেফারেন্সঃ
(১) দেখুন, রবীন্দ্রনাথের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সলিমুল্লাহ খান; সাম্প্রদায়িকতা, সলিমুল্লাহ খান; দৈনিক বনিক বার্তা, শনিবার, অক্টোবর ২০, ২০১২, Click This Link
(২) মূলধারা বাংলাদেশ, সাম্প্রদায়িকতাঃ প্রচলিত বয়ান ও বাস্তবতা, ১১ নভেম্বর ২০১৬
http://www.muldharabd.com/?p=1904
(৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণ্ঠরোধ, বাংলা ১৩০৫ (ইংরেজি ১৮৯৮), Click This Link
(৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রীতিমত নভেল, (তারিখ অজানা), Click This Link
(৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রায়শ্চিত্ত, বাংলা ১৩২৬ Click This Link
কর্টেসি: মূলধারা বাংলাদেশ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:০৬