আমাদের বন্ধুরূপী ভারত
প্রকৃতপক্ষে কখনোই
আমাদের বন্ধু ছিল না,
এখনো নেই। ইতিহাস
সাক্ষী যে, ভারতের
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সব
সময়ই বিশাল ও বিস্তৃত
এলাকা জুড়ে অখণ্ড
ভারতের স্বপ্ন
দেখেছে এবং বর্তমান
বাংলাদেশকে তার অংশ
হিসেবেই
তারা বিবেচনা করেছে। ১৯৪৭
এর পূর্বের এ অঞ্চলের
ইতিহাস থেকে ভারতের
নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও
আচরণ দেখে তা স্পষ্টত:ই
প্রতীয়মান হয়। নিচে মুসলিম
বিদ্বেষ ভারতের নেতৃবৃন্দের
কিছু বক্তব্য পাঠকদের
জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি।
আরিফুল হক লিখিত
“হায়দারাবাদ ট্রাজেডী ও
আজকের বাংলাদেশ” বই
থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য
উদ্ধৃতি
*পণ্ডিত নেহেরু স্বপ্ন
দেখতেন প্রশান্ত মহাসাগর
থেকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য
পর্যন্ত সমস্ত
এলাকা একদিন ভারতের
একচ্ছত্র
দখলে চলে আসবে (আরিফুল
হক; “হায়দারাবাদ
ট্রাজেডী ও আজকের
বাংলাদেশ”; ভূমিকা,
পৃষ্ঠা-৭)
*রবার্ট বায়রণ তাঁর
‘দি স্ট্রেটসম্যান অব
ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“বাল গঙ্গাধর তিলক
বলেছেন, এই উপমহাদেশের
মুসলমান অধিবাসীরা হল
বিদেশী দখলদার, কাজেই
তাদের শারীরিকভাবেই
নির্মূল করতে হবে।”
কংগ্রেস সভাপতি আচর্য্য
কৃপালনী বলেছিলেন,
“কংগ্রেস অথবা সমগ্র
ভারতীয় জাতি কখনই
অখণ্ড ভারতের
দাবী পরিত্যাগ করবে না।”
ভারতের প্রথম উপ-
প্রধানমন্ত্র ী সর্দার
বল্লভ ভাই বলতেন, “আজ
হোক কাল হোক
আমরা আবার এক হব
এবং বৃহৎ ভারতের
প্রতি আনুগত্য দেখাব।”
গান্ধী ও অন্যান্য হিন্দু
নেতা সম্পর্কে কায়েদে আযম
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্
বলেছিলেন, “গ্রেট ব্রিটেন
ভারত শাসন করতে চায়।” মি.
গান্ধী ও তার কংগ্রেস,
মুসলমানদের শাসন
করতে চায়।
আমরা বলি ব্রিটিশ
অথবা মি.
গান্ধীকে মুসলমানদের উপর
শাসন করতে দেব না।”
চরিত্রগত ভাবেই ভারত তার
আশপাশের কোন জাতির
অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
১৯৪৭ সালের ৫ এপ্রিল
হিন্দু মহাসভার
উদ্যোগে তারকেশ্বরে বঙ্গীয়
প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে,
সর্বভারতীয় হিন্দু
নেতা সাভারকর এক
বাণীতে বলেছিলেন,
“প্রথমতঃ পশ্চিমবঙ্গে একটা হিন্দু
প্রদেশ গঠন করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ যে কোন
মূল্যে আসাম থেকে মুসলিম
(অনধিকার প্রবেশকারীদের)
বিতাড়ন করে, এই দুটি হিন্দু
প্রদেশের মাঝে ফেলে পূর্ব
পাকিস্তানকে পিষে মারতে হবে।”
সেই হিন্দু মহাসভার
অঙ্গদল বিজেপি এখন
ভারতের ক্ষমতার শিখরে।
তারা ১৯৪৭ সালে মুসলিম
প্রধান বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত
করে হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ গঠন
করেছে। ১৯৪৭ থেকে ’৮৫-
এর মধ্যে আসাম
থেকে মুসলমান বিতড়ন
প্রক্রিয়াও শেষ করেছে।
পূর্ব পাকিস্তান নামটিও
মুছে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
এখন
পিষে ফেলতে বাকী রয়ে গেছে বাংলাদেশ।
তারই
প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে ভারত।
এই সময় হায়দারাবাদের
দৃষ্টান্ত আমাদের সতর্ক
হওয়ার সুযোগ
করে দেবে বলে বিশ্বাস করি।
(অধ্যায় ঃ ভূমিকা, পৃষ্ঠা-৭,
৮)
*অর্থাৎ
সার্বিকভাবে বিচার
করলে ভারতকে একটি শান্তিপ্রিয়
বন্ধুবৎসল, হিতৈষী সৎ
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভাবার
কোন কারণ নেই। ভারত তার
আচরণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর
সাথে ভাল আচরণ কখনও
করেনি। বরং সততই
আধিপত্য বিস্তারের
চেষ্টা করেছে।
(অধ্যায় ঃ আজকের
বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৪৮)
* যে কারণে চীনের সাথে তার
সম্পর্ক সুস্থ নয়, বিশ্বের
প্রাচীনতম হিন্দু রাষ্ট্র
হয়েও নেপাল নিরাপদ
মনে করছে না নিজেকে,
ভুটানকে পায়ের
তলে দাবিয়ে রেখেছে।
পাকিস্তানের সাথে তিনবার
প্রত্যক্ষ যুদ্ধসহ
প্রতিনিয়ত
গোলাগুলি বিনিময় হচ্ছে,
শ্রীলংকার
পরিস্থিতি সদা উত্তপ্ত।
এরকম
একটা পরিস্থিতিতে ১৯৭১
সালে পাকিস্তান
ভেঙ্গে ৫৫,৮১৩ বর্গমাইল
এলাকা বিস্তৃত স্বাধীন
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব
হয়। যার তিন দিকই প্রায়
ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে ঘেরা,
একদিকে অবস্থিত
বঙ্গোপসাগর, এখানে টহল
দিচ্ছে শক্তিশালী ভারতীয়
ব্লু-ওয়াটার নেভী। এরকম
একটা বৈরী পরিবেশে বসবাস
করে বাংলাদেশকে তার
স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব
টিকিয়ে রাখার
চেষ্টা করতে হবে।
(অধ্যায় ঃ আজকের
বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৪৮)
ভারত কোনদিনই তার
আশপাশে ভিন্ন রাষ্ট্রের
অস্তিত্ব স্বীকার করে না।
ভারতের
স্বপ্নদ্রষ্টা পণ্ডিত
জওহরলাল নেহেরু তাঁর
‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’
নামক বইতে দক্ষিণ
এশিয়াব্যাপী হিন্দু সভ্যতার
প্রভাব বলয় সৃষ্টির আবেগ
আচ্ছন্ন মনোভাব ব্যক্ত
করেছেন।
বিখ্যাত ভারতীয়
বুদ্ধিজীবী নিরোদ
চৌধুরী এক তথ্য ফাঁস
করে বলেছেন, ৪৭ থেকে ৫০
সাল পর্যন্ত জওহরলাল
নেহেরু ৩ বার পুলিশ এ্যাকশন
করে হায়দারাবাদের মত
বাংলাদেশ দখলের
পরিকল্পনা করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, জয়
প্রকাশ নারায়ণ সৈন্য
ঢুকিয়ে পূর্ব পাকিস্তান
গ্রাস করার পরামর্শ
দিয়েছিলেন। ভারতীয়
নেতারা বরাবরই অখন্ড
ভারতের স্বপ্ন
দেখে এসেছেন। ভারতীয়
জাতির জনক
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন,
“ভারত বিভাগ
করতে হলে আমার মৃত দেহের
উপর করতে হবে। যতই
রক্তপাত হোক এক
ইঞ্চি পাকিস্তানও
আমি সমর্থন করবো না।”
তিনি বলেন ঃ If India leads
a blood bath, She shall
have it.
ভারতের বিখ্যাত লেখক
বিমলানন্দ শাসমল তাঁর
‘ভারত কি করে ভাগ হল’
বইতে লিখেছেন -
‘গান্ধী বলেছিলেন “ভারত
বিভাগ মানে ‘ঈশ্বরের’
অস্তিত্বকে অস্বীকার
করা। পাকিস্তানের জন্য
এক ইঞ্চি জমি দেয়াও ঠিক
হবে না।”
তিনি আরও লিখেছেন
“মাউন্ট ব্যাটেন
রাতারাতি পার্টিশন প্ল্যান
তৈরি করলেন এবং নেহেরু ও
প্যাটেলকে দিয়ে তাদের
সমর্থনে সেটি সই করিয়েও
নিলেন। জিন্নাহর
পাকিস্তানকে খর্ব করার
জন্য বাঙলা ও
পাঞ্জাবকে ভাগ করার
ব্যবস্থা রাখা হোল।”
ভারতীয় নেতা বল্লভ ভাই
প্যাটেল বলেছিলেন, “পূর্ব
বাংলা অর্থনৈতিক দিক
দিয়ে কোনভাবেই অস্তিত্ব
রক্ষা করতে পারবে না, আজ
হোক কাল হোক আমাদের
সংগে তাদের মিলতেই হবে।”
যে ভারতীয় নেতারা অখণ্ড
ভারত ছাড়া কিছু ভাবতেই
পারেনি, সেই ভারত ১৯৭১
সালে আমাদের
স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য
করার আগ্রহ নিয়ে ছুটে এল
কেন সেই উদ্দেশ্যটি সত্যিই
রহস্যে ঘেরা। এই রহস্যের
জট খুলে, প্রখ্যাত
সাংবাদিক মাসুদুল হক তাঁর
‘বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’
এবং সিআইএ’
বইতে লিখেছেন “১৯৬২
সালের চীন ভারত সীমান্ত
যুদ্ধে আইউব খানের
ভূমিকায় পাকিস্তান
সম্পর্কে নতুন
দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ
করে ভারত।
পাকিস্তানকে দুর্বল করার
লক্ষ্যে সে পূর্ব
পাকিস্তানকে পশ্চিম
পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন
করে আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত
করার পরিকল্পনা নেয়।
ভারতীয় কেন্দ্রীয়
গোয়েন্দা সংস্থার ওপর
সে পরিকল্পনা তৈরির
দায়িত্ব অর্পিত হয়।”
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক
অশোক রায়না তাঁর ইনসাইড
‘র’ বইয়ের ৭ম
অধ্যায়ে ‘অপারেশন সিকিম’
পর্যায়
বর্ণনাকালে লিখেছেন ঃ “অপারেশন
বাংলাদেশ শেষ নয়। একমাস
পর একজন ঊর্দ্ধতন
বেসামরিক কর্মকর্তা ‘র’
প্রধানের অফিসের
বারান্দা দিয়ে হেঁটে সভাকক্ষের
দরজার
নিকটে এসে থামলেন।
টোকা দেয়ার পূর্বেই
তাঁকে সাদরে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল।
চারজন লোক
নীরবে বসে চায়ে চুমুক
দিচ্ছেন। শান্ত নীরব
পরিবেশ তপ্ত-চঞ্চল
হয়ে উঠল মুহূর্তে, ভাল
দেখিয়েছেন। (পাকিস্তান
দ্বিখণ্ডীকরণ)
কাজটা ভালভাবেই হয়েছে।
এখন আমাদের
পরবর্তী কাজ
নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
বাকি চারজন বিস্মিত
হয়ে ভেবেই পেলেন না।
এরপর আবার কি? সিকিম
জেন্টলম্যান সিকিম। দেখুন
এটা নিয়ে কি করতে পারেন।”
সাংবাদিক মাসুদুল হক তাঁর
‘বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’
এবং সিআইএ’ বইতে আরও
লিখেছেন “বাংলাদেশ
একটা প্রকৃত স্বাধীন
সার্বভৌম রাষ্ট্র
হিসাবে গড়ে উঠুক ভারত
তা কখনও চায় না।”
১৯৭০ সালের ৩১
জানুয়ারী লন্ডনের
গার্ডিয়ান পত্রিকায়
ওয়াল্টার সোয়ার্জ
লিখেছিলেন- “বাংলাদেশ
ভারতীয় অস্ত্র
এবং কূটনীতির শ্রেষ্ঠ
স্বাক্ষর। বাংলাদেশ মুক্তির
কাহিনী প্রায় পাঠ্যবই এর
অনুশীলনীর মতই চলেছিল
এবং কূটনীতির প্রতিধাপ
তদারকি করেছিলেন
প্রধানমন্ত্রী মিসেস
ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং।
তিনি এমন সুকৌশল
এবং সুক্ষ্মতার
সাথে কাজটি করেছিলেন
যা নয়াদিল্লীর
কূটনীতিতে সচরাচর
দেখা যায় না।
এই সব মন্তব্য
এবং পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা স্পষ্টতই
প্রমাণ করে যে, ভারত
আমাদের
স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য
করতে ছুটে এসেছিল এক
সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধি নিয়ে।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় লেখক
ও সাংবাদিক শ্রী বিমলানন্দ
শাসমল তাঁর ‘ভারত
কি করে ভাগ হল’
বইতে লিখেছেন,
“বাংলাদেশকে স্বাধীন
করে দেবার জন্য
আমরা ভারতীয়রা কৃতিত্বের
দাবি করি এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সেই
জন্য এই সময়ে এশিয়ার
মুক্তিসূর্য বলেও অভিহিত
করা হতো। কিন্তু
বিনীতভাবে বলতে চাই,
যে লোকটির জন্য বাংলাদেশ
স্বাধীন হতে পারলো তাঁর
নাম মোহম্মদ
আলী জিন্নাহ্। ১৯৪৭
সালের ২০ জুন পূর্ব বাংলার
মুসলমানরা জিন্নাহর
আহ্বান অগ্রাহ্য
করে যদি পাকিস্তানে যোগ
না দিতেন এবং ভারতে যোগ
দিতেন এবং তার দশ-বিশ
বছর বাদে,
যে কারণে পাকিস্তান
হতে বিচ্ছিন্ন হতে চাইলেন,
অর্থাৎ ভাষা পার্থক্যের
জন্য ভারতবর্ষ
থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে স্বাধীনতা লাভ
করতে চাইতেন, তাহলে শেখ
মুজিবুর
রহমানকে আমরা বাঙালিরা কি ফুলের
মালা দিয়ে পূজা করতাম,
না রাস্তায় গুলি করে মারার
দাবি জানাতাম? প্রায় একই
কারণে শেখ
আব্দুল্লাহকে কত বছর
কারাগারে থাকতে হয়েছিল,
নিশ্চয় সে কথা কেউ
ভোলেন নি।
পাকিস্তানে স্বেচ্ছায় যোগ
দিয়ে তারপর পাকিস্তান
থেকে বিচ্ছিন্ন হবার
দাবি জানালে, পাকিস্তান
পূর্ব বাংলায় যে অত্যাচার
করেছিল,
ভারতবর্ষে স্বেচ্ছায় যোগ
দিয়ে তারপর ভারত
থেকে বিচ্ছিন্ন হবার
দাবি জানালে ভারতবর্ষ
পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের
চেয়ে বেশি না হোক কম
অত্যাচার করতো না।
মিজো, নাগাদের উপর
আমরা যে অত্যাচার
করেছিলাম, পৃথিবীর লোক
কোনদিন সে সংবাদ
জানতে পারবে না। ভারতের
মত শক্তিশালী দেশের
সঙ্গে লড়াই করার জন্য
ক্ষুদ্র পাকিস্তান
বা পৃথিবীর কোন দেশের
কার্যকরী সাহায্য পূর্ব
বাংলার লোকেরা পেতেন না।
ভাগ্যবশত পূর্ব
বাংলা পাকিস্তানে যোগ
দিয়েছিল বলেই
সহজে স্বাধীন
হতে পারলো -
না হলে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা দূর অস্ত
হয়ে থাকতো।”
তিনি আরও লিখেছেন- “আর
একটা প্রশ্ন এই
প্রসঙ্গে আমার
মনে থেকে গেছে যার কোন
সদুত্তর আমি পাইনি।
একথা সবাই জানেন, ভারতীয়
সৈন্য পূর্ব বাংলায়
যেতে না পারলে পূর্ব
বাংলা স্বাধীন করা যেত না।
গোপনে যে ধরনের সাহায্য
(বাংলাদেশের
মুক্তিযোদ্ধাদের )
দেওয়া হচ্ছিল
তাতে একটা দেশকে স্বাধীন
করা যায় না। পূর্ব
বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ
আশ্রয়প্রার্থী ভারতে এসে পড়ায়
ভারতের
অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এই
যুক্তিতে পাকিস্তানের
বিরুদ্ধে কিছু করা উচিত এই
দাবি নিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর
বড় বড় রাষ্ট্রনেতাদের
সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের
কার্যকরী কিছু
করতে অনুরোধ জানালেন।
কিন্তু ব্যর্থ হলেন। পৃথিবীর
কোন দেশই এ
ব্যাপারে ভারতকে কিছু অর্থ
ভিক্ষা ছাড়া আর কিছু
করতে রাজি হলো না। সত্য
হোক মিথ্যা হোক একথাও
তখন অনেকে বলতেন যে এই
লক্ষ লক্ষ আশ্রয়
প্রার্থীর ভারতে আগমনও
একটি ষড়যন্ত্রের ফল।”
এখানে উল্লেখ
করা যেতে পারে যে, একই
ব্লুপ্রিন্ট হায়দারাবাদেও
অনুসরণ করা হয়েছিল।
হায়দারাবাদ দখলের
পূর্বে সেখানেও নিজস্ব
স্বেচ্ছাসেবকদের
মাধ্যমে জনগণের
মধ্যে ভয়ভীতি ছড়িয়ে শরনার্থীদের
ভারতে প্রবেশের জন্য
প্রলুব্ধ করা হয়েছিল।
তারপর বিশ্বব্যাপী প্রচার
করা হয়েছিল যে,
হায়দারাবাদে অমুসলমানদের
জানমালের নিরাপত্তা নেই,
সেখানে আইন
শৃংখলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ
ভেঙ্গে পড়েছে।
এমতাবস্থায় ভারত চুপ
করে বসে থাকতে পারে না।
দেরিতে হলেও বাংলাদেশের
মানুষের
মোহমুক্তি ঘটতে শুরু
করেছে।
তারা স্বাধীনতা শব্দটি বিচার
বিশ্লেষণের মাধ্যমে, এর
প্রকৃত অবয়ব নির্মাণ
করতে চাইছে। কে শত্র“,
কে মিত্র চিহ্নিত
করতে চাইছে।
এক সাংবাদিক লিখেছেন,
“১৯৭১
সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত
আমাদের সাহায্য করেছিল
যে কারণে, সেই
কারণগুলো হল ১।
পাকিস্তান ভাঙ্গা, ২।
বাংলাদেশকে ১৯৪৭ সালের
পূর্বাবস্থার মত ভারতের
অর্থনীতির
পশ্চাদভূমিতে পরিণত করা,
৩। দক্ষিণ এশিয়ায়
সার্বভৌম
শক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত
করার জন্য,
বাংলাদেশকে আশ্রিত রাজ্য
হিসাবে গড়ে তোলা। যুদ্ধ
পূর্বকালীন
অস্থায়ী আওয়ামী লীগ
সরকারের সাথে ৭
দফা এবং পরবর্তীতে ২৫
দফা বশ্যতা চুক্তি ভারতের
সেই আচরণেরই সাক্ষ্য বহন
করে।
তা ছাড়া ১৯৭২ সালের
পরবর্তী ৩ বছর, ভারত
বাংলাদেশের সাথে তার
আশ্রিত রাজ্যের মতই
আচরণ করেছিল।
বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান
অনুমোদন করার জন্য
তৎকালীন
আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল
হোসেনকে খসড়া বগলদাবা করে দিল্লী দৌড়াতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রথম
পাঁচসালা পরিকল্পনা অনুমোদনের
জন্য তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী মরহুম
তাজউদ্দিন
আহমদকে ভারতের
ডি পি ধরের
দুয়ারে ধর্ণা দিতে হয়েছিল।
সেদিন ভারতেরই
নির্দেশে নিয়মিত
সেনাবাহিনী ধ্বংস
করে ভারতীয় সেনার আদলে,
ইউনিফর্মে বাংলাদেশকে সশস্ত্র
রক্ষী বাহিনী গঠন
করতে হয়েছিল।
বেরুবাড়ী ভারতকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ
ফারাক্কা চালু করার
অনুমতি দিতে হয়েছিল।
দিল্লীর নির্দেশেই
বাংলাদেশের সু-সংগঠিত
মুদ্রামান ৬৬% হ্রাস
করে সম্পদ ভারতে পাচার
করে দিতে হয়েছিল।
ভারতে কাঁচাপাট বিক্রির
নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দেশের
সমৃদ্ধ পাট শিল্পকে ধ্বংস
করা হয়েছিল।
দু’দেশে ফ্রি যাতায়াত
ব্যবস্থা এবং বর্ডার ট্রেড
চালু করে চোরাচালান
ব্যবসাকে অবারিত
করা হয়েছিল। ভারতের
অনুমতি ছাড়া বন্দুক,
এমনকি একটা বেসামরিক
নৌযান কেনার অধিকারও
বাংলাদেশের ছিল না।
এসব ঘটনা হায়দারাবাদ
ট্রাজেডীর পর শেষ নিজাম
মীর ওসমান আলি খান এর
অসহায়ত্বের কথা স্মরণ
করিয়ে দেয়।
তাঁকে রাজপ্রমুখ
আখ্যা দেয়া হয়েছিল ঠিকই
কিন্তু
বাস্তবে তিনি নখদন্তহীন
কাগুজে বাঘ ছাড়া আর কিছুই
ছিলেন না। ৭২
পরবর্তী বাংলাদেশ
সরকারও তেমনি স্বাধীন
নামধারী হলেও
প্রকৃতপক্ষে ভারতের
আশ্রিত রাজ্যের মত
আচরণ করেই ক্ষমতায়
টিকে থাকতে হয়েছিল সেই
সরকারকে।
(অধ্যায় ঃ আজকের
বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৪৯, ৫০,
৫১, ৫২, ৫৩)
*ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য
করলে দেখা যাবে, কোন
দেশের আভ্যন্তরীন বিরোধ
বা দাবী দাওয়াকে পুঁজি করে ভারত
সেই দেশে বিচ্ছিন্নতার বীজ
বপন করে।
এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক
বিশৃংখলার
সুযোগে সে দেশের
স্বাধীনতা হরণ করে।
যে মুসলিম শাসিত
হায়দারাবাদে ৫০ বছর
আগে থেকে সাম্প্রদায়িকতার
কথা কেউ শোনেনি, সেই
হায়দারাবাদে হিন্দু মহাসভা,
আর্য্য সমাজ প্রভৃতির
শাখা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতার
ইন্ধন যোগানো হল। বংশ
পরম্পরায় প্রচলিত দেশের
নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীতের
বিরুদ্ধে গান্ধীজীর
নির্দেশে তাঁর শিষ্য রামানন্দ
তীর্থ, নরসীমা রাও, ওয়াই
বি চ্যবন এর
মাধ্যমে ‘বন্দে মাতরাম’
আন্দোলন শুরু করা হল।
মোগল আমল
থেকে প্রচলিত সমৃদ্ধ উর্দূ
ভাষার
পরিবর্তে হিন্দুস্তানী ভাষা প্রচলনের
আন্দোলন শুরু করা হল।
সর্বোপরি স্টেট কংগ্রেস
প্রেসিডেন্ট স্বামী রামানন্দ
তীর্থের মাধ্যমে সশস্ত্র
বিদ্রোহ
সৃষ্টি করে হায়দারাবাদ
সীমান্ত
অঞ্চলকে ফ্রি জোন
ঘোষণা করা, কম্যুনিস্টদের
হাতে অস্ত্র
তুলে দিয়ে তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ
সৃষ্টি এসবই ছিল
হায়দারাবাদ দখলের
প্রস্তুতিমূলক ড্রেস
রিহার্স্যাল। হায়দারাবাদেও
বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিবিদ,
বুদ্ধিজীবীদের
মাধ্যমে দেশকে অশান্ত
অস্থিতিশীল
করে তোলা হয়েছিল। যার
ফলে একদিন সামান্য
আঘাতেই হায়দারাবাদের
পতন ঘটে। আজ
বাংলাদেশের
দিকে তাকালে একই বিষয়ের
পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়।
আজ বাংলাদেশেরই কিছু
বুদ্ধিজীবীর মুখে উচ্চারিত
হচ্ছে ৪৭ এর দেশ বিভাগ
ভুল ছিল। তারা বলছেন -
দ্বিজাতি তত্ত্ব ভুল
প্রমাণিত হয়েছে। ধর্মের
ভিত্তিতে দেশ ভাগ ছিল
নাকি অন্যায়।
তাহলে ভারতে বাঙালী,
পাজ্ঞাবী, মাদ্রাজী, মারাঠা,
গুর্খা, যাদের আচার-আচরণ,
খাদ্য-পোষাক, সাহিত্য-
সংস্কৃত ি এবং ভাষাগত
কোন মিলই নাই,
তারা কিভাবে শুধু
হিন্দুত্ববাদকে অবলম্বন
করে একজাতি হয়ে বাস
করছে; সে কথা বাংলাদেশের
বুদ্ধিজীবীরা ভেবেও
দেখে না। তারা একথাও
মনে করে না হায়দারাবাদে কম্যুনিস্ট
রাজ্য কায়েম করার জন্যই
যদি তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের
আগুন জ্বালানো হয়েছিল,
তাহলে নিজাম শাহীর পতনের
পর, এবং ভারত কর্তৃক
হায়দারাবাদ দখলের পর
সে আগুন নিভে গেল কেন?
সেখানে কম্যুনিস্ট রাজ্য
কায়েম হল না কেন?
বাংলাদেশের বর্তমান
সরকার ভারতের সাথে যে ৩০
বছর
মেয়াদী পানি চুক্তি করেছে,
ভারতের মদদপুষ্ট কতিপয়
সশস্ত্র বিদ্রোহী চাকমার
সাথে যে শান্তি চুক্তি করেছে,
সে অসম বানিজ্য চুক্তির
ফলে দেশ ভারত নির্ভর
হয়ে পড়ছে। এ ছাড়াও
করিডোর চুক্তি, চট্টগ্রাম
বন্দর ব্যবহার চুক্তি,
ট্রানজিট চুক্তি, বিদ্যুৎ ও
গ্যাস চুক্তি সহ ভারতের
সাথে যে যে চুক্তি করতে যাচ্ছে সকল
চুক্তি স্বাক্ষরের
আগে তাদের হায়দারাবাদ,
জুনাগড়, গোয়া, মানভাদার,
সিকিম, কাশ্মীর, নেপাল ও
ভুটানের ইতিহাস
থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে দেশটা নানান
সংঘাতে, নানান
বিপর্যয়ে রুগ্ন, জীর্ণ,
ক্লিষ্ট হয়ে কোন
মতে দাঁড়িয়ে আছে।
সেখানে এমন কোন
রাজনৈতিক ঝড় তোলা ঠিক
হবে না, যার সামান্য
আঘাতেই
তাকে হায়দারাবাদের
বা সিকিমের ভাগ্য বরণ
করতে হয়। বহু দামে কেনা এই
স্বাধীনতা। যাদের
স্বাধীনতা নেই তারাই শুধু
জানে কি তাদের নেই।
কাশ্মীরবাসী প্যালেস্টাইনীদে
র জিজ্ঞাসা করে দেখুন,
পরাধীন দেশে তাদের দিন
কিভাবে আসে, রাত
কিভাবে যায়?
(অধ্যায় ঃ আজকের
বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৫৩, ৫৪)
--------------- --------------