আপনার যদি সময়, টাকা আর ইচ্ছা থাকে তবে জগৎ ঘুরে বেড়ানোটা আহামরি কোনো কঠিন কাজ নয়। এর মধ্যে লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ১১ হাজার মাইল তো আপনি পাড়ি দিতে পারবেন ট্রেনেই। তবে কম্বোডিয়ায় এসে আপনাকে কিছুটা হোঁচট খেতে হবে। কারণ এখানকার যোগাযোগব্যবস্থা আর সব জায়গার মতো নয়। একটু ভিন্ন। ভিন্নতায় চমৎকৃত হওয়ার ক্ষমতা যদি আপনার থাকে, তবে অবশ্য হোঁচটই হয়ে যেতে পারে আপনার জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
হোঁচট কেন খাবেন, সেটা বলি—আপনি তো ট্রেনে ঘুরতে বেড়িয়েছেন। কম্বোডিয়ায় এসে দেখলেন, এখানে রেললাইন পাতা আছে। কিন্তু ট্রেন চলে না। রেললাইনগুলোর ওপর দিয়ে চলে এক আজব যান। ইংরেজ বলিয়েরা এর নাম দিয়েছে ‘ব্যাম্বো ট্রেন’। কিন্তু স্থানীয়ভাবে একে বলে ‘নোরি’। এগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বাঁশ, পুরোনো ট্যাংকের যন্ত্রাংশ, পরিত্যক্ত মোটরগাড়ির মোটর, ধান মাড়াইয়ের মেশিন, ট্রাক্টর। রেললাইনের সমান দূরত্বে দুই জোড়া করে চারটি চাকা রেখে তার ওপর ফেলা হয় আমাদের দেশের বাঁশের মাচার মতো বাঁশের পাটাতন। বিশাল আকারের এ পাটাতন চারপাশে লোহার পাত দিয়ে ঘিরে মজবুত করা হয়। তারপর চার স্ট্রোকের মোটর দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হয় তা। এর মোটরও চালু করা হয় সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে। একটি লাঠি লিভার হিসেবে ব্যবহার করে চালক মোটরটাকে কিছুটা পেছনের দিকে টেনে গড়িয়ে তারপর চালু করেন সেটা। মোটর চালু থেকে শুরু করে যাত্রার পুরো সময়ই কিন্তু দুর্ঘটনার প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় এটি লাইনচ্যুত হতে পারে, আগুন লেগে যেতে পারে। আমাদের দেশে নছিমন, করিমনের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এগুলো। কম্বোডিয়ার বাতামবাং থেকে রাজধানী নমপেন পর্যন্ত প্রত্যন্ত এলাকায় চলাচল করে এই নোরিগুলো। যাতায়াতের আর তেমন কোনো উপায় না থাকায় শাকসবজি থেকে মানুষ—সবই পরিবহন করা হয় এতে। মাথার ওপর কোনো ছাদ না থাকায় দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে প্রচণ্ড রোদ আর তাপেও পুড়তে হবে আপনাকে। উল্টো দিক থেকে যদি আরেকটি নোরি আসে, তবে যেকোনো একটিকে রেললাইন থেকে সরে পাশের মাঠে যেতে হয়। তারপর ওটি চলে গেলে আবার এটিকে পথে তুলে যাত্রা শুরু করতে পারেন চালক। কাজেই মুখোমুখি দুটি নোরির সংঘর্ষের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
১৯২০ সালে কম্বোডিয়ায় পাতা হয়েছিল রেললাইন। তারপর এই আধুনিক যুগেও দেশটির যোগাযোগব্যবস্থার এ রকম দশার পেছনে কিন্তু রয়েছে এক কষ্টকর অতীত। ১৯৫৩ সালের দিকে এখান থেকে ফরাসিরা তাদের পাততাড়ি গোটালেও দেশটিকে উপনিবেশের বৈশিষ্ট্য মেনেই জড়িয়ে পড়তে হয় গৃহযুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে ক্ষমতায় আসে খেমারুজরা। তাদের দমন-নির্যাতনে ১৯৭৯ সালের মধ্যে দেশটির জনসংখ্যা ২০ শতাংশ কমে যায়। খেমারুজদের পতনের পর গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয় দেশটিতে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলা এ গেরিলা যুদ্ধেই মূলত ধ্বংস হয় দেশটির রেল যোগাযোগ। গেরিলারা প্রায়ই উড়িয়ে দিত রেললাইনগুলো কিংবা হামলা চালাত ট্রেনগুলোর ওপর। এখনো নাকি দেশটির রেললাইনে পেতে রাখা মাইন পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেই যে ধ্বংস হলো রেলব্যবস্থা, তারপর আর গড়ে তোলা যায়নি তা। ন্যূনতম যেটুকু ছিল, তাও কয়েক বছর ধরে বন্ধ। তো কী আর করা। সেই পরিত্যক্ত রেলপথকেই কাজে লাগিয়ে এই নোরির জন্ম।
যা-ই হোক, সব ঝুঁকি আর কষ্টকে অভিজ্ঞতা হিসেবে নিলে এসব
নোরিতে চড়ে আপনার শিহরণের কমতি যে হবে না, এটা কিন্তু নিশ্চিত। চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি এ ধরনের শিহরণকে আপনি বাড়তি পাওনা হিসেবে তো নিতেই পারেন।