সায়েন্স ফিকশন গল্প নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই। বাংলা সায়েন্স ফিকশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল , তাতে শুধু ফিকশন থাকে, আর এলোমেলোভাবে কিছু সায়েন্টিফিক টার্ম থাকে, কিন্তু মূল সায়েন্সের কিছুই থাকেনা। এই অভিযোগটার সত্য-মিথ্যা নিরূপণে আমার তেমন কোন আগ্রহ সেই, তবে অভিযোগগুলো মাথায় রেখে সায়েন্স ফিকশন সম্পর্কে উইকিতে একটু নেড়েচেড়ে দেখলাম। তথ্য যা পেলাম, এখন আমারই নতুন করে কিছু অভিযোগের তালিকা তৈরি করতে মন চাইছে। মূল সমস্যা হল, সায়েন্স ফিকশন বলতে আদতে কী বোঝায় এ নিয়ে লেখকেরাই বিভ্রান্ত। http://en.wikipedia.org/wiki/Science_fiction
যাইহোক, এখানে ধান ভানা হচ্ছেনা, শিববাবুরও অর্চনা চলছেনা, কথা হচ্ছে লেখক মুহম্মদ জায়েদুল আলমের প্রথম প্রকাশিত বই গ্রহচারী প্রসঙ্গে। লেখকের আত্মস্বীকৃতি অনুসারে, অন্তত মলাটে নামের উপরে লেখা দেখে যা বুঝেছি তা হল, এটা একটা সায়েন্স ফিকশন গল্প সংকলন। সংকলন যেহেতু, তার মানে এখানে একটি-দুটি বা সাতটি নয়, অনেকগুলো গল্প আছে। আমার গণনায় ভুল না হলে গল্পের সংখ্যা ১৬ টি। এতগুলো গল্প নিয়ে বলতে হলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবার ঝুঁকি আছে। হলে হোক, তার আগে আরও কিছু বিষযে কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সায়েন্স ফিকশন মানেই 'জাফর ইকবাল ম্যাজিক' ধরে নেয়া হয়। ৯০ এর দশকে হয়ত এটা ম্যাজিকই ছিল, কিন্তু ২০১০ এ এসে ঐ একই ম্যাজিক গুলে খাওয়ানোর অপচেষ্টা দেখলে তখন আর সেটা ম্যাজিক থাকেনা, ম্যানিয়াক হয়ে যায়। ফিকশনে নতুনত্ব আসবে, কনটেন্ট আপডেটেড হবে, কিন্তু কিছুই নেই; এখনো সেই রোবট, কম্পিউটার, কপোট্রন, এলিয়েনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমাদের জাফর ইকবাল প্রভাবিত সায়েন্স ফিকশনগুলো। এর উত্তোরণের জন্য প্রয়োজন নতুন কিছু লেখক, যারা নতুনত্ব নিয়ে আসতে পারবেন, নিজেরা একটা ধারা তৈরি করতে পারবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই তরুণটি কি জায়েদুল আলম হতে পারেন বা পেরেছেন? অবশ্যই বিশ্বাস করি পারেন, কিন্তু পেরেছেন কিনা, সেই মতামতটা একটু পরে দিচ্ছি। একটু বই ঘুরে দেখা যেতে পারে :
১৬ টি গল্পকে আমি দল-উপদলে বিভাজন করবো:
প্রথম দল : ১.কিউপিড ২.অপসভ্যতা ৩.ঈশ্বর ৪.স্মৃতির জাদুঘর
২য় দল :৫.স্বার্থপর ৬.আমি NC-446:552 ৭.ভুল সময় ৮.বংশধর ৯. স্বর্গ
৩য় দল : ১০.গ্রহচারী ১১.দূত ১২.প্রজেক্ট অতিমানব ১৩.ফরম্যাট ১৪.আহাম্মক ১৫. জিনেটিক ভালবাসা ১৬. প্রশ্ন।।।
গল্পগুলোকে ক্রমানুসারে সাজানো হয়নি। বিভাজনটা করা হয়েছে গল্পের বিষয়বস্ত এবঙ গল্পের অভিনবত্ব অনুসারে। তবুও ১০ নম্বর গল্পটা দিয়েই শুরু করি, কারণ এর নামানুসারেই বইয়ের নাম রাখা হয়েছে। গ্রহচারী নামটিই মারাত্মকভাবে জাফর ইকবাল প্রভাবিত। বইয়ের নামটা দেখে সর্বপ্রথমেই জাফর ইকবালের 'নিঃসঙ্গ গ্রহচারী' বইটার নাম মনে পড়ে যায়। একজন লেখকের শুরুতেই এভাবে অন্য নামের আড়ালে চলে যাওয়াটা আমার ঋণাত্মক মনে হয়। গল্পটাতেও তেমন বিশেষত্ব কিছু পাওয়া যায়না। একজন মহাকাশ জীববিজ্ঞানীর গল্প। যে একটা মিশনে কোন গ্রহে গিয়েছিল, এরপর ঘটনার পরিক্রমায় তাকে গ্রহেই রেখে আসা হয়। প্লট হিসেবে অতিসরল এবং বহুলচর্চিত। কিন্তু যে গল্পটা চমকে দিয়েছে তার নাম কিউপিড।
এখানে বর্তমান সময়ের মেসেঞ্জার-চ্যাট পাওয়া যায়, খালিচোখে কোন সায়েন্স ফিকশন বা সায়েন্স দেখিনা। কিন্তু গল্পের শেষ এসে মূল সায়েন্সটা পাওয়া যায়। সায়েন্সটা প্রেডিক্টেবল ছিল, কিন্তু মেকানিজমটা মোটেই প্রেডিক্টেবল ছিলনা। তাই এই গল্পটাই লেখকের চিন্তার ডাইমেনশন বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। লেখক গল্পটার শেষে একটা ফুটনোট দিয়েছেন কিউপিড সম্পর্কে : রোমান পুরাণে ভালবাসার দেবতার নাম কিউপিড। কিউপিডকে রোমান দেবতা মার্স এবং দেবী ভেনাসের সন্তান ধরা হয়।
অপসভ্যতা গল্পটায় সেই বুদ্ধিমান প্রাণী-মানুষ বিষয়ক দ্বন্দ হলেও, এর প্রকাশটা এসেছে মুদ্রার উল্টো পিঠ হিসেবে। সাধারণত গল্পে রোবট মানুষকে বিতাড়িত করে, মানুষের জায়গা নেয়। এই গল্পে রোবট, মানুষ দুইই আছে , বিতাড়িত হচ্ছে তৃতীয় কোন প্রজাতি। সময়কালটাকে পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকালও ধরতে পারি। গল্পের শেষ লাইনটাই পুরো গল্পটার গতিপথ আবার নতুন দিক থেকে দেখতে বাধ্য করে : বেশ কিছুক্ষণ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে কিছু গবেষণা রোবটকে নামিয়ে দিয়ে মহাকাশ যানটি চলে গেল।
মহাকাশ যান থেকে নেমে আসা প্রাণীগুলো ছিল একদল মানুষ।
ঈশ্বর গল্পের প্লট রোবট-মানুষের চিরন্তন টানাটানিই। শুরুতে রোবট মানুষকে ফায়ারিঙ স্কোয়াডে নেয়, কিন্তু মানুষকে তার ঈশ্বর বাঁচিয়ে দেয়। এরপর মানুষ রোবটকে ফায়ারিঙ স্কোয়াডে নেয়। রোবট দেখে তার ঈশ্বর তাকে রক্ষা করছেনা, কিভাবে করবে, কারণ তার ঈশ্বর যে মানুষই। এমনিতে গল্পে মোহিত হবার মত উপাদান খুব পাওয়া যাবেনা, তবে বোধটা সুন্দর বলে ভাবায়।
স্মৃতির জাদুঘর গল্পের প্লটটা অদ্ভুত এবং অভিনব। এমন একটা জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের স্মৃতির ম্যাপিং করা হয়েছে তাদের মৃত্যুর সময়। ফলে ঐ জাদুঘরে গেলে আমরা খূব সহজেই ঐসব মানুষদের জীবদ্দশার সবকিছু জানতে পারবো। এতে দেখা গেল, আমরা যাদেরকে আদর্শ ভাবি, তাদের চিন্তা-ভাবনা-জীবনকালটাও কত নোঙরা। যে কারণে দেখা গেল সেই জাদুঘরটিকে নিজেদের স্বার্থেই ধ্বঙম করে দেয়া হল। এধরনের প্লটের জন্য লেখককে অভিনন্দন না জানালে অভদ্রতা হয়।
২য় দলে যে গল্পগুলোকে ফেলা হয়েছে এই গল্পগুলোর প্রতিটির থিম ও প্লট অভিনব, কিন্তু উপস্থাপনের দূর্বলতায় এগুলোর কোন কোনটি ম্লান হয়ে গেছে।
যেমন, স্বার্থপর গল্পটায় শুরুতে বিজ্ঞানী তার স্ত্রীর স্মুতিটাকে অন্য একটি রোবটের মধ্যে সঞ্চারিত করে রোবটের মধ্যে হলেও স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখে। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়। কিন্তু রোবটের তো মৃত্যু নেই। তাই বছরের পর বছর ধরে রোবটটা মৃত বিজ্ঞানীর কবরে ফুল দিয়ে যায়। রোবটের মনে হয়, মানুষটা শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, এরপর তার তার কথা না ভেবেই আবার মারা গেল। মাঝখান থেকে তাকে দিয়ে প্রতিদিন একই কাজ করিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বড্ড স্বার্থপর। বোধটা ভাল, কিন্তু গল্পের গড়ে উঠা, আর লজিকগুলোর প্রতি অযত্নের কাণে অনেককিছু আরোপিত মনে হয়েছে। তাই ভীষণ সম্ভাবনায় গল্পের ২য় সারিতে স্থান হয়েছে।
আমি NC-446:552। আমার মতে এই গল্পটার নামেই বইয়ের শিরোনাম হওয়া উচিৎ ছিল। নামটায় একটা ঘোর পাই। গল্পের বেড়ে উঠা আর স্টাইলটাও আলাদাভাবে নজরে পড়বার মত। একটি রোবট তার দিনলিপি লেখার স্টাইলে কথা বলে যাচ্ছে অজানা কারো উদ্দেশে, তাকেই নিজের জীবনের গল্প শোনাচ্ছে। সে একটা খুনের সাক্ষী, যে খুনে খুনীকে দোষী বলা চলেনা, কারণ সে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ভুলবমথ খুন করে ফেলেছে। কিন্তু তবুও তো সে-ই খুনী। রোবটের মিথ্যা বলা ক্ষমতা নেই, তাই তাকে খুনীটির বিরুদ্ধেই বলতে হবে। এই সঙ্কট থেকে বাঁচতে রোবটটা নিজের স্মৃতিকে নষ্ট করে দিয়ে আত্মত্যাগ করে। ৩-৪টি আলাদা গল্পকে একত্রিত করে একটা গল্প বানানো হলেও গল্পের বক্তব্য ভাল লেগেছে। যদিও এখানেও সায়েন্স শুধু সায়েন্টিফিক টার্মগুলোর মধ্রেই সীমাবদ্ধ।
স্বর্গ আর বংশধর মূলত একই প্যাটার্নের গল্প। বক্তব্যের হেরফের খুব সামন্যই। দুটোতেই একটা রিপিটেশন লুপের মধ্যে ঘটনাকে ফেলে গল্পকে এগিয়ে নেয়া হয়েছে। সেই নিরিখে বশধর গল্পটাকে অপরিপক্ক লেগেছে। সে তুলনায় স্বর্গ অনেক পরিপক্ক।
ভুল সময় একটা চমৎকার গল্প। এটা প্রথম দলে না থাকার একমাত্র কারণ বর্ণনাভঙ্গি। বর্ণনাভঙ্গি প্রবলভাবে প্রভাবিত আরেকজনের। নয়তো এই গল্পের প্লটটা চিন্তা করলে আনমনেই হাসি চলে আসবে। ভাবুন একবার, একদিন দুপুরে দেখলেন হিটলার আপনার রুমে এসে বসে রয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের সময় তার পরাজয়ের খবর জানতে পেরে হিটলার টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যত পৃথিবী দেখতে এসেছে। তাকে হারিয়ে দিয়ে কী লাভ হল সেটাই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু দেখা গেল, একনায়ক এখনো রয়ে গেছে, যার নাম আমেরিকা। তখন সে প্রশ্ন করে, তাহলে আর আমাকে হারিয়ে লাভ কী হল? সে আরও সুদূর কোন ভবিষ্যতে রওয়ানা হয়, যেখআনে একনায়ক নেই। বর্ণনাভঙ্গির গুণে এই গল্পটা আরও পরিপুষ্ট হওয়ার দাবি রাখে।
৩য় দলের গল্পগুলোকে দুর্বল মনে হয়েছে, বা প্লট ধার করা লেগেছে, যেখানে লেখকের তেমন কোন মুন্সিয়ানা দেখা যায়না। এর মধ্যে ফরম্যাট আর জিনেটিক ভালবাসা মূলত কিউপিড এরই যথাক্রমে মামাত ও খালাত ভাই। তাই প্লটের পুনরাবৃত্তি বৈচিত্র্য কমিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে প্রজেক্ট অতিমানব আর আহাম্মক পড়ার জন্য ভাল হলেও বড্ড বেশি প্রেডিক্টেবল। মোটামুটি শুরুর কয়েক লাইন পড়েই পুরোটা ধরে ফেলা যায়, যেটা লেখকের মননশীলতার সাথে মেলেনা।
বাকি রইল প্রশ্ন। এটাকে আমার ঠিক গল্প মনে হযনি। একটু ব্যতিক্রমধর্মী বইয়ের ফ্ল্যাপ মনে হযেছে। এই গল্পটা সঙ্কলনে না আসলেই বোধহয় গল্পের ভারসাম্যটা সংহত হত।
.............এই হচ্ছে গ্রহচারী।
প্রথম যে কোনকিছুতেই অনভিজ্ঞতার চিহ্ন পদে পদে থাকবেই। এই বইয়ের গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। অধিকাংশ গল্পই ১-২ পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ হয়ে গেছে, সম্ভবত ব্লগের কথা মাথায় রেখে লেখার পরিণতি এটা। এতে করে বেশ কিছু গল্পই শরীর-স্বাস্থ্যে অপুষ্টির শিকার। গল্পের সংখ্যা কমিয়ে অল্পকিছু গল্প বেছে সেগুলোকেই আরও পুনঃপুনঃ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তোলা উচিৎ ছিল যেটা বই পড়ে মনে হয়েছে। আর বর্ণনাভঙ্গির ব্যাপারটা আসবেই। এই ভঙ্গিটা বেশিমাত্রায় প্রভাবিত। লেখকের নিজস্ব একটা স্টাইল নিয়ে ভাবার সময় চলে এসেছে বোধহয়। আরো একটা প্রসঙ্গ হল, স্থান এবং নাম। অধিকাংশ বাংলা সায়েন্স ফিকশনের মত এখানেও এ দুটো ব্যাপার উপেক্ষিত রয়ে গেছে। চরিত্রের নামগুলো ক্রি, কিলিন, নিয়ন...এমন নামগুলো পড়লে ভিজুয়ালাইজ সমস্যা হয়। অন্তত পরিচিত নাম দিয়ে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। তাতে গল্পের দৃশ্যচিত্রগুলো আরও শক্তিশালী হবে বলেই বিশ্বাস করি।
.... আশা করছি এই লেখকের সূত্র ধরেই নতুন ঘরানার সায়েন্স ফিকশন পাব। ২০১০ এ এসে এখনো ১৯৯০ এর কঙ্কাল বয়ে বেড়াবোনা।।।
প্রথম দলের গল্প ৪টির জন্য লেখককে ধন্যবাদ না দিলে অন্যায় হবে।।।
............................................................................
মুহম্মদ জায়েদুল আলম নিজেও ব্লগার। তিনি স্বনামেই ব্লগিং করেন।।।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:২৬