সরগরম কফিশপের কোণার দিকের টেবিলে একা বসে আছে রণ। গরম কফির ধোঁয়া উড়ছে সামনে রাখা কাপ থেকে। ধোঁয়াশা ঘেরা এক অসস্তি ভর করেছে তার জীবনের এই সময়গুলোতে। অর্ণার আসার কথা এখানে, সেই সাথে সাজুরও। পারিবারিক দায়বদ্ধতা রণকে বাধ্য করেছে অর্ণাকে ফিঁয়াসে করতে। সদ্য অর্ণার সাথে বাকদান হয়েছে তার।রণ জানে নিতান্তই পারিবারিক ইচ্ছাতে এ বিয়েতে অর্ণার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এত বড় অঘটনের কথা সমী কে জানাতেও পারছেনা রণ। এতদিনের সম্পর্কে রণএর মিস্টার রণ রণ হয়ে ওঠার পেছনে সমীর যে অবদান, সেখানেও দায়বদ্ধ সে। বন্দী এক মধুর সম্পর্কে। ঠিক কোন দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সেকারনেই সব সমস্যায় পাশে থাকা বন্ধু সাজুকে আসতে বলা। উদ্দেশ্য দুই বন্ধু মিলে অর্ণাকে বুঝিয়ে বলবে। কেননা শুধুমাত্র অর্ণার ইচ্ছেতেই বিয়েটা ভাঙা সম্ভব, সেই সাথে মজবুত একটি সম্পর্কের ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া। অর্ণা এসে বসেছে রণর সামনে। সাজুর দেরী দেখে শুরুটা রণই করে। অর্ণা মনমরা হয় পাকা কথার পর বিয়ে ভাঙা গ্লানির আতঙ্কে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টায় রণ কথা ঘোরায় অন্য দিকে।
ঘটনা পেছনে চলে যায় রণর স্মৃতিচারণে, অর্ণার কাছে দৃশ্যমান হতে থাকে রণর শিক্ষাজীবন। গল্পের নায়ক হয়ে ওঠে সাজু। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনের শত্রু সাজুই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে রণর ঘনিষ্ট বন্ধু। পিতৃহীন পরিবারে রণ অসচ্ছল চাকরীজিবী বড়ভাইয়ের অর্থে উচ্চশিক্ষায় অভাবী জীবন যাপন করে, পাশে পায় সাজুকে। এরই মাঝে নাটকীয় ভাবে রণর চোখে ধরা দেয় সমী। উদ্ভুত সাময়িক বিপদে সাজুর কারসাজিতে রেহাই পায় রণ। সমী যেখানে সাজুর পূর্ব পরিচিত সেখানে সাজুকে ধরে যোগাযোগ স্থাপনই রণর কাছে মোক্ষম হয়ে পড়ে। ফলত সমীর সাথে ভালাবাসাবাসিও সাজুর দৌরাত্বেই। যেহেতু সাজু কথা দিয়েছিলো বন্ধু হয়ে রণর বিপদে থাকবে সেকারনেই হয়তোবা সমীর সাথে কথা বলা, ঝগড়া মেটানো কিংবা গিফ্ট দেয়া সকল ছোটোখাটো সমস্যায়ও রনকে টিপস দিতো সাজু। খুবই সাধারন উপায়ে অসাধারন ফল পেতো রণ। যদিও প্রায় প্রতিটি পরামর্শকেই প্রথম দিকে পাত্তা দেয়ার কোন কারনই খুজেঁ পেতনা রণ। কিন্তু সাজুর উপর ভরসা পেত এই ভেবে যে, সে প্রতিটা পরামর্শই তার প্রেম জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেয়। সাজুর প্রেমিকাকে নিয়ে হাজারো প্রশংসা রণকে রীতিমত বিরক্ত করতো মাঝে মাঝে। কখনওবা রণ সমীর সাথে ঘুরতে গেলে সর্বদা হাস্যজ্বল সাজুকেও সাথে নিতে চায়তো, কিন্তু সেটা কখনই হয়ে ওঠেনি। কেননা ওই দিনগুলোতেই সাজু তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরতে যাবার কথা বলে রণর প্রস্তাব এড়িয়ে যেত। মাঝে মাঝে রণর সামনে ফোনে মেয়েটির সাথে ঝগড়া হতো সাজুর। অথবা কখনো সাজুর মন খারাপ থাকলে মেয়েটির সাথে কোথায় যেন দেখা করতে যেত সে। অথচ একটি বারও রণর সাথে সেই মেয়েটির পরিচয় করে দেবার সুযোগ হয়নি কবি সাজুর।
বেশ ভালোভাবেই কাটছিলো সমী-রণের দিন। রণও ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে সাজু থেকে। হঠাৎ একদিন সমীর সাথে ভয়াবহ বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে রণকে একা রেখে উঠে যায় সমী। সম্পর্কের ইতি দাবী করে সে। এমন পরিস্থিতিতে আবারো সাজুর স্মরণাপন্ন হয় রণ। ঘটনার জাল বিস্তৃত হয়। সেদিন রণকে সময় দিতে নারাজ সাজু। নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে শহরের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার দোহাই দিয়ে কেটে দেয় সেল ফোনের সংযোগ। সমীকে হারানোর ভয়ে আর বন্ধু শূন্যতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্যহীন চলতে থাকা পা জোড়া হঠাৎ থমকে যায়। পরিচিত একটি মানুষকে আবিস্কার করে অদুরে, যে কিনা মিথ্যা কথা বলেছে। দুর থেকে খেয়াল কর এই শহরের জনাকীর্ণ বিকেলের মাঠে বসে আছে সাজু। বাইরে কোথাও যায়নি। মানুষের ভীড়ে বোঝা যাচ্ছেনা কে আছে তার পাশে বা আদৌ কেই আছে কি না। রণ কাছে গিয়ে নিরিবিলি দিগন্তে তাকিয়ে থাকা একা সাজুকেই পায়। মেয়েটি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সাজু রণকে জড়িয়ে ধরে। কান্না জড়ানো কন্ঠে স্বীকার করে মিথ্যে বলার কথা,কোনো মেয়ে আজো তাকে ভালোবাসি বলেনি। সেই কষ্ট ঢাকতেই তার মিথ্যে বলা। কিন্তু সাজু পছন্দ করতো একজনকে।
অর্ণার মনে প্রশ্ন জাগে সমীকে নিয়ে। রণ জানিয়ে দেয় সাজুই তাকে ফিরিয়ে এনেছিলো রণর কাছে। আর সাজু ঠিক কাকে পছন্দ করতো বলেনি সেদিন।
এর মাঝে গ্রাজুয়েশন শেষ হলো তাদের। বাড়ি থেকে চাকরী করতে তাগাদা দেয়া শুরু করলো রণর বড় ভাবি। কিন্তু হুট করে কোথায় কি করবে বুঝতে পারছিলোনা রণ।সমীর বাবার ফার্মে জয়েন করার ব্যবস্থা হলো শেষ পর্যন্ত, সমীর রেফারেন্সেই। হঠাৎ করে রোড এক্সিডেন্ট হলো সাজুর। মৃত্য ভয়ে ভীত সাজু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রণকে তার পছন্দের মেয়েটির কথা আনমনে বলতে থাকে । তার ভাষ্যমতে- কোথাও যাওয়ার পথে মেয়েটিকে দেখেছিলো, সে মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করতো নিয়মিত কিন্তু মেয়েটি কখনও করেনি। সাজুর একটি পা নষ্ট হলেও বেঁচে ওঠে সে। এদিকে এমুহুর্তে সাজুর কবিতার বই ছাপতে ব্যস্ত অনন্যা ।
অনেক্ষন নিজের গল্প বলে একটু থামে রণ। কথা বলার সুযোগ পায় অর্ণা। সে ভেবেই এসেছিলো তার পছন্দের কথা রণর সাথে শেয়ার করবে যাতে বিয়ের পরে কোন ঝামেলা না হয়। অর্ণার কাছে প্রায়ই একটা সাহিত্যে ভরা বেনামী চিঠি আসতো। তার চিঠির ভাষাগুলোয় ছিলো অর্ণার প্রেম।
কথা শেষ না হতেই ক্র্যাচ নিয়ে সাজু এসে অর্ণার পেছনে দাড়ায়। আবীর অর্ণাকে সাজুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। স্থির চোখে দাড়িয়ে থাকে সাজু। অর্ণা নিজের নাম বলতেই থামিয়ে দেয় সাজু তারপর বলতে থাকে – বাইশের বি (৩য় তলা), বনানী, ঢাকা ১২০৮। সাজুর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ট্রেইনের সামনা সামনি সিটে অর্ণা এবং সাজু। পত্রিকা পড়ার ফাঁকে অর্ণাকে দেখছে সে। অর্ণা ফোনে তার বান্ধবীকে দুইটা বই কুরিয়ার করতে বলে এই ঠিকানায়- অর্ণা জামান, বাইশের বি(৩য় তলা),বনানী, ঢাকা ১২০৮।
সমী-রণ এর সমীকরণ মেলাতে, মিলে যায় অর্ণা ও সাজুর হিসাব্ নিকাশ।
[email protected]¨vjq|
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৩:৫২