পূর্বকথন-
আপনারা ভুলে গেলেও আমি ভুলি নাই…
আমি যে ভাষায় কথা বলি, যে ভাষায় স্বপ্ন দেখি সেই ভাষার সবচেয়ে বড় কবি একজন মালুর বাচ্চা
আমি যে ধর্ম পালন করি সেই ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থটি প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেছেন একজন মালুর বাচ্চা
যেই বিজ্ঞানী বিশ্বের দরবারে আমার দেশকে তুলে ধরেছেন এক অনন্য উচ্চতায় তিনি ছিলেন একজন মালুর বাচ্চা
আমার ভাষার জন্মরহস্য যিনি উদ্ধার করেছেন তিনি একজন মালুর বাচ্চা
আমি বুকের ওপর হাত রেখে যে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বড় হয়েছি তার রচয়িতা একজন মালুর বাচ্চা
আমি কিভাবে ভুলি?
কিছু স্মৃতি-
২০০৯ সালের রমযান মাসের কথা। একদিন জোহরের নামায পড়ে ইউনিভার্সিটির মসজিদ থেকে বের হচ্ছি হঠাৎ দেখা সুলেমান ভাই এর সাথে। উনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কাছে যেতেই বললেন-“আপনি মসজিদে কি করেন?”
-কি আর করবো? নামাজ পড়ি!
-“আপনি নামায ও পড়েন?”
সেদিন বুঝি নাই পরে জেনেছি উনি আমাকে এতদিন হিন্দু ভাবতেন। শুধু উনি না, আমার “অরুণ” নামের কারণে এই অভিজ্ঞতা বহুবার হয়েছে। “তোর চেহারায় হিন্দু ছাপ আছে” থেকে শুরু করে “তুইতো হাফ-মালু” পর্যন্ত অনেক কিছুই শুনেছি।
কখনই আমার তেমন খারাপ লাগে নাই। আজ দেখলাম ভোট দেবার অপরাধে নির্বিচারে হিন্দুদের ওপর আঘাত আসছে। খুব খারাপ লাগছে। একই রকম খারাপ লেগেছিলো যখন রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলা এসেছিলো। আমরা কি তাহলে একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?
শালারা আওয়ামীলীগ করে কেন?
সংখ্যালঘুরা (এই শব্দটা ব্যবহার করতে যেয়ে আমার প্রচন্ড্র দুঃখ হচ্ছে। নিজ দেশে কেউ এই নামে কেন পরিচিত হবে?) আওয়ামীলীগকে সাপোর্ট করে এটা সত্য। কিন্তু কখনও ভেবেছেন কেন করে?
কারণ আর কোনো অপশন নাই। বিএনপি/জামাতকে (যারা ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করে) কিভাবে একজন হিন্দু সাপোর্ট করবে আপনিই বলুন? একই অবস্থা ইন্ডিয়াতেও। সেখানেও মুসলমানরা কংগ্রেসকে সাপোর্ট করে বিজেপিকে সাপোর্ট করা সম্ভব নয় বলে। আপনার কি মনে হয় ওরা আওয়ামীলীগকে খুব ভালোবাসে? ওরা খুব ভালো করেই জানে আওয়ামীলীগ ওদের বলির পাঁঠার মত ব্যবহার করছে। বিশ্বজিৎ হত্যা, কোটা আন্দোলনের সময় শিবির বইলা হিন্দুদের পিটানোর কাজ যে আওয়ামীলীগ করসে এটা ওরাও জানে। কিন্তু কি করবে? লাথি খাইলেও ওদের আর কোনো অপশন নাই। বিএনপি যদি জামাত এর সাথে না থাকতো তাইলেও নাইলে একটা কথা ছিলো।
আজকে ভোট দেয়াতে শিবির পিটাচ্ছে, ভোট দিতে না গেলে আওয়ামীলীগ পিটাইতো- যাবে কই এরা?
পেপারে দেখলাম ঘটনার আগে আওয়ামীলীগের নেতাদের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি মালোপাড়ার সেই হতভাগা হিন্দুরা। কাজ শেষ তাই ফুটবলের মত লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে ওদের। পাকিস্তানের হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে যাদের ঘুম হারাম হয় সেই “অসাম্প্রদায়িক” সরকার কোথায় ছিলেন নিজের দেশের মানুষগুলোকে বাঁচানোর সময়? আর কোথায়ই বা গেলো মানবাধিকারের নামে মুখে ফেনা তোলা সেইসব সংগঠন? আসল কথা হইলো সংখ্যালঘুরা আমাদের রাজনীতির শাটলকক। সব দলই তাদের বাড়ি দেয়। কখনো এই পাড়ে কখনও বা ঐ পাড়ে। আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোন বিচার হয়েছে বলে শুনিনি। সবদলই মদদ দিয়ে যাচ্ছে এ ঘটনার। সংখ্যালঘুরা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই ওদের মঙ্গল।
সব দোষ ঐ শালাদের-
ইন্ডিয়াতে বাবরি মসজিদ ভাঙসে, ধর ধর মালু ধর। বার্মায় রোহিঙ্গাদের পিটাইছে, ধর ধর বৌদ্ধগুলারে ধর। আমাদের দেশের হিন্দুরা কি বাবরি মসজিদ ভাঙসে নাকি আমাদের বৌদ্ধরা বার্মায় গেসে? তাইলে এদের পিটায়া লাভ কি? প্রতিবাদের তো আরও উপায় আছে, না কি? এখন আপনার আর ঐ মানুষগুলার মধ্যে পার্থক্য কোথায় রইলো?
বেহেশত কি হাতের মোয়া?
যে সব ভাই মনে করতেসেন বিধর্মী মাইরা খুব সওয়াব কামাইসেন, আল্লাহ্ আপনাদের জন্যে বেহেশতে ডুপ্লেক্স বাংলো বানাইসেন, তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত-
“অন্যায়ভাবে নিহত ব্যক্তির পাপ হত্যাকারীর উপর বর্তাইবে।”-সূরা মায়িদা। পারা-৬, রুকু-৫, আয়াত ২৯
“(ইয়াহূদীদের প্রসঙ্গে) তোমরা পরস্পর শোণিতপাত করিও না। স্বীয় বাসস্থান হইতে আপনজনকে বহিষ্কৃত করিও না।”-সূরা বাকারা। পারা-১, রুকু-১০, আয়াত-৮৪
“তোমরা যাঁহার পূজা কর আমি তাঁহার পূজক নই, এবং আমি যাঁহার ইবাদত করি তোমরা তাঁহার ইবাদতকারী নহ। তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার দীন। (ধর্মে কোন জবরদস্তি নাই। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই ইসলামের নীতি।)”- সূরা কাফিরূন। পারা-৩০, রুকু-১, আয়াত ৪-৬
“সত্যধর্ম গ্রহণে বলপ্রয়োগের জন্য আল্লাহ্ রাসূলকে পাঠান নাই। যে আল্লাহ্কে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহ্র অঙ্গীকৃত শাস্তিকে ভয় করে, রাসূল যেন কুরআন দ্বারা তাহাকেই সদুপদেশ দান করেন।”-সূরা কাফ। পারা-২৬, রুকু-৩, আয়াত ৪৫
“আল্লাহ্ ইচ্ছা করিলে পৃথিবীর সকলেই একযোগে বিশ্বাস স্থাপন করিতে। সত্যধর্ম গ্রহণের জন্য বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ।(রাসূলের জন্য প্রচার ব্যতীত নহে)”-সূরা ইউনুস। পারা-১১, রুকু-১০ আয়াত ৯৯
“আল্লাহ্ বনী ইসরাঈলদের প্রতিবিধান দিয়াছিলেন যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করার জন্য ছাড়া কেহ কাহাকেও হত্যা করিলে, সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করিল; আর কেহ কাহারও প্রাণ রক্ষা করিলে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করিলো”- সূরা মায়িদা। পারা-৬, রুকু-৫, আয়াত ৩২
যেখানে আল্লাহ্ ধর্মপ্রচারে পর্যন্ত জবরদস্তি করতে নিষেধ করেছেন, সেখানে সামান্য কারণে আপনারা ভিন্নধর্মীদের ওপর হামলা করছেন। আল্লাহ্ বলেছেন অন্য ধর্মের দেব-দেবীকে নিয়ে কটু কথা না বলতে এবং এটাও বলেছেন এর বিনিময়ে উক্ত ধর্মাবলম্বী যদি আল্লা্হ্কে নিয়ে কটু কথা বলে তাহলে তার দোষ পড়বে সেই মুসলমানের ওপর। এমন একটা ধর্মের অনুসারী হয়ে কিভাবে পারলেন এতটা জুলুম করতে? আপনারা না কুরআনে বিশ্বাস করেন? সেটা কোন কুরআন? সেখানে কি এই আয়াতগুলো নেই? হাশরের ময়দানে কি জবাব দিবেন আল্লাহ্র কাছে?
শেষ কথা-
ভিন্নধর্মীরা আমার শত্রু নয়। দেশ যদি মা হয় তবে তারা এই মায়ের সন্তান। তাদের বাড়িঘরে কে হামলা চালিয়েছে সে ব্যাপারে আমি শিওর না। জামাত/বিএনপি হতে পারে আবার ওদের ফাঁসানোর জন্যে আওয়ামীলীগ ও হতে পারে (রামুর ঘটনা স্মরণ করুন)। তবে এতটুকু আমি শিওর যে যারা হামলা করেছে তারা (অথবা তাদের অধিকাংশই) মুসলমান। এই সব কুলাঙ্গার মুসলমানের কর্মকান্ডে একজন মুসলিম হিসেবে আমি লজ্জিত, দুঃখিত। সকল ভিন্নধর্মাবলম্বী বাংলাদেশীর কাছে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। একটাই অনুরোধ কিছু কুলাঙ্গারের জন্য সকল মুসলমানকে ভুল বুঝবেন না। প্লিজ। আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকবো।
যে দেশে একজন হিন্দু (গিরিশ চন্দ্র সেন) সর্বপ্রথম পরম যত্নে মুসলমানদের পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেন এবং তাঁকে সম্মান দিয়ে মুসলমানরা “ভাই” উপাধি দেন সে দেশে সাম্প্রদায়িকতা টিকবে না এই বিশ্বাস আমি বুকে ধারন করতে চাই।
তীব্র ভাবেই চাই!