১.
কখনো এক একটা সকাল আর দশটা সকালের চেয়ে অন্যরকম। ঘুম থেকে উঠেই অফিস যাওয়ার ব্যস্ততা নেই, তাই একটু বেশি সময় বিছানায় গড়িয়ে নেয়া। মায়ের ডাকাডাকি, আলসেমি আর লেপের উষ্ণতা যখন একে অপরের সাথে সমঝোতায় ব্যস্ত তখন রাতজাগা ঘুমক্লান্ত চোখে দ্বিধান্বিত আমার ব্রাশ হাতে বারান্দায় দাঁড়ানো। রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে কুয়াশায় জড়সড় শহরটাকে দেখি। ছুটির দিন বলে ব্যস্ততা নেই। শুধু সাপ্তাহিক বাজার সেরে নিতে কেউ কেউ বেরিয়েছে। দু'একটা হকার টুংটাং শব্দে দ্রুত প্যাডল চালিয়ে কোথাও উধাও হয়ে গ্যালো। দেয়ালের ওপাশের ইউক্যালিপটাস গাছগুলো এই সকালে বড় বেশি চুপচাপ। কুয়াশার গাউন পরা এশহরকে আড়মোড় ভেঙ্গে জেগে ওঠা কোন এক কুমারী তন্বী'র মতো মনে হয়। যার দিকে শুধু মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকা যায়, অনুভব করা যায়। ব্রাশ হয়ে গেলেও তাই রেলিংয়ে ভর দিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।
২.
কখনো রুপো রঙ'য়ের দুপুরগুলো নিঝুম থেকে নিঝুমতর হয়ে উঠে। তখন দোয়েলের শুদ্ধ সুরে স্নান সেরে নেয়া এই ইট পাথরের বাড়ীগুলোকে বড় অলৌকিক মনে হয়। মনে হয় ঘর ছেড়ে গলির মুখে দাঁড়ালেই আমাকে অভিবাদন জানাবে বাংলাদেশে শীত উদ্যাপন করতে আসা শত শত পেঙ্গুইন। কী এক যাদুবলে দুপুরের রোদ বিভ্রান্ত আমাকে নিয়ে গ্যালো তোমার বাড়ীর নির্জন পার্ক অবধি। বারান্দায় স্নান শেষে তোমার দাঁড়ানোর বঙ্কিমভঙ্গিমা, তোমার চুলে রোদের বিনম্র আঙ্গুল, একটা রঙ্গিন প্রজাপতির সাথে আনমনে কথা বলা এ'সব কিছু সত্ত্বেও শীতের ঐ ধূসর পার্ক পেরিয়ে আমার আর তোমার কাছে যাওয়া হলো না। কোন কারণ নেই তবু হৃদয় কিরম খাঁ খাঁ এখন। এই আশ্চার্য্য মধ্যদুপুরে!
৩.
কখনো বড় অস্হির হয়ে উঠে কোন কোন শীতসন্ধ্যা। ব্রেসিয়ারের ভেতর প্রেমিকের হাতের মতো অতৃপ্ততায় ছটফট করে উঠে সময়গুলো। ঠিক এই মুহূর্তে সেই শিশির আর জ্যোস্না স্নাত ধূসর পার্ক পেরিয়ে গেলেই তার জানালায় পত্পত্ উড়ছে আমার আমন্ত্রনের রেশমি নিশান। অথচ আদ্র ঠোঁটের অন্তর্লীন আগুন, মাংসের হিল্লোল উপেক্ষা করে কেমন বেঘোরে কাটছে এই সন্ধ্যা সময়। তবু বন্ধুদের আড্ডার গুলজার, চায়ের পেয়ালা আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাপিয়ে ঠিক ঠিক ভেসে উঠে একজোড়া চোখ। যে চোখ সন্ধ্যায় কবিতাপাঠে মগ্ন।
৪.
- তুমি সেদিন কবিতার আসরে আস'নি!
- ইচ্ছে করেই আসিনি। ভালো লাগে না।
- কেনো?
- ওখানে তোমার শুভাকাঙ্খিরা কবিতার চেয়ে তোমার প্রতিই বেশি আগ্রহী।
- তোমার হিংসে হয়!
- হয়। আমার সরল স্বীকারোক্তি।
- তুমি এতো কাঙ্গাল ক্যানো বলতো?
- আমি উঠব, চলো।
- এত তাড়াতাড়ি! রাগ করলে। আর কিছুক্ষণ বসি!
আমি ফের ব'সে পড়ি। জ্যোৎস্নায় তাকে বড় মায়াময় মনে হয়। কুয়াশায় তাকে অনেক দূরের কেউ ব'লে মনে হয়। মায়া শব্দটিকে নিয়ে আপনমনে নাড়াচাড়া করি কিছুক্ষণ।
- একটা কবিতা শোনাও। অনেকদিন শুনি না! তার প্রস্তাব।
- কবিতা লিখি না আর।
- তবে পুরনো কিছু হোক!
- এই মুহূর্তে তেমন কিছু মনে পড়ছে না। আমি ডিসেম্বরের পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকালাম। সেখানে নক্ষত্র জ্বলছে দাউদাউ। সেই আগুন আমাকে স্পর্শ করে।
- তুমি এখনো রেগে আছো! এত কাঙ্গাল ক্যানো তুমি? ক্যানো এত কষ্ট পাও?! বলেই সে দু'হাঁটুতে মুখ গুঁজে দেয়। এই প্রবল শীতে তার চোখে আষাঢ় ভর করে। উত্তোরীয় বাতাস নাকি অরুদ্ধ আবেগে, জানি না, তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে!
আমি তার কথার কোন জবাব দেই না। স্বগতোক্তির মতো আমি নিজের মনে আবৃত্তি করতে থাকি.....
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙ্গা পাবে অন্বেসণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে সাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:০২