একটি দেশের শিক্ষার ট্রেন্ড বা গতিপ্রকৃতি সাধারণভাবে কোন্ দিকে প্রবাহিত হবে এবং সে দেশের মানুষকে কীভাবে জনসংখ্যা থেকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা হবে, সেই বিষয়গুলোসহ শিক্ষাকে কীভাবে সার্বিকভাবে কাজে লাগানো হবে, তা নির্ধারণে প্রথমে শিক্ষার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে হয়। জাতীয় চেতনা ও সংবিধানের আলোকে এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো ঠিক করা হয়। লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য ঠিক করে সে অনুযায়ীই শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থার যে কোনো দিক নিয়ে আলোচনার প্রথমেই চলে আসে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমদিকে তখনকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাই অনুসরণ করা হয়েছিলো। কিন্তু পাকিস্তান আমলের সেই শিক্ষাব্যবস্থা নতুন দেশের পক্ষে অনুপযোগী হওয়ায় এবং যুগের সঙ্গে পরিবর্তনের তাগিদ থেকে শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিশন। এই কমিশন তৎকালীন জাতীয় চেতনা বা সংবিধানের চার মূলনীতি অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেতার আলোকে ১৯৭৪ সালে একটি শিক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেতা, দেশপ্রেম ও সুনাগরিকত্ব, মানবতা ও বিশ্বনাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়াররূপে শিক্ষা, প্রয়োগমুখী অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূলে শিক্ষা, কায়িক শ্রমের মর্যাদাদান, নেতৃত্ব ও সংগঠনের গুণাবলী, সৃজনশীলতা ও গবেষণা এবং সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক প্রগতির ক্ষেত্রে শিক্ষা।
কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে একদিকে জাতীয় চার মূলনীতির কথাকে প্রাধান্য দিয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর মধ্যে যে যে গুণাবলীর বিকাশ ঘটবে, সেগুলোর কথাও সেখানে বলা হয়েছে। একটি পর্যায় বা স্তর অতিক্রম করার পর শিক্ষার্থীর নিজের মধ্যে কোন্ গুণের বিকাশ ঘটবে, সেগুলো যেমন বর্ণিত হয়েছে এখানে, তেমনি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে সার্বিকভাবে এবং সাধারণীকরণের মাধ্যমে সবার জন্য কোন্ গুণগুলো উন্মুক্ত হবে, তাও সেখানে বলা হয়েছে। নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সেখানকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটি মুখ্য বিষয় হিসেবে কাজ করেছে এবং কমিশন শিক্ষার্থীদের সেভাবেই সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়াররূপে তৈরি করার দিকে গুরুত্ব দিয়েছিলো। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তসহ সকল শ্রেণীর জনগণের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে উপলব্ধি জাগানো। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সমাজের সব মানুষকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে উপলব্ধি ঘটাতে না পারলে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। শুধু শিক্ষার্থীরা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না, সমাজে পরিবর্তন আনতে পারবে না। এ কাজ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে করতে হবে, তবে শিক্ষার্থীরা নানা দিক থেকে এই কাজকে গতিশীল করায় ভূমিকা রাখতে পারে।
কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের তৈরি প্রতিবেদন রাজনৈতিক কারণে গৃহীত হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশে অধিকাংশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টই রাজনৈতিক কারণে গৃহীত হয়নি। এক সরকারের তৈরি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট অন্য সরকার বাতিল করে দেয়। সরকারের নিজস্ব কিছু কর্মসূচির আলোকে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় নতুন শিক্ষা কমিশন। এই ধারাবাহিকতায় অনেক দিন বিরতির পর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় মফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে নতুন আরেকটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট। সেখানে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ১০টি পয়েন্ট উত্থাপন করা হয়। এই ১০টি পয়েন্ট বা বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ সমাজের প্রতি স্তরের মানুষের নিজ নিজ মেধা ও প্রবণতা অনুসারে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা, সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে শিক্ষার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মানুরাগ বৃদ্ধি করা, শিক্ষার্থীদের বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক ও সমাজ-সচেতন মানুষে পরিণত করা, সমাজে মুক্ত চিন্তার বিকাশ করা ইত্যাদি।