“আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংশশীল।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফল অনুযায়ী আমাদের এই বিপুল মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে স্রেফ ‘শূন্য’ থেকেই। শূন্যতা মানে আক্ষরিক অর্থে শূন্য নয়- পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে যে শূন্য-দেশকে আপাত: দৃষ্টিতে শান্ত, সমাহিত মনে হচ্ছে, তার সূক্ষ্মস্তরে সবসময়ই নানান প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। শূন্যাবস্থা থেকে সামান্য সময়ের ঝলকানির মধ্যে ইলেকট্রন এবং পজিট্রন (পদার্থ-প্রতি পদার্থ যুগল) থেকে পদার্থ তৈরি হয়েই আবার তা শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে পারে। এই ইলেকট্রন এবং পজিট্রনের মধ্যকার ব্যবধান থাকে ১০-১০ সেন্টিমিটারেরও কম, এবং পুরো ব্যাপারটার স্থায়িত্বকাল মাত্র ১০-২১ সেকেন্ড। ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’। তারা মনে করেন এক সুদূর অতীতে কারণবিহীন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের (Quantum Flactuation) মধ্য দিয়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে সৃষ্ট মহাবিশ্বকে স্ফীতির (Inflation) দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং আরো পরে পদার্থ আর কাঠামো তৈরির পথ সুগম করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শুন্যতাটা কি? এটা কি প্রকৃত শূন্যতা? কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান মানলে তা নয়। এই শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। এতে শক্তি লুকিয়ে থাকে। কোয়ান্টাম সূত্র অনুসরণ করে এই শূন্যতার মাঝে তৈরি হয় কণা আর প্রতিকণা যুগল। অনেক দার্শনিক মনে করেন, এ ধরণের শূন্যতা অবাস্তব এবং অনেকক্ষেত্রেই পরষ্পরবিরোধীভাবে সংজ্ঞায়িত। কারন আমাদের মহাবিশ্বে যে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন হচ্ছে তাতো আমাদের স্পেস টাইমে হচ্ছে? কিন্তু শুরুর দিকে যে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন হয়েছিল তা কোন স্পেস টাইমে হয়েছিল? আর সেই স্পেস টাইমের শূন্যস্থানে চলছে কণিকার বা শক্তির রহস্যময় খেলা। শূন্যস্থানের ভিতরে এই শক্তির রহস্যময় খেলাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ভ্যাকুয়াম ফ্লাক্সুয়েশন। কিভাবে একটি শূন্য বিন্দুতে বিশ্বের যাবতীয় তারকারাজির ভর পূঞ্জিভূত থাকতে পারে, এই ভ্যাকুয়াম ফ্লাক্সুয়েশনই তার উত্তর দিতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা। পদার্থবিজ্ঞানীরা যে শূন্যতার কথা বলেন, সেটাকে বলে ‘ভয়েড’ বা স্থান-শূন্যতা। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে খুব ভালভাবেই সংজ্ঞায়িত। এর প্রকাশমান তরঙ্গ অপেক্ষক (explicit wave function) আছে। এই ভয়েডজনিত শূন্যতা আসলে কোয়ান্টাম মহাকর্ষের শূন্যতা । বিগব্যাং এর আগে শূণ্য স্থানে 'কোয়ান্টাম মেকানিক্স' বলবৎ থাকার মানে দাড়াচ্ছে শূণ্যতা আসলে নাথিং নয় বরং এটা সামথিং। কারন হিসেবে বলা যায় যে শুন্যতার মাঝে শক্তি লুকিয়ে থাকে? শূন্যতা হচ্ছে দেশ এবং কালের সংযোগ। তাহলে এই শূন্যতার বৈশিষ্ট্য কেমন করে দেশকালহীন পরমশূন্য অবস্থায় প্রয়োগ করা যাবে? আর যদি দেশকালহীন পরমশূন্য অবস্থায় এরকম বৈশিষ্ট্য থাকে তাহলে তো তা পরমশূন্য হলো না। কারন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে যখনই ইলেকট্রন ও পজিট্রন সৃষ্টি হচ্ছে তখনই দেশ ও কালের সৃষ্টি হচ্ছে। তাহলে তাকে আক্ষরিক অর্থে কোয়ান্টাম শূন্যতা বললেও কিন্তু পরমশূন্যতা বলা যাচ্ছে না। তাহলে এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত পরমশুন্যতা বলে কিছু নেই। কিছু একটা ছিলো। যাকে গুপ্ত শক্তি বলা যায়। সেই গুপ্ত শক্তি মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারন। এই গুপ্ত শক্তিকে আমরা চিরন্তন একটি কারন বলতে পারি।
বিষয়টি আমি আরো সহজে বোঝায়। শুন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি কথাটি একপ্রকার ধাঁধাঁ। একটা শুন্য বিন্দুতে যদি পরা এবং অপরা শক্তি যদি সমান সমান হয়। তাহলে কাটাকাটি করে শুণ্য হয়ে যাবে । মহাবিশ্ব হবার মতো শক্তি অবশিষ্ট থাকলো না। একটা শূন্য বিন্দুতে উক্ত পরা বা অপরা শক্তির পরিমান যদি অসীম পরিমানও হয়, তাহলেও কিন্তু ফলাফল একই হবে। এভাবে মোট শক্তির পরিমান শূন্য হলে মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হবে? সে ক্ষেত্রে সৃষ্ট দৃশ্যমান পরা বা অপরা শক্তির পরিমানে পার্থক্য থাকতে পারে। সৃষ্ট পরা ও অপরা শক্তি পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করে দেয়ার পরেও কিছু পরা বা অপরা শক্তি অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু অবশিষ্ট শক্তি রূপান্তরিত হয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঘটনা আপাত: দৃষ্টিতে শক্তির নিত্যতা নীতিকে লংঘন করে বলে মনে হয়। ভ্যাকুয়াম ফ্লাক্সুয়েশন প্রতিক্রিয়ার সময় যখনই অবশিষ্ট কিছু পরা শক্তি থেকে যাচ্ছে ,শক্তির নিত্যতা নীতি অনুযায়ী, সেই পরিমান অপরা শক্তিও সাথে সাথে অবশিষ্ট থাকার কথা এবং সেটাই অভিকর্ষ শক্তির রূপ নিয়ে কণিকার ভরের সাথে সংযুক্ত থাকছে এবং মোট শক্তিকে শূন্য করে দিচ্ছে। এর ফলে শক্তির নিত্যতা নীতিকে অটুট রাখছে।
পাঠক আমরা শেষ পর্যন্ত একটি চিরন্তন বিষয়ের সন্ধান পেলাম। সমগ্র মহাবিশ্ব ধ্বংশ হয়ে গেলেও শুন্য পরিমান শক্তি অবশিষ্ট থাকে। একটি গুপ্ত বিষয় গুপ্ত শক্তি। যে সম্পর্কে আসলে আমরা সঠিক কিছু জানিনা। সেই গুপ্ত শক্তিকেই চিরন্তন বলেই আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞান যাকে শুন্যতা বলছে তা আসলে শুন্য নয় গুপ্ত শক্তির আধার যার অভ্যন্তরে চলছে রহস্যময় আচরন। একটি চেতনতা যে নয় তাই আমরা বলতে পারি কি করে?
(আল কোরআন ঠিক একই কথা বলছে। ‘“আল্লার সত্ত্বা” ব্যাতিত সমস্তটাই ধ্বংশশীল।’ সত্ত্বা অর্থ চেহারা। যাকে আলাদা কোন চেতনতা বা সচেতন কোন বিষয় বলা যেতে পারে। )
বিধান তাহার
পাঠক এবার আসি বিধান বা নিয়ম বা সুত্র সংক্রান্ত বিষয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম নীতিগুলো আসলে কী, এবং এর উদ্ভব কীভাবে ঘটতে পারে? এটা এখনো বিজ্ঞানীদের গবেষণার পর্যায়ে। শূন্যতার মধ্যে যদি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন ঘটে তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্রগুলোই বা আসলো কোত্থেকে?’। ‘কে নাজিল করল এই সব নিয়ম?’ খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন? সাধারন শুন্যতা কি করে সৃষ্টির সকল নিয়ম কানুন পেলো? স্পেসশূন্যতা এবং সময়শূন্যতার যে পরমশূন্য অবস্থা থেকে আমাদের এই মহাবিশ্ব এসেছে সেই শূন্যতা থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি তো বিজ্ঞানের কিছু সূত্র মেনেই আসতেছে। তাহলে এই শুন্যতা কি করে এই সকল নিয়ম কে নির্ধারন করে দিতে পারে! তাতে মহাকর্ষ, কিংবা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মত রীতি গুলো বলবত থাকে কি করে? ঐগুলো কি এমনি এমনি সেই শুণ্যের আদলে বসে গেছে? এমনি অসংখ্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর বিজ্ঞান আজো পর্যন্ত দিতে ব্যার্থ। আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্য এমন ফাইন টিউন্ড নিয়মই বা নির্ধারিত হলো কি করে? এটা কি সর্ম্পূণ কাকতলীয়!
ষ্টিফেন ডব্লিউ হকিং তার গ্রান্ড ডিজাইন বইতে উল্লেখ করেছেন “ আমাদের মহাবিশ্ব ও তার আইন সমূহ দেখে মনে হয় যেন একেবারে নকশা অনুযায়ী একেবারে দর্জির হাতে বানানো! যেমনটা হলে এখানে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব হবে। আর কেনোই বা এম তত্ত্ব ১০’৫০০ সেট প্রকাশ্য নিয়মের জন্ম দেয় তার মধ্য থেকে ঠিক এই সেট নিয়ে এই মহাবিশ্বে আমরা কিভাবে হাজির হলাম?”
ষ্টিফেন ডব্লিউ হকিং এর মন্তব্য অনুসারে অসংখ্য মহাবিশ্বের মধ্যে আমাদের মহাবিশ্ব একটি। প্রতিটি মহাবিশ্বের একেক রকম নিয়ম দ্বারা পরিচালিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিটি মহাবিশ্বের জন্য কি আপনা আপনি নিয়ম সৃষ্টি হচ্ছে নাকি কোন সত্ত্বাকে এই সকল নিয়ম নির্ধারন করতে হচ্ছে। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের যেতে হবে সেলুলার অটোমেশন এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়ে। ১৯৪৭ সালের দিকে জন ভন নিউম্যান (১৯৩০-১৯৫৭) এমন এক ধরনের যন্ত্রের কথা চিন্তা করলেন যা নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরী করতে পারবেন। এরকম একটি যন্ত্রকে প্রয়োজনীয় প্রয়োজনীয় জিনিষ দিয়ে একটি কক্ষে ছেড়ে দিলে নিজের মতো আরেকটি যন্ত্র তৈরী করে ফেলবে। তখন ঐ দুটি যন্ত্র পৃথকভাবে আরো চারটি যন্ত্র তৈরী করে ফেলবে। আর এভাবেই বাড়তে থাকবে। এধরনের যন্ত্রকে এখন ভন নিউম্যান মেশিন বলা হয়। ভন নিউম্যানের সেই নিজ প্রতিলিপি নির্মানকারী যন্ত্রেও সেলুলার মডেলই ছিলো সেলুলার অটোমেটা (Cellular Automata) বা কোষীয় স্বয়ংচল যন্ত্র বা সি.এ (C.A) । একটা একমাত্রিক কোষীয় স্থান বা সেলুলার স্পেস (Cellular Space) হচ্ছে এক রেখায় সারিবদ্ধ কোষ। একটি দ্বিমাত্রিক সিএ ধারাবাহিক পরিবর্তনে ত্রিমাত্রিক আকৃতি সৃষ্টি করে। এই দ্বিমাত্রিক সিএ এর ত্রিমাত্রিক রুপায়ন মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সিএ গুলো যেমন সরল কিছু নিয়ম দ্বারা পরিচালিত আমাদের মহাবিশ্বটাও ঠিক এমন। আমাদের মহাবিশ্বটা এরুপ হাইপার ডাইমেনশনাল সেলুলার স্পেসে অবস্থিত কিনা তা বোঝা যায় “জীবনের গেম” নামক সি এর কোষগুলোর পরিবর্তন এবং বিভাজনের মাধ্যমে। ১৯৭০ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে একটি কলাম প্রকাশিত হয়। সেই কলামে জন কনওয়ে দ্বিমাত্রিক সিএ এর নামকরন করেন “গেম অফ লাইফ” (Game of life) বা জীবনের খেলা। গেম অফ লাইফের বিভিন্ন নিয়মসমূহের অসংখ্য সেটের সাথে মহাবিশ্বের সাদৃশ্যময়তা রয়েছে। যেমন গেম অফ লাইফের এক সেট সরলতম বৈশিষ্টের বিকাশ ঘটাতে পারে। গেম অফ লাইফ বা জীবনের খেলার আপনাকে নির্ধারন করে দিতে হচ্ছে আপনি কোন সেটটি চাইছেন। আপনি যে সেটটি চাইছেন গেম অফ লাইফে ঠিক সেই সেটটি আপনার সামনে প্রকাশ ঘটবে।
প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন গেম অফ লাইফ যদি আপনার দেওয়া নির্ধারিত সেটটিই প্রকাশ ঘটায় তাহলে অসংখ্য মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এই নিয়ম বা সুত্র অথবা মহাবিশ্বটা কেমন হবে তা নির্ধারনের দায়িত্ব পালন করলো কে? এ সুত্র নির্ধারনের ক্ষেত্রে একটি ইন্টেলিজেন্ট এজেন্ট সক্রিয় তা একটু বিবেক খাটালেই বোঝা যায়। একবার গভীরে গিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন কে এই নিয়ম বা বিধান কে নাযিল করলো? এই মহাবিশ্ব কি করে এত সুন্দর নিয়মের অধীন হয়ে এবং ফাইন টিউনিং এর সামঞ্জস্যতা রেখে এই প্রানী জগতের বিকাশে ভূমীকা রাখতে পারলো! নি:সন্দেহে অতি জাগতিক এটি শক্তির হস্তক্ষেপ এখানে বিদ্যমান। এই প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ং ষ্টিফেন ডব্লিউ হকিং তার গ্রান্ড ডিজাইন বইতে বলছেন “ কনওয়ের জীবনের খেলা থেকে দেখা যাচ্ছে যে একেবারে সরলতম এক সেট জটিল সব বৈশিষ্টের বিকাশ ঘটাতে পারে যেটা বুদ্ধিমান জীবনের সমতুল্য। নিশ্চয় এধরনের বৈশিষ্ট সমৃদ্ধ এমন অনেক সেট নিয়ম সম্ভব। প্রশ্ন আসে আমাদের মহাবিশ্বকে চালনাকারী মৌলিক নিয়ম (প্রকাশ্য নিয়ম সমূহ নয়) কিভাবে নির্ধারিত হলো? কনওয়ের মহাবিশ্বের মতো আমাদের মহাবিশ্বের বিবর্তনও একটা নির্দীষ্ট অবস্থা থেকে এসব নিয়ম মেনেই ঘটে। কনওয়ের জগতে আমরাই হচ্ছি সৃষ্টিকর্তা। যারা ঐ মহাবিশ্বের আদি অবস্থায় ব্স্তুমূহের অবস্থান ও প্রকৃতি নির্ধারন করে দিচ্ছি।” পাঠক লক্ষ্য করুন গেম অফ লাইফ খেলাতে একজনকে নিয়মটি নিধারন করে দিতে হয়। আর সেই কারনে সেই নিয়ম সমৃদ্ধ জগৎটি উপস্থাপিত হয়। যিনি নিয়মটি নির্ধারন করে দেন তিনিই কনওয়ের জীবনের খেলা সৃষ্টিকর্তা। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে আমাদের এই মহাবিশ্বের নির্মানে শুরুতে একটি বিধান বা নিয়মকে নির্ধারন করে দিতে হয়েছিলো। সেই নিয়ম নির্ধারন করে দিতে একটি সত্ত্বা একটি চেতনা জাগ্রত ছিলেন আর এটিই হতে পারে নিয়ম নিধারনের একমাত গ্রহণযোগ ব্যাক্ষা।
স্টিফেন ডব্লিউ হকিং এর গ্রান্ড ডিজাইন বইয়ে এক স্থানে উল্লেখ করেছেন -“ অর্ন্তবতী জগতের এসব মাত্রাসমূহের প্যাচ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু গানিতিক সুত্র মেনে। অর্ন্তবতী জগতের আকার আকৃতিই বিভিন্ন ভৌত ধ্রুবক, যেমন ইলেক্ট্রনের চার্জ ও মৌলিক কনিকাসমূহের মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদির মান নিয়ন্ত্রন করে।” পাঠক আমি একটু সহজেই বোঝায়ে বলি- ষ্ট্রিং তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয় এই অর্ন্তবতী জগৎ। আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ ৩ মাত্রিক ১ মাত্রিক সময়। আর ৭ মাত্রা এই মহাবিশ্বে গুপ্ত ভাবে আছে। গুপ্ত ভাবে পেচিয়ে লুকিয়ে আছে। ৭ মাত্রার এই অর্ন্তবতী জগতের পেচানো আকার আকৃতিই ত্রিমাতিক জগতের বিভিন্ন বিষয়বস্তু নির্ধারন করে’ এটি এম তত্ত্বে গানিতিক ভাবে দেখানো হয়েছে। এম তত্ত্ব আমাদের বলছে আমরা যদিও এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলোকে দেখাতে পাচ্ছি না বা কোন পরীক্ষার দ্বারা এদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতেও পারছি না, কিন্তু আমাদের স্ট্রিং থিয়োরির গনিত বলছে যে তারা আছে। অতিরিক্ত স্থানিক মাত্রাগুলো স্থানের খুব সংকীর্ণ জায়গায় জরিয়ে-পেচিয়ে এমনভাবে আছে যে তাই আমরা তাদেরকে দেখতে পারছিনা। আমাদের মহাবিশ্বকে আমরা ঠিক ত্রিমাত্রিক অবস্থায় দেখি এবং বাকী ৭ মাত্রা খুব সংকীর্ণ জায়গায় জরিয়ে-পেচিয়ে অর্ন্তবর্তী জগৎ হয়ে আছে। মহাবিশ্বগুলো কেমন হবে, তা নির্ভর করে স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো কিভাবে পেঁচিয়ে আছে তার উপর। আমরা আগেই জেনেছি স্ট্রিং তত্ত্বের অতিরিক্ত মাত্রাগুলো চাইলেই ইচ্ছেমত জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতে পারে না। এই প্যাঁচের আকৃতিই প্রকৃতির দৃশ্যমান নিয়ম গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে দৃশ্যমান নিয়ম বলতে, মৌলিক চারটি বল ও তাদের পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ধরন, মৌলিক কণিকা যেমন, কোয়ার্ক বা নিউট্রিনোর ভর, আধান ইত্যাদির কথা বোঝানো হচ্ছে । এভাবে স্ট্রিং তত্ত্বের নিজস্ব নিয়মগুলো থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মত প্রাকৃতিক নিয়মযুক্ত, বিভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব উদ্ভব হতে পারে। শুধুমাত্র প্রতিটি মহাবিশ্বের অর্ন্তবতী জগতকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পেঁচিয়ে থাকতে হবে। অর্ন্তবতী জগৎ তার নিজস্ব স্টাইলে পেচিয়ে থাকার কারনে তার নিয়ম উদ্ভুত হয়। কিন্ত আমাদের এই মহাবিশ্বের অর্ন্তবর্তী জগতের প্যাচ কেনো এমন হলো? আমরা কি ভাবতে পারিনা এই পেচিয়ে থাকার নিয়মটি কোন এক অদৃশ্য হাতের দ্বারা নির্ধারন করে দেওয়া বিষয় একটি বিষয়। যদি তা নাই হয় তাহলে এক একটি মহাবিশ্ব একেক রকম নিয়ম কেনো হয়? কে নির্ধারন করে এই নিয়ম? ‘প্রশ্ন আসে আমাদের মহাবিশ্বকে চালনাকারী মৌলিক নিয়ম (প্রকাশ্য নিয়ম সমূহ নয়) কিভাবে নির্ধারিত হলো?’ যদি কনওয়ের গেম অফ লাইফ খেলাতে সৃষ্টিকর্তা হতে পারেন তিনি যিনি গেমটি খেলেন। আর এই মহাবিশ্বের খেলায় এই মহাবিশ্বের নিয়ম নির্ধারনে নিশ্চয় একটি সত্ত্বা বিরাজিত ছিলেন একটি চেতনা জাগ্রত ছিলেন যিনি সকল মহাবিশ্বের নিয়ম নির্ধারন করে দিয়েছিলেন অদৃশ্যের আড়াল থেকেই। নিয়ম নির্ধারন করে দেওয়াটাই ছিলো বিষয়। র্যান্ডমলি যদি এটা নির্ধারিত হতো তবে জগৎ এতটা সুক্ষসমন্মন্ময়ের উপর ভিত্তিকরে এতটা ফাইন টিউনিং ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো না। হতো না প্রাণ উৎপাদনের মহাযাত্রা।
( অতএব আল কোরআন ঠিকই বলে বিধান বা নিয়ম আল্লার। আল্লার কাছ থেকেই এই নিয়ম নাজিল হয়েছে।)
এবং তাহারই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হইবে।”
Inflation is not a part of big-bang theory as we thought 15 years ago. On the contrary, the big-bang is the part of inflationary model’ ------ Andre Linde
বিগব্যাং শুধুমাত্র স্থান এবং সময় এর সৃষ্টি করে। সৃষ্টি করে একটি বাউন্ডারি। একটি মহাবিশ্ব। কিন্ত ইনফ্লেশন উদ্ভব ঘটায় অসংখ্য ভ্যাকুয়াম স্তরের আর সেই ভ্যাকুয়াম স্তরের কারনে ঘটে অসংখ্য বিগব্যা্গং ও অসংখ্য মহাবিশ্ব। এটাই আধুনিক বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি নিয়ে ধারনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই মহাস্ফিফতি বা ইনফ্লেশন কেন ঘটে? গানিতিকভাবে হয়তো অনেকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই ইনফ্লেশন কেনো শুরু হয় ? ইনফ্লেশনের পিছনে আদি কারন কি? কি হতে পারে ইনফ্লেশনের পিছনের ঘটনা ? এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুজতে আধুনিক বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে কিছু সম্ভাবনার কথা ভাবছেন। তবে যে মূল বিষয়টা হলো ভাবা হচ্ছে সেটি হলো ‘স্ফীতির প্রাথমিক বীজ আসতে পারে আনুবীক্ষনিক আকারের কোন বিকষণমূলক পদার্থ থেকে।” যে বীজ মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারন। এ্যালেন গুথ তার গবেষনায় দেখিয়েছিলেন মাত্র এক আউন্স ওজনের একটি ভর থেকে ইনফ্লেশন যাত্রা শুরু করতে পারে যার ব্যাস হতে পারে একটি প্রোটনের চেয়েও একশত কোটি গুন ছোট কিছু। স্ফীতির সেই ছোট বীজ ট্রিয়ন বর্নিত ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের সমান যা কোয়ান্টাম শুণ্যতা থেকে উদ্ভুত হতে পারে।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আন্দ্রে লিন্ডের চিরন্তন স্ফিতী তত্ব এসে ইনফ্লেশন এর আদি কারন কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুললো। তার মতে নিদীষ্ট সময় পর পর এই ইনফ্লেশন ঘটে। তার তত্ত্ব অনুযায়ী এ ধরনের স্ফীতি অবিরামভাবে স্ব-পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে প্রতি মূহুত্ত্ইে তৈরী করছে নতুন নতুন মহাবিশ্ব। আন্দ্রে লিন্ডের মতে মহাবিশ্ব ধ্বংশের পর কিছু একটা থেকে যায়। সেই থেকে যাওয়া বিষয়বস্তু পরবর্তীতে আরেক মহাবিশ্বে ট্রান্সফার হয়। তিনি তার লেখায় বলেন ‘মহাবিশ্ব যদি কখন ধ্বংশ হয়ে যাইও জীবনের মূল সত্ত্বাটি হয়তো টিকে থাকবে অন্য কোন মহাবিশ্বে অন্য কোন ভাবে।’
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের চূড়ান্ত কিছু সীদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে চক্রাকার মহাবিশ্ব নামক একটি তত্ত্ব। পল স্টেইনহার্ট ও নেইল টুরকের চক্রাকার মহাবিশ্ব নামক একটি তত্ত্বে বলেছেন এই মহাবিশ্ব বারে বার সৃষ্টি এবং ধ্বংশ হয়। ষ্ট্রিং তাত্তিকদের উদ্ভাবিত মেমব্রেন এই সৃষ্টি ও ধ্বংশের কারন। তারা তাদের “Endless Universe” বইয়ের মাধ্যমে এসকল তথ্য জানিয়েছেন। তাদের মতে এ মহাবিশ্বের কোন শুরু নেই শেষ নেই। এ এক চলমান বিষয়, অনন্ত, অফুরন্ত। সৃষ্টি এবং ধ্বংশের চক্রে আবদ্ধ। এই মহাবিশ্ব যেমন একদা সৃষ্টি হয়েছিলো এবং আবারও তা হবে; শুরু করবে নতুন চক্রের। আজ থেকে ট্রিয়ন বছর পর আবারও শুরু হবে নতুন চক্রের। ঘটবে নতুন সূচনা। একেকটি চক্র একেকবার মহাবিশ্বকে সৃষ্টি এবং ধ্বংশ করে।
শুধু টিকে থাকে একটি চিরন্তন সত্ত্বা। মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর ধ্বংশ হয় কিন্তু ধ্বংশের পর জীবনের মূল সত্ত্বাটি ধ্বংশ হয় না। তা টিকে থাকে অন্য কোন মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে এ বিষয়টি মেনে নিতে হয় মহাবিশ্ব ধ্বংশের পর একটি বিষয় টিকে থাকে যা চিরন্তন যা কখনও ধ্বংশ হয় না। টিকে থাকে চক্রের পর চক্র ধরে। যাকে আমরা অভিহিত করি সৃষ্টির মূল কারন আদি কারন। যার কোন ধ্বংশ নেই চিরন্তন এক সত্ত্বা। যে চেতনার প্রকাশ ঘটে শক্তি ও জ্ঞানের মহা সম্মিলন রুপে। প্রকাশ শেষে আবার ধ্বংশ হয়ে যায়। অবশিষ্ট থাকে শুন্য শক্তি যা আবার সৃষ্টির জন্য প্রতিক্ষারত।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শন ক্যারল এর বক্তব্য মতে আমরা বা আমাদের মহাবিশ্ব উচ্চ এ্যানট্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কাল থেকে এসেছি। আবার সকল জড়জগৎ ধ্বংশ হলে মুল সত্ত্বা উচ্চ এনট্রপিতে ফিরে যাবে। এখন উচ্চ এনট্র্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কাল কি? একটি চেতনা মাত্র। সেই চেতনা হতে উদ্গত এই জগৎ সৃষ্টির শুরুতে শুধু চেতনাই ছিলো যা পরবর্তীতে নিজ ইচ্ছাশক্তিতে নিজেই নিজেকে এরুপে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই রুপ স্থির নয়। একটি নিদীষ্ট সময় পর তা ধ্বংশ হবে এবং ঠিক আগের উচ্চ এনট্র্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কালে ফিরে যাবে।
মানুষ কি আবার কোথাও ফিরে যাই? এই প্রশ্নের আপত সমাধান ‘বায়োসেন্ট্রিজম’ তত্ত্ব। সম্প্রতি ‘সায়েন্স’ নামের এক জার্নালে এই তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে। এই তত্ত্বে দেখানো হয়েছে, কিভাবে কোনো শক্তির বা বস্তুর বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটতে পারে। অসীম কালে ও স্থানে মৃত্যুই শেষ কথা হতে পারে না। ‘আমি কে?’—শুধু এই অনুভূতিই মস্তিষ্কে ২০-ওয়াট শক্তি সঞ্চালন করতে পারে। এই শক্তি কি মৃত্যুর সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়? মোটেই নয়! নতুন এই তত্ত্ব বলছে, এই শক্তি এক মহবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে সঞ্চালন হয়। আর এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় ভিত্তি শক্তির নিত্যতা সূত্র। এই সুত্র মতে শক্তির অবিনশ্বরতা। তাহলে মস্তিষ্কের ওই শক্তি ঝর্না মৃত্যুর পরে কোথায় যায়?
প্রিয় পাঠক, সমগ্র মহাবিশ্ব ধ্বংশের পর কিছু অবশিষ্ট থাকে। সে ফিরে যাই তাই উৎপত্তি স্থলে। উচ্চ এ্যানট্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কালে জীবনের মূল সত্ত্বাটি ফিরে যাই। কিংবা ফিরে যাই শুন্য শক্তির গোপন কারখানায়। সেখান থেকে রিফাইন হয়ে আবার সৃষ্টি চক্রে ফিরে আসতেও পারে। তাই যদি হয় তাহলে আল কোরানের কথাই ঠিক। তোমরা আল্লার কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে জীবনের মূল সত্ত্বাটি ফিরে যাওয়াই সত্য। কারন আল কোরানও ঠিক নতুন করে আসমান জমিন সৃষ্টির বিষয়টি উল্লেখ করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৫