ফেইসবু্কের কল্যানে হোক আর আত্মীয়তার বন্ধনে, বেশ কিছু ছোট ভাই জুটেছে আমার। তারা প্রায় ই আমাকে প্রশ্ন করে। বিশেষ করে যারা প্রতি বছর আই ইউ টি তে চান্স পায়, তারা প্রশ্ন করে কোন সাব্জেক্ট নেবে। যারা পাশ করে বের হচ্ছে তারা জিজ্ঞেস করে কোথায় কোথায় এপ্লাই করবে ইত্যাদি।
অভিজ্ঞতার আলোকে জবাব দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। তবে ইদানিং বেশ কিছু ছোটভাই এর মাঝে “বিভ্রান্ত” মনোভাব লক্ষ্য করছি যা আমার মাঝেও আছে, সকলের মাঝেই কম বেশি আছে।
যেমন, একজন জিজ্ঞেস করল যে সে আই ইউ টি তে চান্স পেয়েছে, কোনটায় পড়বে…আমি জিজ্ঞেস করলাম “তুমি কোনটায় পড়তে চাও”? কোন জবাব নেই। এখানে আমার প্রথম খটকা। কোন কাজে সেটা পড়া হোক বা গীটার বাজানো বা টাকা আয় করা, সফল হতে হলে প্রয়োজন তীব্র মানসিক পিপাসা/তাড়না। এটা আপনা আপনি তৈরি হয় না। আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে। যেমন, ছোটবেলা থেকে আমার গাড়ি খুব পছন্দ। ক্লাসের খাতা ভর্তি গাড়ির ছবি আঁকা থাকত। টিচার আসার আগে ব্ল্যাক বোর্ডে গাড়ির ছবি আঁকতাম। পরীক্ষা আগে শেষ হয়ে যাওয়ায় খাতার শেষে গাড়ি এঁকে মার ও খেয়েছি ক্লাস টু তে। রুমে গাড়ির ছবি টাংগিয়ে রাখতাম ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আগে থেকেই লক্ষ্য ছিল আমি মেক্যানিকাল ইঞ্জিনীয়ার হব। আর কিছু হবার চিন্তা কখনো মাথায় আসে নাই।
সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এরকম নাও হতে পারে (শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমানে যেই প্রতিযোগীতা, তা অসুস্থ পর্যায়ের, কয় হাজার নাগরিক ভর্তি যুদ্ধে অংশ নিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে এবং এর প্রভাব তাদের বাকী জীবনে বহন করতে হয়েছে, তার তালিকা বেশ লম্বা হবে বলে আমার ধারনা)।
সবাই তার পছন্দ মত সাব্জেক্ট নাও পেতে পারে।
সেক্ষেত্রে, অন্তত তাকে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পথের কথা চিন্তা করে রাখতে হবে। যেমন ইংরেজী আমার পড়তে ভাল লাগত। সম্ভবত মেক্যানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং না পড়লে আমি ইংরেজী তে পড়তাম। যাই হোক সেটা আলাদা ব্যাপার। মোদ্দা কথা, অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে।
তবে, লক্ষ্যনীয় ব্যাপার, আমার লক্ষ্য অর্জনে আমাকে যা সবচে বেশি সহায়তা করেছে, তা হল তীব্র ইচ্ছা। আমি আই ইউ টি এর মেক্যানিকাল এই পড়তে চেয়েছিলাম। তখন আমি ক্যাডেট কলেজে পড়ি। অগ্রজ দের কাছ থেকে জেনেছিলাম এস এস সি আর এইচ এস সি এর রেজাল্ট সর্বোচ্চ রাখতে হবে এখানে পড়তে হলে। আমাদের রাতে ঘুমাতে হত ১১টায়, উঠতে হত সকাল ৫-৩০ এ। আমার মনে হল এর চে বেশি পরিশ্রম করা দরকার। আমি উঠতাম সকাল ৩-৩০ এ এবং ৫-৩০ পর্যন্ত পড়াশুনা করতাম। ঘুমাতাম মাত্র গুনে গুনে ৪-৩০ মিনিট। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হত কিন্তু অদৃশ্য কোন শক্তি/মন্ত্র বলে কোন কিছুই গায়ে লাগত না। হয়ত তীব্র ইচ্ছা টা না থাকলে এত পরিশ্রম করা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না…
মজার ব্যাপার, এত তীব্র ইচ্ছা নিয়ে মেক্যানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে আসলাম, অথচ, আই ইউ টি তে এসে আমার প্রথম দিকের রেজাল্ট খারাপ হল। কারন আমি “ফোকাস” করতে পারি নি। আমি জানতাম আমি মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এয়েছিলাম, আমি পড়ছি। আমি জানতাম না আমি কি পড়ছি, কেন পড়ছি, কিসের জন্য পড়ছি। “মেক্যানিকাল ইঞ্জিনীয়ারীং পড়ব” এই তীব্র ইচ্ছার সমাপ্তি হয় চান্স পাবার পর পর এবং আমি “বিভ্রান্ত” হয়ে যাই। অনেক চেষ্টা করেও জবাব পেতাম না। কেন রেজাল্ট ভাল হচ্ছে না। কেন মনোযোগ আসছে না। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা বুঝতে পারি। আবার লক্ষ্য স্থির করি। বি এস সি এর শেষের দিকে আবার “একজন ভাল মেক্যানিকাল ইঞ্জিনীয়ার” হবার তীব্র ইচ্ছা মনে জেগে ওঠে আর রেজাল্ট ও আল্লাহর রহমতে ভাল হয়।
উপরের বর্ননা গুলো গর্ব করার জন্যে দেই নাই (আমার সিজি কম, রেফার্ড খেয়েছি, গর্ব করার মত কিছু নাই ও আমার), বরং এইজন্যে দিয়েছি যে, একজন গড় মানের ছাত্র হয়েও আমি নিম্ন আর উচ্চ দুই মানের রেজাল্ট করতে সক্ষম হয়েছি ছাত্র জীবনে। সব কিছু একই ছিল, সুযোগ সুবিধা, আমার ব্রেইন, আমার খাওয়াদাওয়া, সব। কেবল মাত্র এক সময় মনে “তাড়না/ স্পৃহা” ছিল, আরেক সময় ছিল না। একসময় আমি জানতাম আমি কিসের জন্য পরিশ্রম করছি, আরেক সময় জানতাম না। ব্যাস, এটুকুই পার্থক্য। থার্ড সেমিস্টারের মত সোজা সেমিস্টারে ২’৬৯ আর সপ্তম সেমিস্টারের মত অপেক্ষাকৃত কঠন সেমিস্টারে ৩’৯৪ পাওয়া এর মাঝে শুধুমাত্র “স্পৃহা” এর পার্থক্য।
ফুটবলের মাঠে যেই ব্যাপারটা হয়, একটা বল নিয়ে ২২ জন খেলোয়াড় দৌড়াদৌড়ি করে। তারা তাদের ইচ্ছামত যায়গায় বলটা ঠেলে দেয়। এখন যদি এমন হত, বলটা নিজের মর্জিমত মাঠে গড়াচ্ছে আর ২২ জন সেটাকে আয়ত্ব করতে তার পেছনে দৌড়াচ্ছে, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হত। দুঃখজনক ভাবে, আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় ও খেলাটা এভাবেই পালটে গেছে।
কোন সাবজেক্ট পড়তে গেলে সবার আগে মানুষের প্রশ্ন “সাবজেক্ট এর বাজার দর কেমন, চাকরী আছে”? মজার ব্যাপার যে কোন সাবজেকট এর ক্ষেত্রে চাকুরীর সম্ভাবনা প্রায় ধ্রুবক। এমন কোন সাবজেক্ট এর নাম আপনি জানেন, যেটায় পড়ে চাকুরী পাওয়া যায় না? অথবা এমন কোন সাবজেক্ট যেটা পড়লে পাশ করার আগেই চাকুরী পাওয়া যায়? সব ক্ষেত্রেই সমীকরন সোজা, আপনি যা পড়ছেন, তা যদি কাজের উপযুক্ত হয়, আপনি কাজ পাবেন, এখানে সাবজেক্ট এর তেমন কোন মাজেজা নাই।
দ্বিতীয়ত, বেতন কেমন। এটার ও কোন ভিত্তি নাই। সদ্য পাশ করা সব সাব্জেক্ট এর ইঞ্জিনিয়ার বেতন কম বেশি একই রকম পায়। এটা জেনেও সবাই এই প্রশ্ন করেন। সম্পুর্ন ভিত্তিহীন।
এক এলাকায় যদি এক বাবুর্চি থাকেন, যিনি মন দিয়ে, স্পৃহা নিয়ে তার খাবার রান্না করেন, তবে তার আয় একজন ডাক্তার/ইঞ্জিনীয়ার এর চে বেশি বই কম হয় না…তার মানে কি রন্ধনশিল্প চিকিৎসা শাস্ত্রের চে অনুন্নত/উন্নত/সমুন্নত? কোনটাই না। জবাব হল, কি করছেন সেটা মুখ্য না যতক্ষন আপনি মন দিয়ে এবং ভালবাসা নিয়ে কাজটা করছেন।
তবে হ্যাঁ, “প্রস্পেক্ট” নিয়ে চিন্তা কর দোষের কিছু না বরং লাভজনক। যেমন বর্তমানে বাংলাদেশে জাহাজ শিল্প, রড শিল্প, যন্ত্রাংশ সংযোজন শিল্প দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। মেক্যানিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং এর “প্রস্পেক্ট” ভাল। তবে এটা ভবিষ্যত। বর্তমান নয়। এটা আপনার সিদ্ধান্ত নেবার পথে সহায়ক হতে পারে, মূল কারন হতে পারে না মোটেই !!!
এবং দূঃখজনক ভাবে, সব ক্ষেত্রে, “প্রেস্টিজ” ইস্যু একটা বড় ব্যাপার, এক্ষেত্রে আমি আমাদের প্রজন্ম কে দোষ দেই না, আমাদের মাঝে আমাদের আগের প্রজন্ম বেশ কিছু বিষাক্ত বীজ বপন করে দিয়েছেন তাদের অজান্তে, এটা তার মাঝে একটা। “ডাক্তার/ইঞ্জিন্যার/ব্যাঙ্ক চাকুরে” ছাড়া আর কিছু হলেই মান ইজ্জত থাকবে না।
অথচ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তে কৃষিকাজ করে একজন বিজ্ঞানের ছাত্র মাসে ৪/৫ এমনকি বড় স্কেলে ২০-৩০ জন বি এস সি পাশ ইঞ্জিনীয়ারের সমান টাকা আয় করতে পারে। এটা জেনেও না জানার ভান করি আমরা।
অতেব, ছোট ভাই দের প্রতি আমার অনুরোধ, একটা কলম আর একটা পেইজ নিয়ে একাকী কোথাও বসে পড়। তারপর নীচের প্রশ্ন গুলোর উত্তর হিসেবে যতগুলো সম্ভব পয়েন্ট নোট কর। দরকার হলে, তথ্য লাগলে নেট ব্রাউজ কর, অথবা কাউকে জিজ্ঞেস কর।
কমপক্ষে ১০ টা করে পয়েন্ট থাকা উচিৎ প্রতি প্রশ্নের উত্তর হিসেবে।
একই রকম উত্তর দুইবার থাকলে কেটে দিবে। ঐ যায়গায় অন্য কিছু খুঁজবে।
১।কি পড়তে চাও?
২। কেন পড়তে চাও?
৩।এটা পড়ে আজ থেকে ১০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাও? (সবচে গুরুত্বপূর্ন)।
৪। এই শিক্ষা বাস্তব জীবনে তোমাকে কোন কোন পদে সাহায্য করবে?
৫। এই শিক্ষা তোমাকে একজন পরিপূর্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে কি? যদি পারে, কেন? যদি না পারে, কেন?
৬। এই বিষয় পড়ার ক্ষেত্রে তোমার প্রধান অন্তরায়/বাধা কি কি? কিভাবে তুমি সেগুলো অতিক্রম করতে পারবে?
ঘন্টা/২ঘন্টা সময় নিয়ে লিখার পর অবসরে কাগজ টা নিয়ে নড়াচাড়া করলে দেখবে অনেক প্রশ্নের উত্তর, যা তোমার মনের গভীরে লুকিয়ে ছিল, বেরিয়ে আসবে এবং তুমি আরো সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
সব শেষে, মনে রাখবে, সিদ্ধান্ত আসলে তোমার। এবং এ ক্ষেত্রে তোমার বড় সহায়ক বাবা/মা/বড় ভাই বা আত্মীয় স্বজন। তাদের বোঝানোর চেষ্টা কর। তাদের কাছে তোমার গোছানো যুক্তি তুলে ধর। এবং নিজের জীবনের বড় সিদ্ধান্ত গুলোর বড় অংশ নিজে গ্রহন কর।. ১০-১৫ বছর পর যদি মনে হয় “অমুকের কথায় কান দিয়ে ঐটা পড়লাম না, বা অমুকের কথায় কান দিয়ে ঐটা পড়লাম, একটু যদি খোঁজ নিতাম, একটু যদি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতাম, আজ মনে এই ক্ষোভ থাকত না” তবে বাকী জীবন পার করতে বেশ কষ্ট হবে…
CHANGE THE GAME, BE THE GAME CHANGER.
DO NOT LET THE GAME CHANGE YOU !!
সবার জন্য শুভকামনা। ব্যাস্ততার মাঝে লিখেছি ভূল ত্রুটি থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী। কেউ কোন মন্তব্যে আঘাত পেয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী।