somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাহতিম শাকিবঃ এক গানের পাখি

১১ ই জুন, ২০১৮ ভোর ৬:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো চালু হবার পর “ভাইরাল” নামে একটি শব্দের প্রচলন ব্যাপকভাবে হচ্ছে। এক সময় “টক অব দ্যা টাউন”, “টক অব দ্যা কান্ট্রি” বলে একটা বিষয় ছিল। এরই বিবর্তনে এসেছে “ভাইরাল”। কিছুদিন পরপরই কিছু কথা, গান, নাচ বা কোন মুখরোচক বিষয় ভাইরাল হয়ে আসে নেট দুনিয়ায়। ভাইরাল বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে; মুগ্ধতায় ভাইরাল, মানবিকতায় ভাইরাল, প্রতিবাদে ভাইরাল, ব্যঙবিদ্রূপ-উপহাস-অট্টহাস্যে ভাইরাল। ভাইরালের স্রোতেই ভেসেই গত ২২ মে’১৮তে ইউটিউবে এসেছে মাহতিম শাকিব। অবাক করা মুগ্ধতায় ভাইরাল। সঙ্গীত সাধনায় এক ঋদ্ধ মানুষ এই শাকিব। গানের পাখি। কোকিল যেমন তার আপন কণ্ঠে ডেকে উঠলে সুরের অনুভূতিতে আমরা আচ্ছন্ন হই, পূর্ণতা পায় বসন্ত। তেমনি মাহতিম শাকিবের কণ্ঠ থেকে নিসৃত সুরের মূর্ছনায় আমরা আপ্লুত হই, অভিভূত হই। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ এই এত্তটুকু ছেলে শাকিবের কণ্ঠে এতো মুন্সিয়ানা আসে কোত্থেকে!

জুলিয়াস সিজার রাজা ফার্নাসেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে প্রায় বিনা বাধায় জয় করেছিলেন, তাঁর এই সহজ বিজয়কে তিনটি ল্যাটিন শব্দে যেমন বিধৃত করেছেন, “ভিনি, ভিডি, ভিসি”। মাহতিম শাকিবএর সাফল্যও অনেকটা সেরকমই। তিনি এলেন, গান গাইলেন, আমাদের হৃদয় জয় করলেন। চমকে দিলেন। সাধারণতঃ চমকের স্থায়িত্ব খুবই ক্ষীণ হয়। শাকিবের এ চমক ক্ষীণ বলে মনে হয় না। এই চমকটা দেবার আগের প্রস্তুতিটা কিন্তু একদিনের ছিল না। দীর্ঘ এগারোটা বছরের ত্যাগ, সাধনা ছিল। এগারো বছর ধরে সে ধৈর্য ধরে ক্লাসিক সংগীতের চর্চা করেছে। সংগীতের ভীতকে মজবুত করেছে, নিজেকে তৈরি করেছে এবং করছে। হাতের যাদুকরী সঞ্চালনে গিটারকে আয়ত্বে এনেছে দারুণ দক্ষতায়।

তারকা খ্যাতির বর্তমান যুগে অনেকেই খুব সহজে তারকা বনে যান, আবার ঝলসে ওঠে ফুৎ করে নিভে যান, ছিটকে পড়েন অজান্তেই। শাকিব এখন তারকা হয়েছে, কঠোর চর্চা করে নিজেকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে, ছিটকে যাবার মতো না। তবে খ্যাতির ব্যাস্ততার নেশায় যেন এখন না ধরে, এটাও খেয়াল রাখতে হবে। এই ক্রেজি সময়ে কিছু স্টেজ শো বা মিডিয়ার প্রোগ্রাম করা যায়, কিন্তু নিজেকে আরো ভাল করে তৈরি না করে এধরনের ব্যাস্ততায় ডুবে গেলে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। মিডিয়া পলিটিক্স খুব পঙ্কিল। বন্ধুরূপী শত্রুর অভাব নেই এখানে। ব্যাপারে সাবধান না হলে যেকোন সময় অনেক ক্ষতি মুখে পড়তে হতে পারে। ক্যারিয়ারের পিছনে না ছুটে শাকিব নিজেকে ঠিকভাবে তৈরি করতে পারলে ক্যারিয়ার তাঁর পেছনেই ছুটবে, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও গড়ে ওঠবে ক্যারিয়ার।

তাঁর কথায় যে বিনয়, যে প্রজ্ঞা লক্ষিত তা আজকাল কম মানুষের মাঝে পাওয়া যায়। মেধাবী তরুণ মাহতিম শাকিবের কথা শুনে ক্রমশঃই অভিভূত হই। নিশ্চয়ই এর পেছনে তাঁর পরিবারের সচেতনতা, যথোপযুক্ত শিক্ষা এবং পরিবেশ সমর্থন দিয়েছে। নিজের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করতে শিখিয়েছে। এ বছর মাত্র মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছে যে ছেলেটি, তাঁর ভেতরে রবীন্দ্রনাথ বাসা বেঁধেছেন! শুধু রবীন্দ্রনাথের গানই নয়, তাঁকে অন্তরে ধারণ করে, উপলব্ধি করে শাকিব। চোখ মুদে ঋদ্ধ ঋষির তপস্যার মতো করে মৃদু হাস্যে কি অবাক করা সুরের ঝর্ণা বইয়ে দেয় সে। আমি অবাক হই। তাঁর জন্যই শতাধিক বছর আগে হয়তো কবিগুরু লিখে গেছেন,
তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী,
অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।
সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে,
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।

কেউ হয়তো শাকিবের সংগীতে ভুল ধরবেন। একটা কথা ভুললে হবে না, ইন্দ্রানী সেন যেভাবে একটা গান উপস্থাপন করেছেন, ডঃ সনজিদা খাতুন কিন্তু সেভাবে করেননি, রেজোয়ানা চৌধুরী তাঁর নিজের ঢঙে গেয়েছেন। সাগর সেন যেভাবে গেয়েছেন, শ্রীকান্ত আচার্যর গায়কী ভিন্ন। বাণী এক থাকলেও গায়কীর কারণে সুর, লয় কিছুটা পরিবর্তিত হতেই পারে, তা না হলে সেই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গাওয়া গানগুলোই কেবল শ্রুত হতো। অন্য শিল্পীদের আর গাওয়া হতো না। সময়ের সাথে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গতি পরিবর্তিত হয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে পরিবর্তিত হয়। গিটার আজকাল তারুণ্যের অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গিটার নিয়ে তরুণ শিল্পীরা গান করছে, আধুনিক গান, ব্যান্ড গান, লোক গান, রবীন্দ্রনাথের গানসহ বিভিন্ন ধারার গান। গিটার সহজ বহনযোগ্য বাদ্যযন্ত্র, যা দিয়ে অনেক সুর অনায়াসেই আয়ত্ত করতে পারেন আজকের তরুণরা। গিটারের মূর্চ্ছনা তুলে শাকিব যখন গায়, অসাধারণ সমন্বয় হয় তাঁর সুরের সাথে, গায়কীর সাথে। এটাই মূল কথা। সংগীতের প্রধান যে ধারা উচ্চাঙ্গ ধারা, এ ধারার সাধনা করেছে শাকিব সে শিশুকাল থেকেই। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিল্পীদের থেকেই সে অনুপ্রাণিত হয়েছে। তাই তাঁর থেকে সুরের বিকৃতির সম্ভাবনা হবে বলে মনে করি না।


রবীন্দ্র সঙ্গীত ছাড়াও শাকিব বিভিন্ন গান করেছেন। সুললিত সুমিষ্ট সুরের পুরোনো দিনের বেশ কিছু গান শুনেছি, সময়কে উত্তীর্ণ করেছে সে সব গান। করছেন লালন সংগীত, লোক সঙ্গীত। বাংলা গান ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার বেশ কিছু গান করেছে সে। প্রত্যেকটি গানেরই নিজস্ব সুরটি ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। বয়স বিবেচনায় বিরল এই প্রতিভা। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ হলেও তাঁর পরিবেশিত প্রতিটি গানেই পরিকক্কতা রয়েছে, রয়েছে তাঁর মুন্সীয়ানাও। এ বিষয়টা লক্ষ্যণীয় সে যখন যে গানটাই করেছে, তার সুরটি অক্ষুণ্ণ রেখেই করেছে, তাতে সাপোর্ট দিয়েছে তাঁর অনাবীল কণ্ঠ। এতোটা সাবলীল তাঁর গানের মূর্চ্ছনা, গান করার সময় যে দম নেওয়া লাগে, সেই দমটা যে শাকিব কখন নেয়, বুঝাই দুষ্কর। সঙ্গীতের বারোটি সুর নিয়েই তাঁর সাধনা। শাকিব সুরকে ধারণের অনুশীলন করে।

অপরিণত বয়সের মাহতিম শাকিবের কণ্ঠ দরাজভাবের নয়; মোলায়েম, সুললিত এবং একই সাথে প্রচন্ড বলিষ্ঠ। কেউ কেউ আতিশয্যে তাঁকে জুনিয়র অরিজিত বলে অভিহিত করছে। সত্যি কথা, মাহতিম শাকিব কিন্তু মাহতিম শাকিবই। অন্য কারো নামে অভিধায় তাঁকে ভূষিত করার প্রয়োজন নেই। সে আপন আলোয় উদ্ভাসিত নক্ষত্র, অন্যের আলোর ছায়া তাঁর প্রয়োজন নেই। সে তাঁর নিজের স্টাইল, এক্সপ্রেশন দিয়ে সঙ্গীত উপস্থাপন করেন। এই স্টাইলটা দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে। আর মুগ্ধ করেছে বলেই শাকিবের সংগীত ভাইরাল হয়, হচ্ছে, এবং পজিটিভলি হচ্ছে। শাকিব ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত বর্তমানে বাঙালীর ঘরের ইউটিউব। এই রেশ এক সময় স্থিতিশীল হয়ে আসবে। সময় নিয়ে শাকিব নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলবে, সেটা আবার অন্তরালে গিয়ে হলেই বেশি ভাল। কারণ খ্যাতির বিড়ম্বনায় আর ব্যাস্ততায় তাঁর চর্চা ব্যাহত হতে পারে। পরবর্তি শাকিবকে সঙ্গীতের বিশ্ব দরবারে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবেই দেখতে চাই।

মাহতিম শাকিব গানের মানুষ। যতদূর জানা যায় সুরের সঙ্গেই বেঁধেছেন তাঁর প্রাণ। ইচ্ছে আছে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সঙ্গীতের উপর উচ্চশিক্ষা লাভ। সেখানকার সাংস্কৃতিক আবহাওয়ার সাথে এদেশের সংস্কৃতির ফারাক বিস্তর। তারপরও শিল্পীর আত্মসচেতনতাই তাঁকে স্বীয় সংস্কৃতির বন্ধনে অটুট রাখে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য রবি শঙ্করও সুদীর্ঘদিন পাশ্চাত্যে থেকে ভারতীয় সঙ্গীতকেই শুনিয়েছিলেন, চিনিয়েছিলেন। উত্তরসূরি হয়ে মাহতিম শাকিবও হয়তো ওভাবেই বাঙালীর সংস্কৃতি তথা সংগীতকেই তুলে ধরবেন বিশ্ব দরবারে। বিশ্ববাসী তন্ময় হয়ে শুনবে বাংলার সুরেলা গানের ঝংকার।

শাকিবের স্বপ্ন “গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড” জয়ের। চিত্তের দৃঢ়তা থাকলে, কঠোর সাধনায় ব্রতী হলে এটা খুব অসম্ভব হবে না তাঁর জন্য। এই ছেলে একদিন দেশের গৌরব বয়ে আনবে। শুভকামনা মাহতিম শাকিবের জন্য।

[যারা শাকিবের বিষইয়টি পড়ে আগ্রহী হয়েছেন, ইউটিউবে কয়েকটি গানের লিঙ্ক দেওয়া হলো, এছাড়া গুগুলে “মাহতিম শাকিব” বা “Mahtim Shakib” লিখে সার্চ দিলেও পাবেন।]
লিঙ্ক এক
লিঙ্ক দুই
লিঙ্ক তিন
লিঙ্ক চার
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৮
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×