পুরাতন সেল ফোন
লিখা ও প্রকাশঃ ৩০-০৬-২০১৫
পকেট থেকে টুপ করে ১ টাকার কয়েনটা পড়ে গেল। রাফির প্যান্টের বাম পকেটে ছোট্ট একটা ছিদ্র আছে। এ ছিদ্র দিয়ে মাঝে মাঝে রাফির বল পয়েন্ট কলেমটা-ও পড়ে যায়। কি আর করা, কলমটা প্যান্টের একেবারে নিচের অংশে চলে যায় এবং ফ্লোর বা মাটি থেকে ওটা তুলে নিতে হয়। রাফির কোন মতেই মনে থাকে না যে, কলমটা প্যান্টের ডান পকেটেই রাখবে। তাহলে আর পড়ত না। কারণ ডান পকেটটা ভাল আছে। কোন ছিন্দ্র নাই।
রাফি তার পায়ের নিচে থেকে কয়েনটা তুলে হাতের তালুতে রাখল। দেখল, বর্তমান ১ টাকার একটা কয়েন কিন্তু পুরনো দিনের ২৫ পয়সার কয়েন থেকেও ছোট। এই দেখ বুঝা যায়, টাকার মানের ক্রম হ্রাসের ফলে মুদ্রার সাইজও ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু বাজার ঊর্ধ্বগতির ফলে নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর তুলনামূলক আয়ের এক ইঞ্চিও বৃদ্ধি না হয়ে, গজে গজে কমে গেছে। এ যেন প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ।
৩ দিন পরে দিবার জন্মদিন। রাফি সাহস করে তাকে বলেছিল, “এটা যেহেতু আমার সাথে তোমার প্রথম জন্মদিন পালন, তোমার এই জন্মদিনের ট্রিটটা আমি দেব”।
কিন্তু রাফি এটাও জানত দিবার সাথে এটাই তার শেষ জন্মদিন পালন। কারণ এত অসমতার মধ্যে কখনো কোন সম্পর্ক টিকে না।
দিবা বলেছিল, “ ঠিক আছে, আমি রাজী। কিন্তু আমার সাথে আমার আরও ৬,৭ জন ফ্রেন্ড থাকবে”।
রাফি মোটামুটি আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। কারণ রাফি ভেবেছিল, শুধু দিবাই থাকবে সেদিন। মোটামুটি একটা ছোট খরচের মধ্যে সারানো যাবে সবকিছু। মাথায় আর কিছু আসছিল না রাফির।
গত ৩ মাস ধরে রাফি একটু একটু করে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল দিবার জন্মদিনের জন্য। কিন্তু ২ মাস টিউশনির টাকা না পাওয়াতে, এ মাসেই টাকাগুলো খরচ করে ফেলতে হয়েছে। রাফি তার জীবনে অর্থগত যত সমস্যায় পড়ুক না কেন, খুব কমেই তাকে ধার করে চলতে হয়েছে। সুতরাং ধার করে দিবার জন্মদিনে ট্রিট দেবে, রাফি এ কথা কখনো ভাবতে পারেনি।
-মামা, ভাড়া দেন। বাস কন্ট্রাক্টর ভাড়া খুঁজল।
রাফি যেন হঠাৎ চমকে উঠল। ১৮ টাকার ভাড়া ১০ টাকা দিল ছাত্র হিসেবে। কন্ট্রাক্টর কিছুক্ষণ ঘ্যানর ঘ্যানর করে পরে চলে গেল।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনির বাসায় যেতে হবে। রাফির সাথে অনি ইউনিভার্সিটিতে একসাথে পড়ে। অনির ফ্যামিলি মেম্বাররাও তাকে খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছে। অনির ল্যাপটপ থেকে সেল বাজার অথবা বিক্রয় ডট কম এ তার পুরাতন সেল ফোনটার একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে। প্রায় ১ বছর আগে ফোনটা ও ১১০০০ টাকা দিয়ে কিনেছিল রাফি। এখন ৫০০০/৬০০০ টাকা পেলেও খারাপ না। অন্তত দিবার জন্মদিনের ঝামেলাটা শেষ করা যাবে।
রাফিকে রিলেশনের আগ্রহটা দিবাই প্রথম প্রকাশ করেছিল। রাফিও প্রপোজটা না করতে পারেনি। রাফি তার জীবনে বেশিরভাগ সময় খুব চুপচাপ ছিল, এই জন্য চঞ্চলতাকেই ওর ভাল লাগে। কিন্তু আবার এই চঞ্চলতাকেই তার সবচে বেশী ভয় লাগে। দিবা রাফির ভাবনার চেয়েও বেশী চঞ্চল প্রকৃতির একটা মেয়ে।
অনির বাসা থেকে ম্যাচে ফিরতে ফিরতে রাফির প্রায় বিকেল হয়ে গেল। রাফি তার ফোনটি অনির কাছে রেখে এসেছে। অনি বলেছে, ২ দিনের মধ্যেই ফোনটি বিক্রি হয়ে যাবে। বিক্রি হয়ে গেলে তাকে খবর দেবে। অনি রাফিকে তার পুরনো নরমাল একটা ফোন দিতে চেয়েছিল। রাফি নেয়নি।
রাফি বলেছে, “তুই আমার ম্যাচের সালামত ভাইকে ফোন দিয়ে আমাকে জানাস। সালামত ভাই এখন প্রায় ম্যাচেই থাকে। আর আমি তো তেমন কোথাও যাই না। তাছাড়া ক্যাম্পাস তো বন্ধই। হলে এখন আর যাব না”।
অনি খুব বেশী জোর করেনি। কারণ অনি জানত রাফি একটু অন্য ধরণের মানুষ।
পরের ২ দিন রাফি কাজের ছুতোয় দিবার সাথে দেখা করেনি। কারণ রাফির মনটা অনেক খারাপ ছিল। অনি জানিয়েছে তখনো তার ফোনটা বিক্রি হয়নি।
জন্মদিনের রাতে সালামত ভাইয়ের ফোনে সিম লাগিয়ে রাফি দিবার সাথে অনেকক্ষণ কথাও বলেছে। কিন্তু তার মনটা কোন মতেই ভাল ছিল না। সারা রাত ২ ঘণ্টা ঘুমিয়েছে কিনা রাফির জানা নেই। রাফির চিন্তা একটাই, সম্পর্কের ব্যাপারটা আজকেই শেষ হয়ে যাক, কোন সমস্যা নাই কিন্তু রাফির একটা চাওয়া, অন্তত আজকের সুন্দর দিনটা যেন রাফি দিবাকে তুলে দিতে পারে।
খুব সকালে অনি ফোন করে জানালো ফোনটা বিক্রি হয়ে গেছে। রাফি সকালেই অনিদের বাসায় উপস্থিত হল। অনি ফোনটা ৫৫০০ টাকা বিক্রি করতে পেরেছে।
টাকাটা পেয়ে আর দেরী করল না রাফি। দিবার পছন্দের ছোট ছোট অনেকগুলো জিনিস কিনল। তাতে রাফির প্রায় ২৩০০ টাকা চলে গেল। গত ৭ মাসের রিলেশনে দিবাকে রাফির তেমন কিছুই দেয়া হয়নি। কিন্তু এত চঞ্চল দিবাকে এ নিয়ে কখনো এতটুকু আক্ষেপও করতে দেখেনি রাফি।
বিকেল ৫ টায় দিবার বার্থ ডে সেলিব্রেশন পার্টি হওয়ার কথা। রাফি রেস্টুরেন্টে ঢুকল। দেখল, মানুষজনের তেমন আনাগোনা নাই। রাফি ভাবল ভুল জায়গায় এসে পড়ল কিনা?
ওয়েটরকে জিজ্ঞাসা করলে ওয়েটর ভিতরের দিকে একটা রুম দেখিয়ে দিল। রুমে ডুকেই রাফি অবাক হয়ে গেল। দেখল, পার্টি প্রায় শেষ পর্যায়ে। সে মনে হয় একদম শেষের দিকে এসে পৌঁছেছে। নিজের ঘড়ির দিকে তাকাল, দেখল ৫ টা এখনো বাজেনি। মনে মনে বলল, হয়তো দিবা তাকে ৪ টায় আসতে বলেছে, সে ৫ টায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা না। দিবা তাকে ৫ টায়ই পার্টি হবে অনেকবার বলেছে। কোন মতেই ভুল হওয়ার কথা না।
রাফির মন খারাপ হয়ে গেল, মনে মনে বলল, এই অনুষ্ঠান মনে হয় তার জন্য না। দিবা হয়তো তাকে মজা করেছে। রাফি-ই মজাটা বুঝেনি। এই ধরণের পার্টি সেলিব্রেশন তার মত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আশা করাটাও ঠিক হয়নি। কোথায় আজকে অনুষ্ঠানটির খরচটা তারই দেয়ার কথা। সেখানে তাকে ছাড়াই পার্টিটা শেষ।
রাফি ৩০ সেকেন্ড রেস্টুরেন্টের রুমটার দরজায়ই দাড়িয়ে থাকল। ভাবছে চলে যাবে কিনা। কিন্তু হঠাৎ ভিতর থেকে দিবা ছুটে এলো। রাফিকে হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। রাফি আগে থেকেই দিবার ৩/৪ জন ফ্রেন্ডস কে চিনতো। দিবা রাফিকে বাকিদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা মোট ৭ জন।
সেই প্রথম থেকেই দিবা রাফির হাতটা ধরে আছে। রাফি ছোট্ট রুমটার চারদিকে তাকাল । পুরো রুম প্রায় এলোমেলো। রুমে পার্টি শেষ হওয়া হওয়া ভাব। পাশে এক কোনে ছোট্ট টেবিলে আধ-খাওয়া কেকটা পড়ে আছে। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো রাফি। কিন্তু দিবা এখনো রাফির হাতটা ধরে আছে।
হঠাৎ সবাই একে একে রুম থেকে বের হয়ে যেতে লাগল। দিবার সাথে রাফিও বের হয়ে আসল সেই রুম থেকে। দিবা রাফিকে বলল, “তুমি ওখানে বস, আমি ওদেরকে বিদায় দিয়ে আসি”।
রাফি মূল রেস্টুরেন্টের ভিতর অনেকক্ষণ বসে থাকল। প্রায় ১০ মিনিট পরে দিবা আসল, এসেই রাফির সামনা সামনি বসল। স্থির দৃষ্টিতে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকল। মুখে দিবার পুরনো অসাধারণ হাসিটি লেগেই আছে, কিন্তু চোখে পরিচিত সেই চঞ্চলতা ভাবটাও আছে। হঠাৎ করে দিবা রাফির হাত দুটি ধরে বলল, “চল”।
রাফি কিছু বুঝে উঠার আগে, দিবা একপ্রকার টেনেই তাকে রেস্টুরেন্টের আগের সে ছোট্ট রুমটার মধ্যে নিয়ে গেল। রাফি দেখল, রুমটা এর মধ্যে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। মাঝ বরাবর ছোট্ট একটা টেবিল। টেবিলের উপরে দেড় পাউন্ডের একটা ছোট্ট কেক। পাশাপাশি ২ টা চেয়ার। দিবা রাফিকে টেনে নিয়ে একটা চেয়ারে বসাল। আরেকটা চেয়ারে সে নিজে বসলো। কেকের গায়ে লিখা আছে, “দিবার জন্মদিনে শুধুই রাফি”...
রাফির পুরো ব্যাপারটাকে স্বপ্নের মত লাগল। ও এখন বুঝে নিলো। দিবা, রাফিকে অন্য একটা পৃথিবীতে রেখেছে, যে পৃথিবীতে দিবা এবং রাফির একটা নিজস্বতা আছে, এখানে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নাই”।
২৭০০ টাকার মত বিল হল পুরো অনুষ্ঠানের খরচ হিসেবে। দিবা বলল, "তুমি টাকাটা আমাকে দাও, আমি বিলটা পরিশোধ করে আসি"। রাফি দিবাকে টাকাটা দিল। ৫ মিনিট পরে দিবা এসে রাফিকে ছোট্ট একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল এবং বলল, “এটা আমার জন্মদিনে তোমার জন্য গিফট”।
রাফি বলল, “এটা কেমন কথা!!! জন্মদিন তো তোমার। তুমি আমাকে গিফট দেবে কেন!!!”
দিবা বলল, “বেশী কথা বলবে না”।
রাফি আর বেশী কথা বলল না।
রাফি দিবার জন্যে নেয়া গিফটের প্যাকেটটা দিবার হাতে ধরিয়ে দিল। দিবা ওটা পেয়ে পুলকিত হয়ে গেল কিন্তু কিছু বলল না। শুধু গিফট-টার দিকে তাকিয়েই থাকল এক দৃষ্টিতে। তখনো দিবা রাফির হাতটি শক্ত করে ধরে রেখেছে।
সন্ধ্যার একটু পরে রাফি তার ম্যাচে ফিরে এলো। একটু ফ্রেশ হয়ে দিবার দেয়া গিফটটি খুলল। খুলেই হা হয়ে তাকিয়ে থাকল দিবার দেয়া গিফটের দিকে। দেখল, একটা প্যাকেটে পাতলা পিঙ্ক কালারের একটা ওড়নায় মোড়ানো তার অতি প্রিয় পুরাতন মোবাইলটি, যেটা অনি বিক্রি করে দেয়ার কথা ছিল। আরেকটা ইনভেলাপে আজকের দিনের ২৭০০ টাকা খরচের টাকার ভাউচারের কাগজটি। আর আরেকটা ইনভেলাপে, দিবার লিখা ছোট্ট একটা চিরকুট।
চিরকুটে লিখা আছে, “আমার প্রিয় মানুষ, আজ আমি তোমাকে এ টাকাটা ধার হিসেবে দিয়েছি। তুমি ইউনিভার্সিটি শেষ করে যেদিন প্রথম মাসের চাকুরীর টাকা পাবে, সেদিনই আমার দেয়া ৫৫০০ টাকা শোধ করে দেবে। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। এই নিয়ে কোন দিন আর কোন কথা যেন না হয়। আজকের দিনে তুমি যে ভালবাসার প্রকাশটা করেছ, এত বড় ভালবাসা প্রকাশের মত যোগ্য আমি এখনো হইনি। Plz আমাকে সাথে রেখ, দেখবে একদিন আমি তোমার ভালবাসা প্রকাশের যোগ্য হয়ে উঠবো”।
রাফি আগামীকাল সুন্দর একটা সকালে প্রত্যাশায় থাকল। কিন্তু রাফি জানে না, তার আগামীকাল সকালটা কেমন যাবে...
(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১০:১৮