অনামিকার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেই ৯৬ সালে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনীতে ওঠার পরপরই ওরা একদিন বেড়াতে এসেছিল আমাদের বাসায়। খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল আমাদের। সেই প্রথম দেখা। প্রথম ভাল লাগা।
সে আমার ব্যাচেই পড়ত, তবে অন্য কলেজে। ছোট্টখাট ছিমছাম একটা মেয়ে। তার সাথে বেশির ভাগ সময়ই আমার কথা হত বই দেয়া নেয়ার সময়। কখনো ফিজিক্স কখনো কেমিস্ট্রি কখনো বা বায়োলজি। শুধু বই আনতে বা দিতেই যেতাম তাদের বাসায় - কখনো আর খুলে দেখা হত না বইগুলো। আমাদের বাসায় সবাই জানত এই ভাললাগার কথা, হয়ত মেনে নেয়নি - তবে এই একটা ব্যাপারে আমাদের বাসায় বেশ লিবারেল ছিল, বাধা দেয়নি কখনোই। তবে বাবা একদিন হেভী খেপেছিল আমার উপরে। অনামিকার প্রতি সেই মোহ দেখতে না দেখতেই কখন যেন ভাললাগা থেকে ভালবাসায় রূপ নিয়েছিল।
আমি কোচিং করার সময় সে আমার উৎসাহ দিয়েছিল অনেক। বার বার বলত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হওয়ার কথা। ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং করার সময় অনেকদিন খুলনায় ছিলাম আমি, সেই সময়ই একসময় অনামিকা জানাল তার ভাললাগার কথা। আমি তো মনে মনে ভালবাসতাম অনেক আগে থেকেই।
বাবা রিটায়ার করার পর আমরা বগুড়ায় চলে আসলাম। আমাদের তখন দুঃসময়, খুবই আর্থিক সংকটে ছিলাম আমরা কয়েকটা বছর। অনামিকারাও ওর বাবার ট্রান্সফারের জন্য চলে আসল বগুড়ায়। সেই দুঃসময়ে যখন আমি ভবিষ্যত নিয়ে খুব বেশী চিন্তায়, সাহস পেতাম ওরই কাছ থেকে। তিনটা বছর কিভাবে যে কেটে গেল আমাদের।
বিআইটি তে ভর্তি হবার পর আমি খুব বেশী বোহেমিয়ান হয়ে গেলাম। একরকম ফ্রাসট্রেশনেই কেটেছে অনেকটা সময়। বাবার আর্থিক সমস্যা, আমার পড়াশোনা সবমিলিয়ে কেমন যেন জটপাকিয়ে গেল সব কিছু। একসময় খেয়াল করলাম আমাদের দুজনের দুরত্ব নিজেদের অজান্তেই বেড়ে গেছে অনেক।
হলে থাকার সময় ওর চিঠি পেলে মজা হত খুব। রুমমেটরা মাঝে মাঝে জোর করেই পড়ত। রাহুল পড়ত জোরে জোরে - সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে। আর পড়া শেষ করে সারমর্ম বিশ্লেষন করত। অনামিকা ছিল খুব চুপচাপ স্বভাবের। হাসত খুব।
যা বলছিলাম - দুরত্ব বাড়তে লাগল ক্রমেই। শেষ চিঠিতে অনামিকা বলেছিল ভালবাসে আমাকে খুব। তারপরেই একদিন দেখা হল আমাদের। আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম যে এই সম্পর্কটা কোন একটা অদ্ভুৎ কারনে কখনোই পরিনয়ের দিকে যাবে না। দুজনেই ভালবাসি দুজনকে, তারপরেও কোথায় যেন কিসের বাধা। সেই শেষ দেখা, শেষ কথা - দশ বছর হয়ে গেল।
এইবার বগুড়ায় গিয়েছিলাম ঈদ করতে। রাস্তায় বাইক চালাচ্ছিলাম - হঠাৎ তার মায়ের সাথে দেখা রাস্তায়। আমি সালাম দিতে উনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন আমার এই ভবঘুরে চেহারা দেখে। বললেন অনামিকার একটা মেয়ে হয়েছে। এইবার ভর্তি হয়েছে কোন একটা ইংলিশ মিডিয়ামে। স্বামী চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট।
ফেরার সময় পুরোনো দিনের কথা গুলো মনে পড়ে গেল আবার। অনেক জোরে বাইক চালাচ্ছিলাম রাস্তায়, কোন গন্তব্য নেই কোথাও - রাস্তা একদম ফাকা। আর আমার মাথার ভেতরে বাজছিল ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস
ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আই অ্যাম অন, ইউ উইল নো দ্যাট আই অ্যাম গন
ইউ ক্যান হিয়ার দ্য হুইসেল ব্লো, আ হান্ড্রেড মাইলস।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০০৯ রাত ১১:৪৬