রানী মহল নামক বাড়িটি আজ আলোয় সজ্জিত । এতদিনের নীরব বাড়ি যেনো আজ প্রান খুঁজে পেল । চারিদিকে হাসি, হৈচৈ কোনো কিছুরই কমতি নেই । ছাঁদে চলছে নাচের রিহার্সেল । আর দুতালাতে জমেছে গল্পের আসর । বিশাল এলাহি কান্ড । আর ঘন্টায় ঘন্টায় রয়েছে চা কফির আয়োজন ।
সব কিছু থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মিলি । ছাদের এই পাশ টা তার খুব প্রিয় । মন খারাপ হলেই এখানে এসে তার সকল কষ্ট অভিমান চোখের জল হয়ে নামে । ছোট বেলায় কেউ বকা দিলে এখানে লুকিয়ে থাকতো । একবার সে কি কান্ড , মিলির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, সারা বাড়ি খুঁজে সবাই মাথায় তুললো , মাইকে বলা হলো, কিছুতেই কিছু হল না, শেষে দেখা মিলল মিলির এই গুপ্ত জায়গায় । মিলি কাঁদতে কাঁদতে সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল , ঘুম থেকে উঠেই এতো লোক দেখে ভয় এ পেয়ে গিয়েছিল । তারপর থেকে এই জায়গা আর গোপন থাকলো না । কখোন যে কে এসে পড়বে ,ভয় উকি দিল মিলির মনে , আজ সারাদিন সবাই মিলিকে ঘিরে রেখেছিল ,অবশেষে একটু রেহাই পেলো ।
হাতে মেহেদির আলপনা, বাতাসে খোলা চুল , ভেসে আসা গানের সুর , সব মিলে অপরূপ কোনো নারীর ছায়া যেন । এমন এক দৃশ্য তো শ্রাবন একেছিল । কথা ছিল গায়ে হলুদে দুই জন মিলে নাচ করবে , সুরের ছন্দে হ্নদয় মন কম্পিত হবে । মনে হবে ফুলেল সাজে সজ্জিত কোনো এক দেবী রূপ ললনা দাড়িয়ে আছে । অপলক দৃষ্টি ভাঙবে বিয়ে বাড়ির তীব্র কোলাহলে । সব আশা ভেঙে গেল কেবল একটি মেসেজে ।
সময় টা ছিল শীতের হিমেল হাওয়ার ক্লান্ত কোন দুপুর । হঠাৎ অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো, দুই বার রিং বাজতেই মিলি ফোন কেটে দিল । আবার বেজে উঠলো । বাধ্য হয়েই ফোন ধরেই বলল ,বলুন শুনছি । ওপাশ থেকে শ্রাবন হেসেই বলল কেমন আছেন ? শুরু টা এভাবেই ছিল । এরপর রাতের পর রাত শ্রাবনের ফোন আসতেই লাগলো । বিরক্ত হয়ে মিলি মাঝে মাঝে ফোন রিসিভ করেই ফেলতো । শ্রাবনের ঐ সময় টা খুব একাকী কাটছিল, শূন্যতা কাটাতে এক সময় মিলিকে পেয়ে যায়, লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনে চলতো তাদের কথপোকথন ।
সময়ের ধাপে ধাপে মিলি তখোন কলেজে পদার্পন করল, দীর্ঘ দুই বছর পর অবশেষে তাদের সামনাসামনি দেখা মিলল । তার ঠিক তিন মাস পর শ্রাবন বিদেশ পাড়ি জমালো । শুরু হলো মিলির দীর্ঘ অপেক্ষা । দেড় বছর পর পর তাদের দেখা মিলতো । ফোনে তেমন আর কথা হতোই না । মেসেজ আদান প্রদানই ছিল শেষ ভরসা । এভাবে কেটে গেল ঝগড়া অভিমান ছাড়া ছয় বছর ।
শ্রাবন গ্রাজুয়েশন শেষ করে চলে আসলো । সমস্যার শুরু তখোনি । মিলির অভিযোগ শুরু হল , অভিমান জমে জমে পাহাড় আকার ধারন করল । আগের ভালোবাসা কোথায় যেন হারিয়ে গেল । শ্রাবনের কাছে সব অর্থহীন লাগে, সামনে ক্যারিয়ার গড়তে হবে , মিলির কথা এখোন আর অতো ভালো লাগে না । দেশে এসেও দুজনের মাঝে বিশাল এক দেয়াল গড়ে উঠলো । শ্রাবনের তাতে মাথাব্যথা নেই, এতো ভাবলে কি আর চলে , অবশেষে ভেবেচিন্তে মিলিকে ব্রেক আপ এর মেসেজ টা পাঠালো । আর এভাবেই শেষ হলো সাত বছরের সম্পর্ক ।
একটা বছর মিলির মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, পড়াশুনায় মন বসছিল না , বারেবারে মনে হচ্ছিল শ্রাবন ফিরে আসবে, এটা হয়তো স্বপ্ন । সারাদিন ঘর অন্ধকার করে রাখে , মুখ চেপে কান্না আর আর্তনাদে ঘরের দেয়াল ও যেন কেঁদে উঠতো । এমন টা তো হবার কথা ছিল না । শ্রাবন ওর জীবনে প্রথম ছেলে আর প্রথম ভালোবাসা । আজো কি যত্নে শ্রাবনের দেয়া প্রথম গোলাপের পাপড়ি বইয়ের পাতায় রেখেছে ।
দুই বছর কেটে গেল, শ্রাবন আর ফিরলো না । মিলি এখোন আর অভিমানে কাঁদে না ।
তিন দিন পর মিলির বিয়ে । অনেক টা ক্লান্ত হয়েই বিয়েতে মিলির রাজি হওয়া । সীমান্তরাই একদিন হুট করে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো । মেয়েকে নাকি ছেলের খুব পছন্দ, কোথায় জানি দেখেছে , এখন তার আর কাউকেই ভালো লাগে না , হেসে হেসে বলল সীমান্তর মামা । মিলির বাবা মায়েরও ভালো লাগে সীমান্ত কে, ভদ্র ছেলে খুব মানাবে মিলির সাথে , বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করে ফেললেন মিলি কে । প্রস্তাব পাঠানোর সাতদিন পর রেস্টুরেন্টে প্রথম দেখা হলো মিলি আর সীমান্তের । সীমান্তের হাসি টা অবিকল শ্রাবনের মতো, মিলি চোখ ফিরাতে পারছিল না কিছুতেই, এও কি সম্ভব, শ্রাবন কি তবে সীমান্তের মাঝে ফিরে এলো । এরপর দুই একবার ওদের আবার দেখা হলো । সীমান্তর হাসি যেনো ওকে বারবার টানছিল । মিলির কেবল মনে হচ্ছিল ওকে আমার চাই ।
মিলির কাজিন হাপাতে হাপাতে চলে এলো । ছাদের কোনেই মিলিকে দেখতে পেল । হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো নীচের ঘরে । সীমান্ত দাঁড়িয়ে আছে । অপলক দৃষ্টি আর ঠিক সেই মিষ্টি হাসি । সময় যেন চলছে মন্থর গতিতে । অন্যের জন্য অপেক্ষা সুখ হয়ে ধরা দিল পড়ন্ত এই বিকেলে । সময় যেন আজ রাঙ্গিয়ে দিল সহস্র দিনের ঝরে পড়া অশ্রু জলকে ।