somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুনিয়া কাঁপানো কয়েক'টি মানুষখেকোর কাহিনী (শেষ পর্ব)

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কেন আমরা মানুষখেকো প্রাণীদের নিয়ে আগ্রহ দেখাই? নিছকই তাদের খাদ্যের অস্বাভাবিকতার জন্যেই? তাদের ভয়াবহতা কিংবা চাতুর্যতার জন্য? নাকি অন্য কোন কিছু? পেটের তাগিদেই তো শিকার করা। জানা কথা, সাবধানতাই শিকারের মূলমন্ত্র। আর এক্ষেত্রে মানুষখেকোদের তো আরও সাবধান থাকতে হয়, কারণ তাদের শিকার পৃথিবীর সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণীরা। প্রতি পদেই সাবধানতা তাকে শেখায় বেঁচে থাকতে হলে কিভাবে আরও সতর্ক থাকতে হয়। আর ধূর্ত হতে হতে ক্রমেই সাক্ষাৎ শয়তান হয়ে ওঠে জানোয়ারগুলো। তাদের চলাফেরায় তখন ফুটে ওঠে অস্বাভাবিকতা। সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিক কোন ত্রাসের। শেষ পর্বে আসুন জেনে নিই এমনই কয়েক'টি কাহিনী।







দ্য গোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেসঃ

মাংশাসী প্রাণী মাত্রেরই নিয়ম হলো খিদে না পেলে শিকার ধরে না তারা। মানুষখেকোও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অস্বাভাবিকতাই মানুষখেকোর বৈশিষ্ট্য। সাভোর এই সিংহ দুটো দুনিয়াজোড়া কুখ্যাতি পেয়েছে শুধুমাত্র তাদের অস্বাভাবিক বৈশিষ্টের জন্যেই। তাদের অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট কি ছিলো জানেন? স্রেফ মজা করবার জন্যেই মানুষ মারতো তারা, চাই খিদে পাক কিংবা না পাক।

১৮৯৮, সাভো, কেনিয়া।
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা সাভো নদীতে রেলওয়ে ব্রীজ বানাবার চেষ্টায় রত। ফরাসীদের তারা যে কোন মূল্যে পিছু হটাতে চায়। এই ব্রীজ অর্থনৈতিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজদের কাছে। সাভোর ওপারে রয়েছে মূল্যবান খনিজ, আর সেই খনিজ পরিবহনের জন্য চাই রেলরাস্তা, ব্রীজ। সুতরাং, যারা আগে ব্রীজ বানাবে তারা কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করবে সেটা নিশ্চিত। আর এটাই ছিলো সাভোর মানুষখেকোদের মানুষ হত্যার সূত্রপাত। প্রথমদিকে অনেক লম্বা বিরতিতে মানুষ মারা পড়তো। কালো কুলি-কামিনরাই ছিলো মূল শিকার। কেউ খুঁজেও পেতো না লাশ। সবার ধারণা হতো ভেগে গেছে হতভাগা কুলি। আর কুলিরা সবাই স্থানীয় না হওয়ায় তার খোঁজ পড়তো না তখনই। কিন্তু পরের দিকে নিহত কুলিদের আত্নীয় স্বজনেরা যখন খোঁজ নিতে আসতে শুরু করলো তখন টনক নড়লো কর্তৃপক্ষের। কুলিরা যদিও আগেই দাবী করেছিলো এটা অতিকায় এক সিংহের কাজ। কেউ কেউ দুটি সিংহ দেখেছে বলেও দাবী করেছিলো, অনেকে বলেছিলো ওটা সিংহ নয়, সিংহীর কাজ। কারণ, সিংহ দুটোর কোনটারই কেশর ছিলো না। কিন্তু যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় তাদের কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। তাছাড়া মানুষখেকোর ধুঁয়া উঠলে কুলি-মজুরের দল পালাবে এমন আশংকায় ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ততদিনে মানুষখেকো দুটো অনেক সাহসী হয়ে উঠেছিলো, প্রথম প্রথম শিকারকে টেনে ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে খাবার প্রবনতা থাকলেও পরবর্তীতে এরা এতটাই দূধর্ষ হয়ে ওঠে যে স্রেফ শিকারকে মেরে কুলিদের তাঁবুর কয়েক গজ দুরেই খাওয়া শুরু করে দিতো। স্বচক্ষে এ ঘটনা দেখবার পরে দলে দলে লোক পালাতে শুরু করলো। কুসংস্কারাচ্ছন্ন নেটিভদের মনে ধারণা জন্মালো মৃত রাজারা সিংহের রূপ ধরে ব্রিটিশদের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এসেছে। যারাই ইংরেজদের হয়ে কাজ করবে তাদের কপালেই দুর্গতি আছে। সিংহদুটোকে পরে নাম দেয়া হয়েছিলো "দ্য গোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস"। ভূত এবং অন্ধকার এক সাথেই থাকে, সিংহ দুটোও ঠিক এমনই ছিলো বলেই হয়ত এমন নাম।

রেলওয়ে প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গেলো। কুলির দল জান বাঁচাতে পালিয়ে গেলো। ভয়ে কেউ আর কাজ করতে চাইতো না। ব্রিটিশদের এই রেলওয়ে প্রজেক্টের চীফ এঞ্জিনিয়ার জন হেনরি প্যাটারসন চিন্তা করলেন একমাত্র সমাধান মানুষখেকোগুলোকে হত্যা করা। তাহলেই নেটিভদের মন থেকে এই ভয় দূর করা সম্ভব। রাইফেল হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। কয়েকবার খুব কাছাকাছি গিয়েও সিংহদুটোকে মারতে ব্যর্থ হয়ে মুষড়ে পড়লেন। তারমনেও কেমন যেন ধারণা জন্মে গেলো সিংহদুটো অতিপ্রাকৃত কিছু। তারপরেও নিজের অদম্য মনোবলের ওপর ভরসা করে কাজ চালিয়ে গেলেন। অবশেষে ফল মিললো। অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরের বছর ডিসেম্বর নাগাদ একটাকে মারতে সক্ষম হলেন প্যাটারসন। দু'হপ্তা পরেই অন্যটাও মারা পড়লো। শেষ হলো সাভোর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বিশেষজ্ঞদের মতে ১৪০ জন মানুষ মারা পড়েছিলো সিংহদুটোর হাতে। প্রায় তিন মিটার লম্বা অতিকায় দানব দুটোর কেশর ছিলো না কোন এক অজানা কারণে। সাভো নদীর তীরেই এক গুহায় পাওয়া গেলো অসংখ্য হাড়গোড়, মেয়েদের অলংকার, আধ-খাওয়া মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইত্যাদি। মোটমাট ৩৫ জন মানুষকে খাবার জন্য মারা হয়েছিলো। বাকীরা মারা পড়েছে স্রেফ পিশাচ দুটোর ইচ্ছেখেলার বলী হয়ে।





করবেটের মানুষখেকোঃ

শিকারকাহিনী পড়েন অথচ জিম করবেটের নাম শোনেন নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। করবেটের প্রতিটি শিকারই আমাকে রোমাঞ্চিত করেছে। বারবার পড়েও মনে হয়েছে আবার পড়ি। শিকারী করবেটই শুধু নয়, ব্যক্তি হিসেবেও জিম করবেট আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। করবেটের প্রতি দূর্বলতা থেকেই হয়ত আমি তার যে কোন একটি শিকারকে বেছে নিতে পারিনি। সুতরাং তার কয়েকটি শিকার এখানে আলোচনায় উঠে আসবে।

"বিগ ক্যাট"-দের মাঝে চিতাবাঘই (জাগুয়ার কিংবা চিতা নয় কিন্তু) সবচাইতে ছোট। কিন্তু তাই বলে একে কম ভয়ংকর ভাববার অবকাশ নেই। চিতাবাঘ আমাদের পুরনো শিকারী। আমাদের পূর্বপুরুষের মাথার খুলির ফসিলে চিতাবাঘের দাঁতের চিহ্ন সেই স্বাক্ষ্যই দেয়। অনেকের মতেই চিতাবাঘ যদি সিংহের আকারের হত তাহলে সেটা হত সিংহের চেয়ে অন্তত দশগুন ভয়াবহ। গত শতকের একেবারে গোড়ার দিকের একটা ঘটনা বলি। কুমায়ুনের অনেক মানুষখেকোর মধ্যে পানারের নরখাদক ছিলো এক ইতিহাস। তার মানুষখেকো হবার অনেক কারণ থাকতে পারে। রোগে ভুগে কেউ মারা গেলে তাকে দাহ করা হয় সেটাই হিন্দু শাস্ত্রের প্রথা। এমনিতেই এটা একটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি, মুখাগ্নি করবার সময় নির্দিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত থাকতে হয়, লগ্নের ব্যাপারও থেকে থাকতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্যা বাঁধে মহামারীর সময়। দলে দলে লোক মারা পড়লে তাকে দাহ করার আর সময় পাওয়া যায় না। কোনক্রমে মন্ত্রপাঠ করে খাদে ঠেলে ফেলা হয়। ভাগ্য ভালো হয় যখন হতভাগ্য মৃতদেহ শকুন কিংবা হায়েনার খাদ্য হয়। মন্দভাগ্য হয় তখনই যদি কোন বাঘ খায়, মানুষের মাংসের স্বাদ তাকে অন্য যেকোন খাবার থেকে আলাদা করে ফেলে। মহামারী যতক্ষণ চলে সব ঠিকঠাক থাকে। মহামরী শেষে লাশের আকাল পড়লে শুরু হয় নরখাদকের হত্যাযজ্ঞ। অনেক সময় মিলন ঋতুতেও নরখাদকের সান্নিধ্যে এসে সাধারণ বাঘও নরমাংসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার মা নরখাদক হলে তার শাবকেরও নরমাংসে রুচি হয়ে যায়। পানারের চিতাবাঘ ঠিক কি কারণে নরখাদক হয়েছিলো তা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। করবেটের ভাষ্যমতে শিকারীর গুলিতে আহত হয়ে তার স্বাভাবিক শিকার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিলো। তাতেই হয়ত সে মানুষখেকো হয়ে ওঠে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী চার শতাধিক মানুষ তার পেটে যায়। আসল সংখ্যাটা হয়ত আরো বেশী হবে। তার আক্রমণে আহত হয়ে যারা বেঁচে গিয়েছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই কিছুদিন পরেই মারা গেছে। এমন মৃত্যু পরোক্ষভাবে বাঘের কারণেই হলেও নথিপত্রে তার উল্লেখ নেই। কাজেই অনুমান করা শক্ত নয় ১৯১০ সালে করবেট তাকে মারবার আগ পর্যন্ত সে কি রকম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

"সন্ত্রাস" শব্দটার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে পরিচিত রুদ্রপ্রয়াগের লোকগুলো। আপনি হয়ত ভাবছেন বাঘের ক্ষমতা আর কতটুকু? আর আপনি যদি তাইই ভেবে থাকেন তাহলে জেনে নিন আপনি ভুল ভাবছেন। এ কোন বোমা হামলা নয়, যে ঘটনা ঘটবার দু'মাস বাদে সবাই ভুলে যাবে। এ ছিলো সাত/আট বছর ধরে রুদ্রপ্রয়াগে চলা এক অলিখিত অবরোধ। সন্ধ্যা ঘনাবার আগেই যার যার কাজ শেষে বাড়ি ফিরতো সবাই। কেউ বাড়ি থেকে দূরে থাকলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতো। মোদ্দাকথা সুর্য্য ডোবার সাথে সাথেই বিশাল জনপদটা পরিণত হত মৃত্যুপুরীতে। সেখানে নেমে আসতো কবরের নিস্তব্ধতা। সম্ভবত এ বাঘটিই করবেটের স্নায়ুপরীক্ষা নিয়েছিলো সবচাইতে বেশী। ফাঁদ পেতে কিংবা মড়িতে পটাশিয়াম সায়নাইড বিষ মিশিয়েও মারা যায়নি পিশাচটাকে। বছরের পর বছর ঘুরে মারার চেষ্টা চালাতেন করবেট। সরকারী চাকুরী করতেন বিধায় ছুটি ফুরোলেই কাজে যোগ দিতে হত তাকে। মানুষখেকোটার কাছে অসহায় লোকগুলোর ভাগ্যকে রেখে যেতে মন সায় দিতো না তার। বছরের পর বছর ঘুরেও মানুষখেকোটাকে মারতে না পেরে করবেট লিখেছিলেন, "একসময় আমিও সবার মত বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম চিতাবাঘটার শরীরটা পশুর আর মাথাটা শয়তানের।" মানুষের সাহচর্যে থাকতে থাকতে একটা পশু যে কি পরিমান ধূর্ত হতে পারে তা আন্দাজ করাও কঠিন। যেন মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ তার চেনা। ছোট্ট একটা ঘটনার উদাহরণ দিয়ে রুদ্রপ্রয়াগের চিতার কাহিনীর ইতি টানছি। রুদ্রপ্রয়াগ কিন্তু দুটো পবিত্র নদীর সঙ্গমস্থল, হিন্দু শ্রাইন বা তীর্থ ভূমি। ফি বছর বহুলোকের সমাগম ঘটে এখানে। একবার তীর্থযাত্রীদের এক দল মানুষখেকোর এলাকার কাছ দিয়েই যাচ্ছিল। পথে সন্ধ্যা হয়ে এলে সবাই বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলো। গাঁয়ের মোড়ল হুঁশিয়ার করে দিলো বাঘটার সম্বন্ধে, বললো সামনের কোন গাঁয়ে আশ্রয় নিতে। তীর্থযাত্রীদের মধ্যে একজন পুরুত ঠাকুর ছিলেন। তিনি বললেন পায়ে হেঁটে এতদূর আসায় সবাই ক্লান্ত, তাছাড়া এতগুলো লোকের মধ্যে বাঘ আসার সাহস পাবে না। এদিকে তীর্থযাত্রীদের সবার একসঙ্গে কোথাও থাকবার মতন জায়গাও ছিলো না। পাছে খোলা মাঠে থাকতে দিতে হয় এই ভেবে মোড়ল তার গোলাঘরেই সাবাইকে রাত কাটিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলেন। এই প্রস্তাবে খুশি হয়ে পুরুত ঠাকুর আশীর্বাদ করে বললেন বাঘ যদি আসে তাহলে সেটাই হবে বাঘের শেষ দিন। রাতে খাবার শেষে ভক্তবৃন্দেরা সবাই পুরুত ঠাকুরকে ঘিরে গোল হয়ে শুয়ে পড়লেন। পরদিন খুব সকালে পুরুত ঠাকুরের দেখা মিললো না, সবাই মনে করেছিলো প্রাতকৃত্য সারতেই হয়ত তিনি বাইরে গেছেন। কিন্তু বড় বড় ফোঁটায় রক্তের ধারা দেখে সবাই নিঃসন্দেহ হলো এটা কার কাজ। এতগুলো লোককে ডিঙিয়ে ঠাকুরকে বাঘে খাবার কথাই ছিলো না। বাঘে ধরলে সবচেয়ে কিনারার লোকটিকেই ধরবার কথা ছিলো। কাউকে কিছু টের না পেতে দিয়ে কিভাবে এত বড় একজন লোককে উঠিয়ে নিয়ে গেলো সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার।
বাঘরূপী এই পিশাচটিকে করবেট হত্যা করেন ১৯২৬ সালে। মরবার আগে দীর্ঘ সাত/আট বছরে মাত্র ১২৫ জনকে মারতে সক্ষম হয়েছিলো সে। নিউইয়র্ক টাইমস সহ সম-সাময়িক বিখ্যাত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিলো সে খবর।

এবারে আসি করবেটের নিজের ভাষায় সবচাইতে ভয়ংকর মানুষখেকোর গল্পে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতের উত্তরাঞ্চলের জঙ্গলেই নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও জন্মেছিলো সে। মানবজাতীর জন্য অভিশাপ? হ্যাঁ, সেটা বলতে পারেন। কোন প্রাণী হত্যার জন্য কি সেনাবাহিনী তলব করা হয়? হলিউডের মুভিতে সম্ভব হলেও বাস্তব বোধহয় এমনটি নয়। কিন্তু এই অসম্ভব কাজটিই সম্ভব হয়েছিলো তখন। আমার লিস্টে পৃথিবীর সবচাইতে ভয়াবহ মানুষখেকো এখন পর্যন্ত এটিই। শিকারীর গুলিতে শ্বদন্ত ভেঙ্গে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবে শিকার করতে পারতো না সে। ফলশ্রুতিতে মানুষ শিকারের দিকে ঝুঁকতে হয় তাকে। ক্রমেই এ কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে সে। অসম্ভব ক্ষিপ্র ছিলো সে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিকার কিছু টের পাবার আগেই মারা পড়তো। প্রতিটি মানুষ মারবার সাথে সাথে তার সাহস এবং অভিজ্ঞতাও বাড়তে লাগলো। শিগগিরই শিকার সংখ্যা ২০০ পেরিয়ে গেলো। আর টনক নড়লো নেপাল সরকারের। তাকে মারতে সেনাবাহিনী তলব করা হলো, কারণ নেপাল সরকারের পাঠানো সব শিকারীই ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করলো। মারতে ব্যর্থ হলেও বিট দিয়ে তাকে সীমানা ছাড়া করা হলো যেন নেপালে সে ফিরে আসতে না পারে।

এদিকে নেপাল অধ্যায় শেষ করে নতুন করে মানুষ শিকার শুরু হলো রয়েল বেঙ্গলের। নেপাল সীমান্ত লাগোয়া এই গাঁয়ের নাম চম্পাবত। পরবর্তীতে চম্পাবতের বাঘিনী নামেই পরিচিতি পায় সে। তার আক্রমণ এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে পুরুষেরা কুঁড়ের দরজা খুলে কাজে যাবার সাহস পেতো না। কারণ রয়েল বেঙ্গল দিনের বেলায়ও মানুষ শিকার করে। লৌহমানব করবেট ১৯০৭ সালে বাঘটিকে মারেন। আপনার কাছে হয়ত এ লাইনটি পড়ে মনে হবে খুব সহজেই হয়ে গেলো কাজটা। বাস্তবে পুরোই উল্টো। করবেটের মারা সবচেয়ে কঠিন শিকার ছিলো এটি। করবেটের হাতে মরবার আগ পর্যন্ত সরকারী হিসেবেই তার শিকার ছিলো ৪৩৬ জন, যা একটা প্রাণীর দ্বারা এ পর্যন্ত এত বেশী সংখ্যক মানুষ শিকারের রেকর্ড।

এবারে আসি আরেক মানুষখেকো বাঘ "থাক" এর ঘটনায়। এর আক্রমণ ছিলো পুরোপুরিই ভৌতিক। পাহাড়ী গাঁ। একদম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কুঁড়েগুলো তৈরী। গাঁয়ের অলি-গলি দিয়ে যখন হেঁটে বেড়াতো মানুষখেকোটা, তখন কেমন যেন একটা অস্পষ্ট গোঙানীর মতন আওয়াজ শোনা যেতো। কুঁড়ের দরজাগুলোতে থাবা দিয়ে চলতো বাঘিনী, যদি কোনোটা খোলা যায়। আর ভেতরে বসে ভয়ে কাঁপতো অসহায় মানুষগুলো। প্রায়ই কেউ না কেউ মারা পড়তো। কোন সময় পাহাড়ের ওপরের দিকের কোন গাঁয়ে, কোন সময় নীচের দিকে। বাঘের ভয়ে আশে-পাশের কয়েক'টি গ্রাম পুরোপুরিই জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো। একটা প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছিলো "থাক" গ্রামটা। বাঘটাকে শিকার করতে গিয়ে করবেট পাহাড়ের ঢালে এমন বিপজ্জনক অবস্থায় আটকে ছিলেন যে সেখান থেকে গুলি করা প্রায় অসম্ভব ছিলো। আর গুলি ব্যর্থ হলে মৃত্যু নিশ্চিত ছিলো তার নিজেরই। যেন পুরোপুরিই ছায়াছবির সাজানো নাট্যমঞ্চ। বাঘের মৃতদেহ পরদিন দেখে রহস্যের সমাধান করেন তিনি। বাঘটার একটা থাবায় বেশ ক'টি বড় বড় শজারুর কাঁটা আটকে ছিলো। শজারুর কাঁটা কিন্তু তার আত্নরক্ষার মারাত্নক অস্ত্র। এমনিতে শক্ত তবে মাংসে বিঁধে গেলে ভেঙ্গে যায়। অসহায় বাঘের কিছুই করার থাকে না। থাকের মানুষখেকোরও একই অবস্থা হয়েছিলো। এমন কি পায়ে পচনও ধরে গিয়েছিলো তার। হাঁটবার সময় ব্যথা হত বলে মুখ দিয়ে এক ধরণের গোঙানীর আওয়াজ বের হতো যা শুনে ভৌতিক আওয়াজ বলে মনে করতো গ্রামবাসী।




গুস্তাভঃ

আসুন জেনে নিই ব্যতিক্রমী এক মানুষখেকোর কাহিনী। ব্যতিক্রম বলছি এ কারণে, যে এটি এখনও জীবিত এবং মানুষ মেরে চলেছে। গোটা আফ্রিকা মহাদেশের সবচাইতে বড় আকারের শিকারী বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। ছয় মিটার লম্বা এবং প্রায় একটন ওজনের এই কুমিরটিকে বলা হয়ে থাকে শুধুমাত্র মজা করবার জন্যই এটি মানুষ মেরে থাকে (সাভোর মানুষখেকোদের মতন)। একেকবার আক্রমণে কয়েকজন করে মানুষ মারবার ঘটনা গুস্তাভের জন্য নতুন কিছু নয়। বুরুন্ডির আদিবাসীদের দেয়া তথ্যানুসারে গুস্তাভের জলহস্তী মেরে খেয়ে ফেলবার ঘটনাও আছে (জানিয়ে রাখি, জলহস্তীকে কুমিরেরা এড়িয়েই চলে তার রগচটা মেজাজ আর শক্তিশালী শরীরের জন্য)। অবশ্য প্রায় কুড়ি ফুট লম্বা এ দানবের পক্ষে যে সেটা অসম্ভব কিছু নয় তা একে দেখলেই বোঝা যায়। ফরাসী প্রকৃতিবিদ প্যাট্রিস ফে (যিনি গুস্তাভের নাম দিয়েছিলেন) এবং স্থানীয় আদিবাসীদের হিসাবমতে গুস্তাভের পেটে এ পর্যন্ত ৩০০ জন মানুষ গেছে। প্রতিবার আক্রমণের পরপরই গুস্তাভ অদৃশ্য হয়ে যায় কয়েকহপ্তা, মাস এমনকি কয়েক বছরের জন্যেও। সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেক জায়গায় সে ভেসে ওঠে যেখানে কেউ চেনে না তাকে। কেউ জানে না তার পরবর্তী শিকার কে হবে আর কোথায়ই বা হবে। ষাটোর্ধ গুস্তাভকে প্যাট্রিস ফে একবার পানির তলে খাঁচার ফাঁদ পেতে ধরবার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। বিফল হয়ে তিনি পরে বলেছিলেন, "গুস্তাভ খাঁচার চারপাশে সাঁতার কেটে যেন আমাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছিলো। দানবটি সম্ভবত মানুষের সাহচর্যে এসে মাত্রাতিরিক্ত চতুর হয়ে গিয়েছে"। সত্যিই তাই। গুস্তাভের শরীরে রয়েছে অসংখ্য ছুরি, বল্লম এবং আগ্নেয়াস্ত্রের আঘাত। কোনকিছুই তার ওপরে প্রভাব ফেলতে পারেনি। অবশ্য ফে এখন আর গুস্তাভকে মেরে ফেলতে রাজী নন। গুস্তাভের রাজত্বের অবসান হোক, সেটা চান তিনি। আর চান গুস্তাভকে বন্দী করে নীলনদের ইতিহাসের সেরা কুমিরটিকে রক্ষা করতে। গুস্তাভকে ব্যবহার করা হোক প্রজননের কাজে। আমাদের সময়ের সেরা নরখাদককে নিষ্ক্রীয় করে রাখা হোক, এমন চাওয়া আমাদেরও।


উৎসর্গঃ চেয়ারম্যান০০৭ (উনি শুধু হাসাতে পারেন, আমি চেষ্টা করলাম উনাকে ভয় দেখাবার জন্য, মনে হয় না সফল হব)

আগের পর্বগুলোঃ

দুনিয়া কাঁপানো কয়েক'টি মানুষখেকোর কাহিনী - প্রথম পর্বঃ Click This Link

দুনিয়া কাঁপানো কয়েক'টি মানুষখেকোর কাহিনী - দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ৮:৫৪
৫৫টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×