শীতের এই সময়টা বলা চলে ডিসেম্বর মাস এলেই আমার আনন্দ আর ধরে রাখা যেতো না । স্কুলে পড়া কালীন বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়া মানেই গ্রামের পথে ছুটা । আমার আর আপুর রীতিমতো যুদ্ধ লেগে যেতো , ব্যাগ এ কে কার কাপড় রাখবে আগে,তা নিয়ে ঝগড়া , ইচ্ছে হতো সব কাপড় ব্যাগ এ ঢুকিয়ে ফেলি । আম্মুর বকাতে আমরা শান্ত হতাম অবশেষে ।
তারপর সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা ,আগে থাকতেই কেবিন আব্বু বুকড করে রাখতো ।৩ তালা লঞ্চে কখনো ২ তালায় কিংবা ৩ তালায় কেবিন টা থাকতো । লঞ্চ ছাড়ার সময় হলে আম্মু বারবার জানান দিত , বাচ্চারা সরে দাড়াও , লঞ্চ ধাক্কা দিবে কিন্তু।
সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি আমরা একটু পর পর চেয়ার পেতে বাহিরে বসে নদীর দৃশ্য উপভোগ করতাম । লঞ্চে নাকি ছেলে ধরা আছে , আম্মু তাই বেশিক্ষন থাকতে দিত না । লঞ্চে অনেক মজা ,আমি আর আপু টয়লেট যাবো বারবার মিথ্যে বলে ঘুরে আসি আর সাথে ভাইয়াও আসতো । লঞ্চে সেদ্ধ ডিম খাওয়া যে কি মজার কেউ ওইখানে বসে না খেলে বুঝার উপায় নেই । তাছাড়া চানাচুর আর ঝালমুড়ি তো ছিলই । লঞ্চে কেবল ঘন ডাল রান্না টাই ভালো হত ,বাকি রান্না মুখে তোলা যেতো না ।
সকাল বেলা যখোন আমাদের গ্রামের ঘাটে লঞ্চ এসে থামতো ,আমরা সবাই বাহিরে এসে দাড়াতাম । ছোট মামা ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতো ,কি যে ভালো লাগতো ।
গ্রামের বাড়িতে প্রথম একটু খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগতো।
তারপর যখন কাজিনরা ঝাকে ঝাকে আসতো , তখোন আর কে পায় আমাদের । সারাবেলা খেলা আর গল্প লেগেই থাকতো ।
দুঃখের বিষয় কাজিনদের মধ্যে তখন ছোট ছিলাম বলে , আমাকে সবাই খেলায় দুধভাত রাখতো । কিছু দিন পরেই আমরা লাকড়ি চুলা বানানো শুরু করে দিতাম , সব কাজিনরা মিলে চলতো পিকনিক । সকাল বেলা আমরা বড়শি ফেলে মাছ ধরতাম তখোন , সেই মাছ আমরা সবাই মিলে রান্না করতাম । লাকড়ি চুলা জ্বালানো যে কি কঠিন , লাকড়িতে আগুন ধরিয়ে চুলার গর্তে ঢুকাতে হয় , তারপর জোরে জোরে ফুঁ দিতে হয় না জ্বলা পর্যন্ত । চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তো । তাও মজার ছিল সবাই মিলে রান্না করার ।
গ্রামের ভোরবেলা আমাদের কে আম্মু আন্টিরা জাগিয়ে তুলতো , কি যে কষ্ট ছিল ঘুম থেকে উঠা । রান্না ঘরে চোখ ডলতে ডলতে আমরা সবাই হাজির হতাম ।গরম গরম চিতই পিঠা সাথে গুড় চিনি নাহলে ধোঁয়া উড়ানো ভাপা পিঠা খেতে গিয়েই ঘুম ভেঙে যেতো । তারপর সকাল দশটা হলে ভাত চলতো, গ্রামে তিন বেলায় তখোন ভাত খেতো । সন্ধ্যা হলে রসে ডুবানো পিঠা কিংবা বাজার থেকে আনা গুড়ের জিলাপি আর না হয় বাজারে বসে মিষ্টি খাওয়া ছিল পরম আনন্দের কাজ ।
রাত হলেই জমতো জ্বীন ভুতের গল্প । হালকা হারিকেনের আলোয় সেই গল্প বেশ জমে যেতো । একদিন সকাল বেলা ভাইয়া আর একজন কাজিন মিলে বাঁশ ঝাড়ে ডুকলো জ্বীন খুঁজার উদ্দেশ্যে । অনেকক্ষণ পর ফিরে এলো দুইজন হাপাতে হাপাতে । আমরা তো ভয়ে শেষ । ভাইয়া বলতে লাগলো , জ্বীন নাকি কাজিনকে ধরে আছাড় মেরেছে ,জ্বীনের ইয়া বড় দাড়ি আর অনেক লম্বা সে , সাদা জামা পড়া ছিল । আমরা আর সেই রাত ভয়ে ঘুমাতে পারিনি । বড় হয়ে জানলাম , সেই গল্প নাকি ভাইয়া আর কাজিন মিলে বানিয়েছিল ।
আজ এখানেই শেষ । সবাই ভালো থাকবেন ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৩