somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম: কান্না যেমন করে রক্তের রূপ পরিগ্রহ করে

১০ ই এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৩:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১.
পাহাড়ি আদিবাসীদের কান্নায় যে উপত্যকা একদিন হ্রদে পরিণত হয়েছিলো তা ক্রমশ পাহাড়িদের রক্তেই পাল্টে নিচ্ছে দেহের রঙ।
আমার অনেক পাহাড়ি বন্ধুদের কাছে শুনেছি তাদের কথা; শুনেছি বাঙালি সেটেলার আর সেনাবাহিনি মিলে কেমন করে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। শুনেছি কীভাবে রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি মেয়েদের সেনাবাহিনি অথবা সেটেলাররা ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে ছেড়ে দেয় কিংবা খুন করে লাশ গুম করে সেই কথা।
সশরীরে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন এলাকায় গিয়েছি তাদের সাথে কথা বলেছি। পড়ে যতোটা না জেনেছি তাদের সাথে কথা বলে উপলব্ধি করেছি ঢের বেশি।
এইখানে বাঙালি সেটেলাররা চিরদিন ব্যবহৃত হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘৃণ্য স্বার্থে।

০২.
১৯৯৯ সনের ৪ এপ্রিল বাঙালি সেটেলারদের হামলায় ৫১ জন পাহাড়ি আহত ও একজন পাহাড়ি নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন।
২০০৬ সালে গঙ্গারামমুখ এলাকায় ৩২টি বাঙালি সেটেলার পরিবারকে বসতি স্থাপনের জন্য পাঠানো হয়। তখন থেকে ওই অঞ্চলে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে বিরোধের সূচনা।
২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল অজ্ঞাত পরিচয়ের সন্ত্রাসীরা সাজেক ইউনিয়নের গঙ্গারামমুখের বাঘাইহাট নার্সারি এলাকায় সাতটি গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই সময় বিরোধ নিষ্পত্তি করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া দূরে থাক, দিনে দিনে বাঘাইহাটে বাঙালি পরিবার ক্রমশ বাড়তে থাকে।
সাজেক ইউনিয়নের গঙ্গারাম-বাইবাছড়া ও বাঘাইহাট এলাকায় আদিবাসী পাহাড়িরা বসবাস করে আসছে বহুকাল ধরে। জরুরি অবস্থার মধ্যে এ এলাকাগুলোতে পাহাড়িদের জায়গায় ২০০৭ সনে অভিবাসী বাঙালিরা ছোট ছোট চার বেড়ার এবং পলিথিন দিয়ে বানানো ছাদযুক্ত বাড়ি নির্মাণ করে। সেনাবাহিনি এতে সরাসরি নিরাপত্তা ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। আর পাহাড়িদের ঘরগুলো তুলনামূলক মজবুত ও স্থায়ী। ফলত এ এলাকা থেকে পাহাড়িদের তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। ২০ এপ্রিল ২০০৭ রাত সাড়ে ৯টার দিকে কতিপয় বাঙালি তাদের নিজেদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সাথে সাথে পাহাড়িদের গ্রামে আগুন লাগানোর জন্য ১০/১২ জনের সংঘবদ্ধ চক্রকে পথে নামিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে গ্রাম জুড়ে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি চলে ব্যাপক লুটপাট, ধর্ষণ এবং হত্যা। আগুনে পাহাড়িদের গ্রামে পুড়ে যায় ৭৩টি ঘর, আর পাহাড়িদের জায়গায় গড়ে তোলা বাঙালি বসতিতে পুড়ে যায় চার বেড়া ও পলিথিনের ছাদবিশিষ্ট ৪৩টি ঘর।

০৩.
৫ জানুয়ারি ২০১০ সাজেক নারী সমাজের পক্ষ থেকে পাহাড়িদের বিভিন্ন দাবিতে ইউএনও’র কাছে স্মারকলিপি পেশের পর সেনাবাহিনির তৎপরতা বেড়ে যায়। তাদের দাবির মধ্যে বাঙালি ব্যবসায়ী এবং সেনাবাহিনির অত্যাচার-শোষণ বন্ধের দাবিও ছিলো। একপর্যায়ে পাহাড়িরা বাঘাইহাট বাজারে আসা বন্ধ করে দেয়। এতে বাজারের বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যায় এবং বাঙালি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণেও বাঙালিরা পাহাড়িদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ২ মাস বাজার বয়কটের ঘটনা চললেও স্থানীয় প্রশাসন এটা নিরসনের কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। বরং সিভিল প্রশাসন ও সেনাবাহিনি পাহাড়িদের ওপর নির্যাতন ও হামলায় প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।
২৫ জানুয়ারি,২০১০ বাঘাইছড়িতে সেটেলার বাঙালিরা সাতজন পাহাড়িকে মারধর করে, কয়েকজন পাহাড়ি স্কুলছাত্র কিশোর-কিশোরীকে জিম্মি করে পুরো এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। পরদিন বাঙালিরা কয়েকটি পাহাড়ি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সহিংসতার জের ধরে পাহাড়িরা বাঙালিদের সাতটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ওই সময় সন্তু লারমা ও রাজা দেবাশীষ রায়ের গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনাও ঘটে।
আর ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০ শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয় আরেক রক্তক্ষয়। ২০০৭ সালের শেষ দিকে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের গঙ্গারামমুখ এলাকায় বাঙালি সেটেলার বসতি স্থাপনকে কেন্দ্র করেই ঘটনার সূত্রপাত। এখানে সেনাবাহিনি প্রথমে ৮টি পরিবারকে বসতি করার জন্যে নিয়ে যায় এবং পরে আরো ১৭/১৮টি পরিবার বসিয়ে দেয়। যেখানে বাঙালি সেটেলারদের বসতি স্থাপন করা হয় ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড়িরা বসবাস করতো এবং জুম চাষসহ অন্যান্য চাষাবাদ করে আসছিলো। বাঙালি বসতি হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের ঘটনা ঘটে চলছিলো। এ সংঘর্ষ প্রকট রূপ নেয় এক বাঙালি পরিবার কর্তৃক গঙ্গারামপুরে একটি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের উদ্যোগ নিলে। এতে একটি চাকমা পরিবারের জুম চাষের জমি পানিতে ডুবে যায়। পাহাড়িরা এ বাঁধ তৈরিতে আপত্তি করে ও বাধা দেয়। এভাবেই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সংঘর্ষ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ৪ শতাধিক বাড়িঘর ভস্মিভূত হয় ওই সংঘাতে কমপক্ষে ৭/ ৮ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন নারী।
ওই ঘটনার জের ধরে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট প্রথমে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ রাঙামাটি ও পরে তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধ ঘোষণা করে। খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়িদের মিছিল বের হলে একদল বাঙালি তাদের ধাওয়া করে। এভাবেই উত্তেজনা পুরো শহর এবং আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কমপক্ষে ৫টি পাহাড়ি পাড়া এবং একটি বাঙালি পাড়ায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সে সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও বরাবরের মতো নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

০৪.
বাঙালিরা সেটেলাররা পাহাড়িদের ভূমি অবৈধভাবে দখল করে নিচ্ছে সরকারি প্রশাসন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনির সহায়তায়। আর সরকার ভূমি সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় ধারাবাহিক সহিংসতা ঘটে চলছে।

পাবর্ত্য এলাকার সংকট নিরসনে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু গত ১২ বছর ভূমি কমিশনকে সচল হতে দেখা যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে বেআইনি ভূমির ইজারা ও বন্দোবস্ত দেয়ার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে চলছে। ২০০৯ আগস্টে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাহাড়ে প্রায় ১২ হাজার একর জমি বেআইনিভাবে ইজারা ও বন্দোবস্ত দেয়ার ঘটনা সনাক্ত করে। গত সেপ্টেম্বরে বান্দরবানে প্রায় সাড়ে আট হাজার একর এ ধরনের জমির ইজারা ও বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়।
ভূমি সমস্যা নিরসন করতে পার্বত্য চুক্তির ৫ নম্বর শর্তানুযায়ী পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান হবেন একজন
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। কমিটির অন্য যারা সদস্য হিসেবে থাকবেন তারা হলেন, চাকমা-বোমাং-মং সার্কেল চিফ (রাজা), পার্বত্য আঞ্চলিক
পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা তার একজন প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অথবা একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার এবং বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের তিনজন চেয়ারম্যান। গত এক যুগে বিভিন্ন রদবদলসহ কমিশনে কাঠামোগত নানা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় নি। সুনির্দিষ্টভাবে কমিশনের কার্যালয়ও নির্মিত হয়নি। খাগড়াছড়িতে অবস্থিত এর সদর দপ্তর এখনো নির্মাণাধীন। অন্য দুজেলা রাঙামাটি এবং বান্দরবানে এখনো এর অস্তিত্বই নেই। কাজের অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে, তা হল, ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস হয়েছে। এর তিনবছর পর ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এম মাহমুদুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে তিনবছর মেয়াদি ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু, আইনের কিছু বিরোধাত্মক ধারার জন্য কমিশনকে কার্যকর করা যায় নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিশেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি চেয়ারম্যান হিশেবে নিয়োগ পেয়েছেন ছয়মাস আগে। অথচ এ সময়ে তিনি পাবর্ত্য চট্টগ্রাম গেছেন মাত্র কয়েকবার। অফিস করছেন ঢাকায় নিজের বাসায় বসে। অথচ তা হওয়ার কথা ছিলো খাগড়াছড়িতে। এবারো যখন ভূমি বিরোধ নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ চলছে তখন তিনি বান্দরবানের নীলগিরি পর্যটনকেন্দ্রে সপরিবারে সফর করছিলেন।
পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্যাঞ্চলের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি, আইন বহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া হলে তা বাতিল এবং বৈধ মালিককে ভূমিতে বহাল করার ক্ষমতা দেয়া হয় কমিশনকে। ভূমি কমিশন সক্রিয় না হওয়ায় পাহাড়ে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে রয়েছে। পার্বত্য চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করলে ভূমি কমিশন ও শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় করা সম্ভব।
সম্প্রতি যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, ভূমি কমিশন সচল ও কার্যকর থাকলে তা ঘটতে পারত না বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ, গত
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাঘাইছড়ি, বাবুছড়া, মাইসছড়ি ইত্যাদি এলাকায় বেশ কিছু বাঙালি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। যাদের ওই সব এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়েছে তাদের জমির কাগজ-পত্রে আমিন-কানুনগো ইত্যাদির স্বাক্ষর হয়েছে ২০০৪ সনে। আর ২০০৮ সন পর্যন্ত ওইসব এলাকার হেডম্যানগণ কোনো খাজনা গ্রহণ করেন নি বা তাদের জমাবন্দি বইয়ে কোনো রেকর্ড হয় নি। তখন বাঙালিরাও অভিযোগ করেছিলো যে রেশন বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে ওই এলাকায় যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

০৫.
১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম রাঙামাটিতে জেলাসদর স্থাপন করা হয়। ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন জারি করা হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল নামে পরিচিত। পার্বত্য এলাকার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা এবং ব্রিটিশ শাসনের নিজস্ব প্রয়োজনের তাগিদে এ রেগুলেশনে বলা হয়, “একজন চাকমা, মগ অথবা পার্বত্য চট্টগ্রাম, লুসাই পাহাড়, পার্বত্য আরাকান বা ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী পাহাড়ি সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ ডেপুটি কমিশনারের নিজ বিবেচনা প্রদত্ত অনুমতিপত্র ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করতে বা বসবাস করতে পারবে না”। ১৯২১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পশ্চাদপদ এলাকা এবং ১৯৩৫ সালে বহির্ভূত এলাকা হিশেবে ঘোষণা করা হয়।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম থেকেই পাহাড়িরা অংশগ্রহণ করে। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে হিন্দু ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ প্রভাবান্বিত কংগ্রেসী আন্দেলন ও অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন। ফলে, পাহাড়িদের পক্ষে এ আন্দোলনে সামিল হওয়া ছিলো কঠিন।
১৯২০-এর দশকে কামিনী মোহন দেওয়ান ও বীরেন্দ্র কিশোর ত্রিপুরার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি গঠিত হয়। এ সংগঠনকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জনগণ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু এ স্রোত মুসলিম লীগ কিম্বা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হতে পারে নি।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু তখনো পার্বত্য এলাকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা
আসে নি। পার্বত্য জনগণের ধারণা ছিলো তাদের অঞ্চল ভারত বা বার্মার অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, ৯৫ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৯৭ শতাংশ অধিবাসী ছিল বৌদ্ধ বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট রাঙামাটি জেলা প্রশাসন অফিসের সামনে স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে ভারতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। অন্যদিকে বোমাং সার্কেলের অধিকাংশ আদিবাসী মারমা বা বংশী বংশোদ্ভুত হওয়ায় বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলিত হয়। অবশেষে ১৭ আগস্ট বঙ্গীয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন এর চেয়্যারম্যান র‌্যাডক্লিপের রায় অনুসারে চট্টগ্রামের আশেপাশের পার্বত্যাঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ২১ আগস্ট পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্ট রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে। একইভাবে বান্দরবানেও বার্মার পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। ভারত ও বার্মার পতাকা উত্তোলনের ঘটনা পাকিস্তানি শাসকদের ক্ষুব্ধ করে। তাদের ধারণা জন্মায় যে পাহাড়িরা পাকিস্তান বিরোধী। এর ফলে তাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়। ১৯০০ সালের পার্বত্য রেগুলেশনের ধারা বিলুপ্ত করা হয়। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব পুলিশ বাহিনি বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রথমবারের মতো শুরু হয় বাঙালি পুনর্বাসন।

০৬.
পাহাড়ি জনগণের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হিশেবে নেমে আসে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। ১৯৫৯ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু এর সাথে শেষ হয়ে যায় লাখো পাহাড়িদের আবাসস্থল, জীবন-জীবিকা এবং স্বাভাবিক জীবন। ৩৫০ বর্গমাইল এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। উপত্যকার ৪০ শতাংশ কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। কাপ্তাই হ্রদে ডুবে যায় রাজবাড়ি। ১০ হাজার পরিবার স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৮ হাজার পরিবারের ১ লাখ পাহাড়ি জমি হারায় ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। উৎখাত হওয়া চাকমারা অনেকে ভারতের অরুণাচলে আশ্রয় নেয়। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫৯ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, বাস্তবে তারা ক্ষতিপূরণ পায় মাত্র ২.৬ মিলিয়ন ডলার। বাকিটা প্রশাসনিক কারচুপি, দুর্নীতি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে পাকিস্তানি-বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ীরা আত্মসাৎ করে। ওই ঘটনার ৫০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু পুনর্বাসন বা কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পায়নি প্রায় ৮ হাজার পরিবার। যাদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল তাদেরকে দেয়া হয়েছিলো নামমাত্র ক্ষতিপূরণ, পাঠানো হয়েছিল দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। এরপর আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা, পুরো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মনে এক দগদগে ঘা হয়ে টিকে আছে।
যে বিদ্যুতের জন্যে পাহাড়িরা একদিন বাস্তুহারা হয়েছে, সেই বিদ্যুৎ সুবিধা তারা এখনও পায় নি, কেবল জেলাসদর গুলিতেই বিদ্যুত আছে।

০৭.
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী শরিক হয়েছিলো। তাদের ধারণা ছিলো, দেশ স্বাধীন হলে তাদের পরবাসী দশার অবসান ঘটবে, সাংবিধানিকভাবে তাদের স্বীকৃতি দেয়া হবে। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন অচিরেই ধুলিসাৎ হয়ে যায়। পার্বত্যাঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা উত্থাপিত গণপরিষদে (১৯৭২) সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাকচ হয়ে যায়। ওই সংবিধানে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি এবং মর্যাদার ব্যাপারে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয় নি। ফলে ১৯৭২ সনে গড়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সংগঠনের প্রথম সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিশেবে দায়িত্ব পান বি. কে রোয়াজা এবং মানবেন্দ্র লারমা।
আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন নীতি পাহাড়িরা মানতে পারে নি। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিব নির্বাচনী সফরে রাঙামাটি যান। তিনি ভাষণে বলেন, “এতদিন তাদের (পাহাড়িদের) তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকেরও মর্যাদা দেয়া হয় নি। সেদিনের অবসান হয়েছে। উপজাতিরা দেশের যে কোনো নাগরিকের সমান মর্যাদা পাবে। উপজাতীয়দের অবস্থার উন্নতি সাধনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ... উপজাতিদের প্রমোশন দিয়ে আজ থেকে বাঙালি করা হলো।”
ইতোমধ্যে পার্বত্য এলাকায় বিডিআর এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির বিভিন্ন নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড পাহাড়িদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ওই বছর জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব সিদ্ধান্তে আসেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তারা দাবি আদায় করতে পারবে না। ফলে, ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি জনসংহতি সমিতির গোপন এবং সশস্ত্র সংগঠন হিশেবে শান্তিবাহিনি আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৫-এর আগস্টে দেশে সামরিক শাসন জারির পর পাহাড়ের পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে।
১৯৭৭ সালে মিলিটারি কনভয়ে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামরিক বাহিনি সরাসরি পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। এর মাধ্যমে পার্বত্য
চট্টগ্রামে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালেই পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে বড় রকম সেনা অভিযান পরিচালিত হয়। মাটিরাঙা, গুইমারা,
মানিকছড়ি, লক্ষ্মীছড়িতে সামরিক অভিযানে ৬৩ জন পাহাড়ি নিহত হয়। ১৯৮৪ সালের ৩১ মে বরকলে ২৬ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১৭ ব্যাটালিয়ন বিডিআর ১১০ জন পাহাড়িকে হত্যা করে।
১৯৮৬-এর ১ মে পানছড়িতে ১০০ পাহাড়িকে হত্যা করা হয়। এবং মাটিরাঙায় হত্যা করা হয় ৭০ জনকে।
১৯৯২-এর ১০ এপ্রিল খাগড়াছড়ির লোগাং-এ ১৩৮ জন পাহাড়িকে হত্যা করা হয়।
এসব ছিল বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড। এর বাইরেও অসংখ্য হত্যাকাণ্ড পাহাড়ে পরিচালিত হয়। শত শত পাহাড়ি নারী ধর্ষণের শিকার হয়। হামলার তীব্রতায় অনেক পাহাড়ি ভারতে পালিয়ে যায়। এসব ঘটনার দায় সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনি এবং শাসক সরকারসমূহের ওপরই বর্তায়।
পক্ষান্তরে শান্তিবাহিনির হাতে ১৯৮০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত ৯৫২ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। শান্তিবাহিনি বিভিন্ন সময় ৪১১ জন বাঙালি এবং ২১১ জন পাহাড়িকে অপহরণ করে। এই সমস্ত সংঘাতে প্রায় ২০ হাজার পাহাড়ি-বাঙালি মৃত্যুবরণ করেছে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী একদিকে দেশের শাসকদের অগণতান্ত্রিক নীতি ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে, অন্যদিকে পাহাড়িদের বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকা ও ভারতের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে যে কাজে আমাদের সরকারও শরিক থেকেছে। এর বলি হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক দাবি। অথচ, পাহাড়ের এ সমস্যাকে যদি সংবেদনশীলভাবে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় বিচার করা হতো তাহলে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভবই হত না। সেটেলার বাঙালিদের পরিস্থিতি সমতল ভূমির ভাগ্যহীন দরিদ্র মানুষদের এখানে সেটেলার নাম দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়। তাদের কেউ নদী ভাঙনে নিঃস্ব, কেউ ভূমিহীন, কেউ বা মহাজনী ঋণে এবং পুঁজিবাদী শোষণে সর্বস্বান্ত। শুরু থেকে তাদের যে প্রক্রিয়ায় সেটেলার হিশেবে বসানো হয় তা যে উদ্দেশ্যমূলক ছিলো এটা স্পষ্ট।

০৮.
তিন পার্বত্য জেলার সিংহভাগ ব্যবসা অথবা কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে বাঙালিরা। আদিবাসীরা শুরু থেকেই সুবিধা বঞ্চিত। এখনো তাই। এইসব অঞ্চলে বোট (টেম্পু/ট্রলার), আবাসিক হোটেল, মুদিদোকান, মার্কেট, বাস, অটোরিকশা, ট্রাক অধিকাংশের মালিক পাহাড়ি বাঙালি এবং বাঙালি সেটেলাররা। আর পাহাড়ি আদিবাসীরা অধিকাংশই এখনোই জুমচাষের উপর নির্ভরশীল। এমন কি হ্রদের মাছ পর্যন্ত বাঙালিদের, বাঙালিরা লিজ নিয়ে বাঙালি জেলেদের (যাদের আনা হয় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে) দিয়ে মাছচাষ এবং মাছ ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিপণন এবং বাইরে রপ্তানি করে। দেশের সিংহভাগ মাছ উৎপাদিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তারিত হ্রদে।


০৯.
পার্বত্য অঞ্চলের বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে তিনভাগে শ্রেণিবিভাগ করা হয়-- পাহাড়ি আদিবাসী, স্থায়ী বাঙালি এবং সেটেলার বাঙালি।
১৯৫১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনসংখ্যার পরিমাণ ছিলো মাত্র ১৮ হাজার ৭০ জন; মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ। স্বাধীনতার আগে ১৯৬৬ সালে কয়েক হাজার বাঙালিকে সেটেলার হিসাবে বসানো হয়। স্বাধীনতার পরপর এখানে বিপুল সংখ্যক বাঙালিকে পুনর্বাসন করা হয়। ফলে তখন শতকরা হিসেবে বাঙালিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬.২৯ জন। ১৯৭৯ সাল থেকে পাবর্ত্যাঞ্চলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ব্যাপক আকার ধারণ করে। ওই সময় সরকার বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে গোপন সার্কুলার পাঠায়। তারই অংশ হিসেবে ওই বছর ৩০ হাজার বাঙালিকে পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রক্রিয়া পরবর্তী বছরগুলোতেও অব্যাহত ছিল। যে কারণে ১৯৮১ সালে পাহাড়ে বাঙালির পরিমাণ দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৪০.৯৩ শতাংশ। এক হিসাবে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের মধ্যে পার্বত্য এলাকায় চার লক্ষ বাঙালিকে পুনর্বাসিত করা হয়।

১০.
স্বাভাবিক অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যেসব বাঙালি পাহাড়ে জায়গা-জমি কিনে বসবাস করছেন তাদের বিরুদ্ধে পাহাড়িদের খুব একটা অভিযোগ নেই; তাদের মূল অভিযোগ হচ্ছে সেটেলার বাঙালিদের বিরুদ্ধে। কারণ, এরা পাহাড়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আসে নি। সরকার এদেরকে এখানে এনেছে তথাকথিত কাউন্টার-ইন্সারজেন্সি পলিসির আওতায়, পাহাড়িদের পার্বত্য এলাকায় সংখ্যালঘু বানিয়ে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে দাবিয়ে রাখার বুর্জোয়া ঘৃণ্য কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে; যে-কারণে গত ৩০ বছর যাবৎ এদের বেঁচে থাকার প্রধান উপায় হলো সরকারি রেশন। থাকতে হয় সেনাপ্রহরাধীন গুচ্ছগ্রামে। রেশনের নামে এখানে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সরকারি অর্থ। তবে, অভিযোগ আছে, তাদেরকে দেওয়া রেশন নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে, এ অসহায় বাঙালিরা চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। অভিযোগ রয়েছে, তাদের অনেককে খাস জমির জাল দলিলও দেয়া হয়েছিলো।

১১.
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য এলাকায় বিরোধ নিরসন ও শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতি এবং সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল যাকে ওই সরকারের পক্ষ থেকে শান্তি চুক্তি নামে অভিহিত করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী সরকার পর্যায়ক্রমে পার্বত্য জনপদগুলো থেকে সামরিক বাহিনি প্রত্যাহার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা এবং ভূমি কমিশন গঠন করে পাহাড়িদের ভূমি, যেগুলি নিয়ে বাঙালিদের সাথে বিরোধ আছে তার সমাধান করার কথা। চুক্তির এক পক্ষ, জনসংহতি সমিতির দাবি যে লিখিতভাবে না থাকলেও, সরকার মেনে নিয়েছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে পুনর্বাসিত বাঙালিদের (১৯৭৯ থেকে ৮৪ পর্যন্ত) পর্যায়ক্রমে সুবিধামতো দেশের অন্য জায়গায় সরকার পুনর্বাসন বা স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সরিয়ে নেবে। জনসংহতি সমিতির এই দাবি সরকার সরাসরি স্বীকার না করলেও জোর গলায় অস্বীকারও করতে পারছে না। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে শক্তিশালী করা ও এর ক্ষমতায়ন, তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা-- এসবের কোনোটাই হয় নি। সন্তু লারমাকে কলের পুতুল হিশেবে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান করা হয়।
চুক্তিতে আরো বহু বিষয় থাকলেও উপরোক্ত বিষয়গুলোই প্রধান। চুক্তি হয়েছে একযুগ পার হয়ে গেছে। কিন্তু, ক্যান্টমেন্টের বাইরে সেনাবাহিনি
পুরোদমেই বহাল আছে। তাদের বিভিন্ন অপারেশন কার্যক্রমও চলছে প্রায় আগের মতোই। বাঘাইহাটে কোনো ক্যাম্প প্রত্যাহার হয় নি। ফলে
সেনাবাহিনি থাকার পরও, এমনকি সেনাক্যাম্পের ৫০/১০০ গজের মধ্যে ঘটা এবারের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যায় নি। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাঘাইহাট ও গঙ্গারামমুখে এ নারকীয় ঘটনা ঘটেছে এবং সেনাবাহিনীর গুলিতেই পাহাড়িদের মৃত্যু হয়েছে।
বর্তমান সরকার ২৯ জুলাই ’০৯-এ পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত কিছু সেনাক্যাম্প গুটিয়ে সেনা সদস্যদেরকে ওই এলাকারই ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সে হিসেবে কিছু কিছু জায়গা থেকে ছোট ছোট সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে যেগুলো আসলে বর্তমান সময়ে তাদের কাছেই অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছিল। এখানে সামরিক অভিযানের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। তবে, সেনাবাহিনি সরে গেলেও ক্যাম্পগুলোতে বিডিআর, আর্মড পুলিশ, আনসার ইত্যাদি থেকে গেছে অথবা নতুন করে এসব বাহিনির ক্যাম্প বসছে। আর ভূমি কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো কাজই করতে পারে নি। পাহাড়ে বাঙালি সেটেলারদের পুনর্বাসনও বন্ধ হয় নি।

১২.
এখন পাহাড়ে পাহাড়ি আদিবাসীরা সংখ্যালঘু। পরিকল্পিতভাবেই রাষ্ট্রযন্ত্র ক্রমে ক্রমে তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে। খুব সম্ভব তাদের হার ৪২ শতাংশ। আর সংখ্যালঘু মানেই নির্যাতিত এবং সুবিধাবঞ্চিত। এখনো তারা প্রথমশ্রেণির নাগরিক নয়। তাদেরকে সাংবিধানিক ভাবে আদিবাসি অথবা বাঙালি বলা হয় না। বলা হয় উপজাতি।
একসময় সেটেলারদের বসানোর আগে পাহাড়িবাঙালি মিলেমিশে থাকতো। তখন বাঙালি ছিলো সংখ্যালঘু। জিয়া সরকার বাঙালি ছিন্নমূলদের পাহাড়ে বসানোর পর থেকেই সমস্যা মহামারি আকার ধারণ করে। কেননা, যার কিছু নেই সে যদি হঠাৎ করে কিছু পেয়ে যায় সদ্যপাওয়া নিজেরটা আকড়ে ধরার সাথে সাথে অন্যেরটাও কেড়ে নিতে নিজের দখলে রাখতে চায়। এইখানে ধর্ম একটা বিরাট ফ্যাক্ট। বাঙালি সেটেলারদের ধরতে গেলে নব্বইভাগই মুসলমান, আর অশিক্ষিত মুসলমান মাত্রই ফ্যানাটিক হ্ওয়ার সম্ভাবনা আশি ভাগ। পারিবারিকভাবেই তারা জেনে যায় ইসলাম ছাড়া কোনো ধর্ম নাই। অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠি বিধর্মী, বা জাতিগোষ্ঠী (বলাবাহুল্য আমাদের দেশে ধর্মের ভিত্তিতে জাতিগোষ্ঠী নির্ধারণ করা হয় প্রকৃত অর্থে, ভাষাভিত্তিক বাঙালি কেবল নথিপত্রে, ওটা মানেনও কয়েকজন) বিধর্মী মানেই পাপী, এবং এদের শেষ ঠিকানা নরক। ফলত তৈরি হয় একধরনের ঘৃণা। আর ঘৃণাটা প্রকাশিত হয় দলে ভারি হওয়ামাত্র।
হিশেব কষলে দেখা যায় উগ্রজাতীয়তাবাদিদের মধ্যে হিন্দু খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধ তেমন কেউ নেই। বলতে গেলে সবাই মুসলমান। তাই বলতে পারছি উদ্রজাতীয়তাবাদের জন্ম ইসলাম ধর্ম থেকেই, বাঙলা ভাষা থেকে নয়। যদিও বলা হয় ইসলাম মানবতাবাদী, কিন্তু ইতিহাস বলে ইসলামই সবচে বেশি পৃথক করেছে। যথা ইসলামি রাষ্ট্রকল্পে বিধর্মী কোনো প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয় না।
পাহাড়ে এখন হানাহানি রোধ কোনো চুক্তি কিংবা প্রশাসন কিংবা সেনাবাহিনি (সেনাবাহিনি অবশ্য একটাকাজ পারে, সেটা হলো কল্পনা চাকমার মতো আন্দোলনকারি আরও কাউকে রাতের অন্ধকারে অপহরণ করে নিয়ে ধর্ষণ করে লাশ গুম করে ফেলতে) বন্ধ করতে পারবে না। কারণ হিংসা আর প্রতিহিংসা পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘতর হ্রদটির মতো আজ বিস্তারিত।
উপায় হলো, আমার যা মনে হয়, বাঙালি সেটেলার প্রত্যাহার করে সরকারি খাসজমি (হাজার হাজার একর খাসজমি পড়ে আছে এবং বেদখল হয়ে আছে, বেখল করে রেখেছে প্রভাবশালি পুঁজিপতিরা যাদের জমির দরকার নাই) এবং সেইসব পাহাড়ে আদিবাসিরা থাকে না ওইসব জায়গায় পুনর্বাসন করতে হবে। জিয়া এবং তার পূর্ববর্তী প্রশাসনের হঠকারিতার মাসুল এ ছাড়া আর কোনোভাবেই দেয়া সম্ভব নয়।
একটা জাতিসত্তা স্বায়ত্তশাসন এমনিতেই দাবি করে না। কেনো দাবি করে সেটা বলাবাহুল্য।

উগ্রজাতীয়তাবাদী, ফেসিস্ট এবং ফ্যানাটিক শক্তি ধ্বংস হোক।

-----------------------------------------------------------------------------------

তথ্যসূত্র:
* পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝর্ণাধারা-- হুমায়ুন আজাদ।
* ভ্যানগার্ড, মার্চ. ২০১০.
* কর্ণফুলির কান্না (প্রামাণ্যচিত্র)-- পরিচালক: তানভীর মোকাম্মেল
* কল্পনা চাকমার ডায়েরি
* মুক্তাশ্রী চাকমা সাথী, আমার বন্ধু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আইন শেষবর্ষ।
* চয়ন চাকমা, একজন কবি।
* শান্তিবাহিনির একজন প্রাক্তন সদস্য, এখন রাঙ্গামাটি সদরে, রাজবাড়ি সড়কে ছোটোখাটো চায়ের দোকানদার।
* সাজেক ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন আদিবাসী নারী পুরুষ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:৪১
৪৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×