বিপিএল টি২০ টুর্নামেন্ট আয়োজনে জাতীয় সংসদ থেকে অনুমতি পাবার পর থেকেই আলোচনার বিষয় বস্ত্ততে রূপ নিয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে দেশীয় ক্রিকেটের উন্নয়ন কতটুকু হবে, সেটাই বিবেচনায় আনা হয়নি। অন্যদিকে গেম অন টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই নিয়ে গেছে ১০৮ কোটি টাকা।
তবে বিসিবি শুরু থেকেই বলে আসছে বিপিএল একটি ব্যবসায়িক টুর্নামেন্ট। এ থেকে বিসিবি ফান্ড বাড়াবে। সংসদের অনুমতি পেয়েই বিপিএলের প্রথম আসর আয়োজন করতে একটি কোম্পানীর খোঁজে বিপিএলে গভর্নিং কাউন্সিল আন্তর্জাতিক টেন্ডার ঘোষণা করে। ৩টি কোম্পানির মধ্যে ভারতীয় গেম অনকে বিপিএল বেছে নেয় ৬ বছরের চুক্তিতে সাড়ে শত কোটি টাকার বিনিময়ে।
এই চুক্তির পর বিপিএলের গভনিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেছিলেন,‘বিপিএল ক্রিকেটের উন্নয়নে অর্থ আয় করছে।’
বিপিএল মাঠে গড়াতে আর মাত্র ৯ দিন বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিপিএল আয়োজন স্বত্ব নিয়ে। বিপিএলের বক্তব্য অনুয়ায়ী ক্রিকেট বোর্ড উন্নয়নের জন্য টাকা আয় করছে।
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ৬ বছরের জন্য বিপিএলের আয়োজন স্বত্ব কিনে নেয়া ভারতীয় কোম্পানী গেম অন প্রতি বছরের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে দিচ্ছে ৫৯ কোটি টাকা প্রায়।
বিপিএলের সঙ্গে গেম অনের চুক্তি অনুয়ায়ী গেম অন এই টুর্নামেন্ট থেকে ব্যয় করেই অর্থ আয় করবে। এই প্রশ্নটি আজ উঠত না, কারণ আয় করবে বিদেশী কোম্পানী গেম অন। বাংলাদেশী কোন কোম্পানি নয়!
এরই মধ্যে ১ বছরের ব্যয় হিসাবে ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ের উল্টো দিকে গেম অনে টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ১ শত ৮ কোটি টাকা আয় করে ফেলেছে।
আর এই কারণেই অর্থ মন্ত্রনায়লের টনক নড়ে উঠেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী বিপিএলের ৬টি দল থেকে ৫৪ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার আয় করেছে গেম অন।
এই নিলামের আগে ৯টি কোম্পানীর কাছে টেন্ডার ফর্মের জন্য গেম অন ৫ হাজার ডলার করে আয় করেছে। হিসাব করলে বাংলাদেশী টাকায় দাঁড়ায় ৩৮ লাখ ২৫ হাজার। এরপর ২৮ জানুয়ারি টাইটেল স্পন্সরশিপের জন্য ডেসটিনি গ্রুপ থেকে পেয়েছে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সিহাব ট্রেডিং থেকে টিকিট বিক্রির স্বত্ত্বর জন্য পেয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। গেম অনের আয়োজন স্বত্ত্বের জন্য ব্যয়-৬ বছরেন জন্য সাড়ে ৩ শত কোটি টাকা। বছর প্রতি প্রায় ৫৯ কোটি টাকার উপরে।
তাহলে হিসাব অনুযায়ী গেম অন ইতিমধ্যেই ১ শত ৮ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিজেদের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা করে ফেলেছে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে বিপিএল টি২০ ক্রিকেটের ফান্ডের জন্য আয় করছে না দেশীয় মুদ্রা বিদেশে চলে যেতে সাহায্য করছে? বিপিএল তো আয় করছে ঠিক। কিন্তু জাতীয় অর্থ যে দেশ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে! এটা নিয়ে তো বিপিএলের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আজ যদি দেশীয় কোনো কোম্পানি আয়োজন স্বত্ব ক্রয় করতে, তাহলে আয় ব্যয় যাই হউক আর স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতি যতোটুকুই হউক না কেন দেশের অর্থ দেশেই থাকত। আজ ক্রিকেট উন্নয়নের নামে দেশের অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে! তাহলে আমাদের আয় হল কি করে? হিসাব অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে লোকসান ছাড়া কিছুই নয়।
ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ক্রিকেট কী টাকা আয় করার জন্য না মাঠে খেলার জন্য! কোনটা আগে? একটা সময় গেছে আমরা যখন সংগঠক হিসাবে কাজ করতাম তখন ফুটবল থেকে টাকা নিয়ে ক্রিকেটারদের লাঞ্চ করাতাম। সেখান থেকে ক্রিকেট আজ কোথায় পৌঁচ্ছে গেছে।”
তিনি বলেন, “সীমাহীন টাকার চাহিদা হলে তো খেলার উন্নতি হবে না। উন্নয়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি মাঠে খেলা চালিয়ে রাখলে এমনিতেই টাকা আসবে। এখানে উল্টো কাজ করা হচ্ছে। টাকার প্রতি দৌড়ঝাঁপ দেয়া হচ্ছে, খেলাকে পেছনে ফেলে দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন “বিপিএলের সঙ্গে গেম অন চুক্তি করেই টাকা নিচ্ছে। টাকা নিতেইতো গেম অন বাংলাদেশে এসেছে। তবে গেম অন তো একা বিপিএল থেকে টাকা নিচ্ছে না, আমাদের কয়েক কর্মকর্তাও এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।”
তিনি দাবি করেন “বিপিএল দিয়ে জাতীয় ক্ষতি হচ্ছে। তবে আমি মনে করি জাতীয় ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটেরও ক্ষতি হচ্ছে। ভারতে কী হল! আইপিএল দিয়ে ভারত আজ কোথা থেকে কোথায় নেমে গেছে। কতোটা নিচে নেমেছে ভারত! হোয়াইটওয়াশ হয়েছে! সেখানে বাংলাদেশের অবস্থাটা কী হবে?”
তিনি বিষয়টির ব্যাখা দিয়ে বলেন “ছোট ছোট ছেলেগুলো যদি এতো অল্প বয়সে কোটি কোটি টাকা পায় সে তো খেলার কথা ভুলে টাকার পেছনে দৌঁড়াবে। এই টাকা আয়ের জন্য বিপিএলের নামে ক্রিকেটাঙ্গনের কিছু লোক এদের তোয়াজ করবে। আজ ভারতের ক্রিকেটে কি পরিমাণ ধস নেমেছে! একবার কী আমরা ভেবে দেখেছি? তাছাড়া আমরা তো ভারতের মতো অবস্থানে পৌঁচ্ছাতে পারিনি।
আমরা তো নিজেদের মাঠেই ফলাফল ভাল করতে পারছি না। ওডিআই বা টেস্টে খেলতেই পারছি না। তাছাড়া বিদেশে টেস্ট খেলতে যাবার প্লাটফর্ম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে বিসিবি। সেখানে বিপিএলের নামে হাডুডু খেলার মতো একটা টুর্নামেন্ট খেলে কি লাভটা পাবে বাংলাদেশ? আমি তো মনে করি বিপিএল এদেশের ক্রিকেটকে শেষ করে দেয়ার একটি প্লাটফর্ম।”
তিনি বলেন “পুরো দেশ যখন বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কষ্ট করছে, সেখানে বিদেশী ক্রিকেটারদের জন্য বৈদেশী মুদ্রা বাইরে পাঠাতে হবে। তাছাড়া অর্থ কিন্তু কম নয়। বিপিএল আয়োজন করতে লাখ লাখ ডলার বাইরে পাঠাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএলকে কী করে অনুমতি দেয় সেটাই দেখার বিষয়। আর দেশের এই করুণ অবস্থায় বিপিএল কে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমতি না দেয় তাহলে তো লাখ লাখ ডলার হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে যাবে। দেশের বর্তমান অবস্থায় বিপিএল ক্রিকেটের যেমন ক্ষতির কারণ হবে তেমনি অর্থনৈতিক অস্থিরতাও তৈরি করবে।