somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ- কেমন ছিল তার মৃত্যু দৃশ্য?

২৭ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। কেউ বলে ইতিহাসের কুখ্যাত নায়ক, কেউ বলে কলঙ্কিত শাসক। তার শাসনামলে অন্যায়ের ফিরিস্তি পড়লে পাথরের হয়তো কান্না আসবে। পান থেকে চুন খসলেই ঝরে যেত প্রাণ। গাছের পাতার মতো। তার সামান্য রাগের ঝাঁকুনিতে তরতর করে মানুষের মাথা পড়ে যেত দেহ থেকে। সেসব শাস্তির নিত্যনতুন পথ ও পন্থা আজকের এত বছর পরও গা ছমছম করে।

শরীরের ভাব ভালো মনে হচ্ছেনা। হাজ্জাজ বুঝে ফেলেছেন, সময় তার শেষ। মৃত্যু এখন মাথার উপর। আর কিছুক্ষণ। তারপরই তার চিরদিনের জন্য নিথর হয়ে যাওয়া। কয়েকদিন ধরেই তার শরীর দূর্বল হয়ে আছে।
এই শেষবেলায় তিনি সর্বসাধারণকে অনুমতি দিলেন দর্শনের। উৎসুক প্রজারা তাকে ঘিরে বসে পড়েছে চারপাশে। অসুস্থ হাজ্জাজকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। চরম অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে তার চেহারা চাহনীতে। লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাজ্জাজেরও কি মরণ আছে?

নীচু গলায় হাজ্জাজ কথা বলছেন। আজকে আর কোন হুকুম নয়। কারো মৃত্যু পরোয়ানাও নয়। তিনি নিজের কথা বলছেন। মৃত্যুর কথা বারবার জপছেন। কবরের কথা, একাকিত্বের কথা শোনাচ্ছেন মানুষকে। দুনিয়া এবং এর ক্ষণস্থায়ী মেয়াদের কথাও বলছেন। জীবনের এই পড়ন্তবেলায় তিনি নিজের অপরাধ নিয়েও চিন্তিত। হয়তো নিজের অজান্তে তার আশপাশের সবার কাছে স্বীকার করছেন, আমার অপরাধ সীমাহীন। গোনাহ অসীম। তারপর কবিতা আওড়ে শোনালেন, আকাশ পৃথিবীসম আমার পাপরাশি, তবুও স্রষ্টার কাছে আমার আর্তি, তাঁর দয়া আমার জন্য সম্ভাবনা, হিসাবে শুধু শাস্তি আমার পাওনা, তিনি কখনো জুলম করেননি, যার কাছে সব ভালোর মিনতি, তিনি কি কঠোর তার অধমের প্রতি?' কথায় কথায় নিজের রচিত কবিতা আবৃত্তিতে তার সুনাম ছিল্।

প্রবল শক্তিধর পাষাণ হৃদয়ের হাজ্জাজের চোখে পানি। তিনি কাঁদছেন। এমন মানুষের কান্না দেখে আশেপাশের মানুষও কাঁদছে।

তারপর তার পত্রলেখককে ডাকালেন। তারপর প্রধান খলিফার কাছে চিঠি লিখলেন, মুহতারাম খলিফাতুল মুসলিমীন ওলিদ বিন আব্দুল মালিক! আমি আপনার ছাগলপালের একজন রাখাল। আপনার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য আর ভালোবাসা নিয়ে আমি এ চারণভূমিতে পাল পাহারা দিয়েছি। কিন্তু বাঘ এসে পড়েছে, গোটা পাল এবং ভূমিকে তছনছ করে ফেলছে, আপনার এ গোলামপ্রহরীর উপর যে কঠিন বিপদ এসেছে, তাতে আইয়ুব আ. এর মতো ধৈর্য নিয়ে আমি প্রহর গুণছি। আমার আশা, পরাক্রমশালী মালিক আল্লাহ তার এ ক্ষুদ্র বান্দার সব অপরাধ এবং ভুল মার্জনা করে দিবেন।’

তারপর চিঠির শেষে একটি কবিতাও লিখতে বললেন, হাজ্জাজ বলে চলেছেন, দয়াময়কে যদি খুশী পেয়ে যাই, মনের সব বেদনা ওখানেই ভুলে যাই। সব চলে যাক, তার রয়ে যাওয়া আমার জন্য কাঙ্খিত, সব ধ্বংস হয়ে যাক, তার দান আমার জন্য যথেষ্ট। যারা চলে গেছেন, তারাও তো এ স্বাদ পেয়েছেন মৃত্যুর, আমরা তাদের পরের, এ যন্ত্রণা এখন আমাদের। আমি চলে যাব, আপনি আমায় মনে রাখুন, ভালোবাসা দিয়ে জীবনভর যে আপনাকে মনে রেখেছিল।

হাজ্জাজের মৃত্যু সময়ের ব্যাপার। এ সংবাদে ছুটে আসছে মানুষ। তার ভয় আজ আর নেই। অনেকের সাথে চলে এসেছেন একজন সাধক পুরুষ। তার নাম আবুল মুনযির। পুরো নাম ইয়ালা বিন মুখাল্লাদ আল মুজাশী। তিনি এসেছেন হাজ্জাজের শেষ বেলার তামাশা দেখতে। এই জালেমটা যাওয়ার আগে কী করে যায়, দেখা দরকার।

তিনি এসে হাজ্জাজকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন? মরণের কষ্ট কেমন লাগে আপনার?

হাজ্জাজের চোখে মুখে আজকে আর রাগ নেই। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছেন তিনি। অসহায়। জোরে কথা বলারও শক্তি নেই। নীচু গলায় তিনি তার প্রশ্নের উত্তর জানাচ্ছেন, জনাব ইয়ালা! অনেক কষ্ট, বিরাট দুশ্চিন্তা, অসহনীয় ব্যাথা! মুখের থুথু শুকিয়ে যাচ্ছে বিপদের আশংকায়! অনেক দূরের যাত্রা এবার, অথচ সাথে কিছু নেই আমার। আমি শেষ! আমি হতভাগা! দূর্ভাগা আমি! শক্তিমান মালিকের দয়া করুণা না পেলে আমি শেষ!

সারাটা জীবন যার ভয়ে তটস্থ থেকেছে রাজ্যের মানুষ। তাকে কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আবুল মুনযির তো আর তামাশা দেখতে আসেননি শুধু, কিছু বলতে এসেছেন, যা তিনি এতদিন মনের ভেতর পুষেছেন।

হাজ্জাজ! আল্লাহ পাক শুধু দয়াবান, দাতা এবং কোমল মনের মানুষকে দয়া করেন। যারা তার সৃষ্টিকে ভালোবাসেন, কাছে টানেন। আমি সবাইকে সাক্ষি রেখে বলছি, যে অন্যায় আর নির্যাতন তুমি করেছো মানুষকে, পূণ্যবানদেরকে যেভাবে কষ্ট দিয়েছো, সত্য কথাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়েছো, তাতে তুমি এ যুগের ফেরাউন হয়েছো, তুমি এ সময়ের হামান। জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে তুমি মেরে ফেলেছো, অন্যের কথা শুনতে গিয়ে নিজের স্রষ্টার সাথে অবাধ্য আচরণের দুঃসাহস দেখিয়েছো, আহা! তুমি কত অসংখ্য মানুষকে নিঃশেষ করেছো, কত বুক খালি করেছো, হিংস্র এবং অহংকারের রাজনীতি দিয়ে তুমি শাসন করেছো আমাদেরকে। নিজের দ্বীনকে নষ্ট করেছো, দুনিয়াকেও অতিষ্ঠ করে ফেলেছো। তুমি মারওয়ান গোষ্ঠীকে সম্মান দিতে গিয়ে নিজেকে অপদস্থ করেছো। তাদেরকে সাজাতে গিয়ে নিজের সব শেষ করে ফেলেছো। কোথায় তারা! আজকে তো তারা তোমার জন্য কিছুই করছে না। এ দিনই শেষ। আর কোন দিন নেই তোমার। তুমি এ মুসলিম উম্মাহর সবার উপর বোঝা হয়ে ছিলে, আমাদের আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ তুমি ছিলে, আহ! সব প্রশংসা সেই পরম করুণাময়ের, তিনি আজ তোমার মত ত্রাস থেকে আমাদেরকে স্বস্তি দিচ্ছেন। আমরা মুক্ত হচ্ছি তোমার অত্যাচারের কবল থেকে। তোমার লাঞ্চনা থেকে উদ্ধার করে দয়াময় আমাদেরকে আজ ধন্য করেছেন।’

থামলেন আবুল মুনযির। এতক্ষণ ধরে গমগম আওয়াজ থেমে গেল চারপাশেও। যেন ঝড় থেমে গেল। নিঃশব্দ পরিবেশে শুধু শোনা যাচ্ছে উপস্থিত মানুষগুলোর ঘনঘন শ্বাস নেওয়ার শব্দ।

হৃদয়ের আবেগ থেকে ছুটে আসছিল আবুল মুনযিরের কথাগুলো। যেন শত শত বছর কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল এ ক্ষোভের উৎসমুখে। শাসক হাজ্জাজ একদম নিশ্চুপ। আজকে তার বলার কিছুই নেই। সময়ও নেই। যার চোখের ইশারায় দেহ-মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত অজস্র প্রজার, সেই হাজ্জাজ শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বক্তার দিকে। চেহারাজুড়ে তার হতাশা ছড়িয়ে আছে। আশেপাশের নির্বাক মানুষগুলোও এমন দৃশ্যে পাথর হয়ে আছে। হাজ্জাজ কি কিছুই বলবেন না তাকে!

হাজ্জাজ সোজা হয়ে বসতে চাইলেন। তারপর। আবুল মুনযিরকে কিছু বলার সময় নেই তার। সে তো আর অসত্য কিছু বলেনি। প্রবল ভয় আর অস্থিরতা গ্রাস করেছে হাজ্জাজের ভেতর। তার শ্বাস ভারি হয়ে আসছে। মুখ হা করে কি যেন বলতে চাইছেন তিনি। সবার আগ্রহ তার দিকে। অস্ফুট সুরে হাজ্জাজ কবিতা পড়ছেন, ওগো দয়াময়! তোমার বান্দারা আমাকে হতাশ করে দিল, এমন নিরাশায়- আমি পথ চেয়ে আছি তোমার অসীম করুণার প্রত্যাশায়।’

আওয়াজ থেমে গেছে। মুখ বন্ধ হয়ে এল হাজ্জাজের। বিশ্বকাঁপানো হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ঢলে পড়লেন এক পাশে। তার প্রাণপাখি তখন আকাশের পথে।

৯৫ হিজরীতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মৃত্যু হয়। তার বয়স তখন মাত্র ৫৩। পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে তার এ মৃত্যু। বিশিষ্ট তাবেয়ী সাঈদ বিন জুবায়ের রা.কে নির্মম ভাবে হত্যার কিছুদিন পর তার এ অসুখের সূচনা এবং এ রোগেই শয্যাশায়ী ছিলেন। মৃত্যুর সময়টায় তিনি বাস করতেন ইরাকের বাগদাদ থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে ওয়াসিত নামক একটি মনোরম ছোট্ট উপদ্বীপে। এ শহরটি তিনি নিজেই নির্মাণ করিয়েছিলেন প্রায় আট বছর ধরে।

হাজ্জাজের মৃত্যু সংবাদে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন ঐ সময়ের বেঁচে থাকা বুযুর্গ এবং তাবেয়ীরা। যারা সাহাবাদেরকে দেখেছেন এবং তাদের সাহচর্য পেয়েছেন, তাদেরকে তাবেয়ী বলা হয়।

প্রখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. বলতেন, হাজ্জাজ আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব, তোমরা এ আযাবকে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে যেও না। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ আর খোলা নেই।’

বনু উমাইয়ার শাসকদেরকে খুশি করার জন্য ঠান্ডা মাথায় হাজ্জাজ খুন করেছিলেন এক লাখ বিশ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে সাহাবী, তাবেয়ী, বুযুর্গসহ অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ রয়েছেন।

এত অন্যায় এবং জঘন্য পাপাচারের পরও বাগ্মিতা, কাব্যচর্চা এবং কুরআন শরীফে পারদর্শিতায় হাজ্জাজের নাম এখনও ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তবে তার এ সব ভালো কাজ এবং যা কিছু পূণ্য- তা তার অন্যায়ের সাগরে সামান্য কয়েক ফোঁটা জল।


এখানে কোন কপি পেস্ট নেই। ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহ থেকে এসব তথ্য আমার সংগৃহিত এবং অনূদিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:৫৯
১৪টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×