১.
আমি যখন রেল পরিবারে আসি তখন নিজেকে রাজরাণীর মতো মনে হয়েছিল। পেল্লাই বাংলো বাড়ি। রাজকীয় গাড়ি। আর্দালি খানসামা। আর এখন যখন রেল ছেড়ে যাচ্ছি, মড়া বাড়ির মতো রিক্ত শূন্য রেল। রেলের এই দুরবস্থার জন্য নিজেদের দায় এড়াবার কোন সুযোগ নেই। এই গ্লানিটুকু মেনে নিয়েই বলছি, এখন যারা আছেন একটু চেষ্টা করে দেখেন না- রেলটাকে বাঁচানো যায় কিনা।
রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে সদ্য অবসরে যাওয়া এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী এভাবেই তার মনের কথাগুলো তুলে ধরেছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকেই সেদিন চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। এই বিলম্ব অশ্র“পাত
কী রেলকে সমূহ পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে?
২.
কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় একটা নিউজ এসেছিল। সিআরবিতে জিএমের বাংলোয় ডাকাতি হওয়ার পর দু’লাখ টাকা লুটের মামলা হয়। পুলিশ ডাকাতদের ধরার পর ডাকাতরা জানায় তারা ১৩ লাখ টাকা সেদিন সরিয়েছিল। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারা একবাক্যে তা অস্বীকার করেন। পরে জানা যায় নিয়োগবাণিজ্যের টাকা লোকানোর জন্য এই অস্বীকৃতি। এর আগে নাকি ডাকাতরা ওই বাংলো থেকে কোটি টাকাও লুট করেছিল।
সেদিন শুনলাম আমার এক সাবেক প্রতিবেশীর কাহিনী। তিনি নাকি নিয়োগের নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এখন ফেঁসে গেছেন নিয়োগ দিতে না পেরে। তাই প্রতিদিন দেরি করে অফিসে আসেন। দ্রুত সব ফাইলপত্র দস্তখত করে সকাল সকাল কেটে পড়েন। এমনকি তার সরকারি গাড়িটা পর্যন্ত ব্যবহার করেন না। ভাড়ায় খাটা সিএনজিতে ঘুরে বেড়ান।
পত্রিকায় রেল বিট করার সময় এই ধরনের আরো কত যে গল্প কানে আসত। এক অফিসার কনডেম ঘোষণা দিয়ে পুরো পাঁচ বগি চাল বেচে দিয়েছিলেন। আরেকজন ঘুষের টাকা গুনতে মেশিনও কিনেছিলেন বলে শুনেছি।
৩.
আমাদের বাংলোর পাশ দিয়ে একটা সুঁড়িপথ ছিল। সিটির আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে সার ধরে লোকজন এই পথ দিয়েই আসত যেত। শত শত লোক। যুদ্ধফেরত সৈনিকের মতো জটলা বেধে বেধে। ফেরার সময় সবার হাতে কিছু না কিছু থাকত। কারো হাতে রঙে ভরা কন্ডেন্সড মিল্কের কৌটা। করো হাতে ভাঙা লোহার টুকরো। কেউ আবার কিছু খুঁজে না পেয়ে তেল-মোবিলে মাখানো পাটের ঝুট। আমার ধারণা ছিল ওয়ার্কশপের বিশাল কম্পাউন্ডটা বোধ হয় অফুরাণ সম্পদের খনি। না হলে প্রতিদিন শত শত লোকের এই নীরব লুণ্ঠনেও সে নিঃস্ব হচ্ছে না কেন? ঈদের আগে আগে দেখতাম কারখানা থেকে ফেরার পথে সেই সুঁড়িপথের একটা একটা করে ইট খুলে সন্তর্পনে নিয়ে চলে যেত একেকজন। এই ইট পরে সাগরিকা এক্সপ্রেসের ছাদে শোভা পেত।
পত্রিকার চাকুরির সূত্রে বেশ ক’জন রেল শ্রমিকনেতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। কথায় কথায় রেল কর্মকর্তাদের আক্রমণ করাই যেন তাদের সাধনা। রেলের এই দুর্ভাগ্যের জন্য নিরঙ্কুশভাবে তারা অফিসারদের দায়ী করতেন। কোন কর্মকর্তা ৩০ টাকা কেজির ধূপ আড়াই হাজার টাকা বিল করে পয়সা মারলেন সেই কাহানি ডেইলি একবার করে স্মরণ করিয়ে দিতেন আমাদের। অথচ ওই নেতাকে কখনোই তাঁর কর্মস্থলে পাওয়া যেত না। পাওয়া যেত অদূরে পাহাড়তলী বাজারে তাঁর কাপড়ের দোকানে। নইলে ডিইন অফিসের টেন্ডার বাক্সের কাছাকাছি।
তার অফিসার-কৃত্যানুষ্ঠান শুরু হলে আমি শুধু মুচকি হেসে বলতাম, এটেন্ডেন্টরা কোন গ্রেডের অফিসার?
যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ কিন্তু এদের প্রতি।
৪.
অবশেষে রেল মন্ত্রণালয় হলো। দেশের ইতিহাসে প্রথম রেলমন্ত্রী হলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সমান্তরালে। হাজার উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া এই সংগ্রামী রাজনীতির রাজপথ অবশেষে রেলপথে এসে মিশেছে। তাঁকে রেলমন্ত্রী হিসেবে পাওয়া তাই অনেকটা মেঘ চাইতে বৃষ্টির মতো।
রেলমন্ত্রী হয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, সারা বিশ্বে রেলপথ লাভজনক, কিন্তু বাংলাদেশে রেলপথ লোকসানের খাত? রেলের লোকসানের পেছনের কালো বেড়ালটা খুঁজে বের করব।
আসুন আজ আমরা সবাই মিলে সেই বিড়ালটার খোঁজ বের করি। এই খোঁজাখুঁজির প্রয়াস থেকেই এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর অবতারণ।
৫.
চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু পূর্ব সেতু পর্যন্ত রেলপথে দূরত্ব ৫১৫ কিমি। ময়মনসিং এক্সপ্রেসে এতটুকু পথের ভাড়া মাত্র ৬২ টাকা! তারপরও যদি বলেন রেল কেন লাভ করে না তাহলে আমার কিছু বলার নেই। মন্ত্রীর কথায় বলতে হয় যত গুড় তত মিঠা। গুড় না থাকলে পানসে লাগবেই।
৬.
দৈনিক যায়যায়দিনে ২২ জুলাই ২০০৬-এ আমার একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়। আজ এই প্রতিবেদনটা রিপ্রিন্ট করার লোভ আর সংবরণ করতে পারছি না।
১৪ বছরে রেলের খরচ বেড়েছে ১৮২ শতাংশ: বাড়েনি টিকেটের দাম
১৪ বছরেও বাড়েনি রেলওয়ের টিকেটের দাম। এসময়ে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন হয়েছে দ্বিগুণ। ট্রেন চালাতে অপরিহার্য জ্বালানি তেল ও আনুষঙ্গিক জিনিসের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তার ওপর মূদ্রাস্ফীতি। সবমিলিয়ে খরচ ১৮২ শতাংশ বাড়লেও টিকেটের দাম বাড়েনি।
ফলে লোকসানের পাল্লাটা দিন দিন ভারী হচ্ছে। গত ২০০৪-০৫-এ রেলওয়ের লোকসানের পরিমাণ হলো ২৫০ কোটি টাকা। আর আগের বছর লোকসানে পরিমাণ ছিল ২৪৫ কোটি টাকা। লোকসান পোষাণোর জন্য ২ বছর ধরে ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে রেলওয়ে। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মার্কেটিং এন্ড কর্পোরেট প্ল্যানিং) আব্দুল হালিম মিয়া বলেন, আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান। লাভ-ক্ষতি দেখা আমাদের দায়িত্ব নয়। যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রেল কর্মকর্তা বলেছেন, ভাড়া বাড়ালে যাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই আশঙ্কায় ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে না। নির্বাচনের আগে আর ভাড়া বাড়ানোর সম্ভাবনাও নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, যুগ্ম পরিচালক (প্যাসেঞ্জার মার্কেটিং)-এর দপ্তরে গত ২ বছর আগে ভাড়া পুনর্নিধারণের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। তালিকাটি ২ বছর ধরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। তবে অতিরিক্ত পরিচালক (মার্কেটিং এন্ড কর্পোরেট প্ল্যানিং) এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা যায়, সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেটের দাম বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমিয়ে পুনর্নিধারণ করা হয়। সেসময় বাসের টিকেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চট্টগ্রামÑঢাকা রুটে ইন্টারসিটি শোভন চেয়ারের ভাড়া দেড় শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সুবর্ণ এক্সপ্রেস ব্যতীত অন্য ট্রেনগুলোর ভাড়া এখনো তাই রয়ে গেছে। অথচ তেলের দাম বাড়ায় একই মানের বাসের টিকেটের দাম হয়েছে দু’শ থেকে আড়াই শ’ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে প্রায় ১শত ৬৬ শতাংশ। ১৯৯২ সালে ডলারের দাম ছিল ৪০ টাকার কাছাকাছি। বর্তমানে তা প্রায় ৭০ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ডলারের দাম বেড়েছে পৌনে ২ গুণ। রেলওয়ের ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতি সবই আমদানি নির্ভর। তাই ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতের খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। একই সময় ডিজেলের দাম ছিল ১৩ টাকা। বর্তমানে তা ৩৩ টাকা। অর্থাৎ আড়াই গুণ বেড়েছে।
এ সময় দুটি পে-কমিশনের বদৌলতে রেলওয়ের ৩৪ হাজার ১ শত ৬৮ জন নিয়মিত কর্মীর বেতন-ভাতা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। সবমিলিয়ে রেলওয়ের ১৯৯২Ñ৯৩ অর্থবছরের পরিচালন ব্যয় ৩ শত ৮১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে ৬৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ সর্বমোট ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে ১ শত ৮২ শতাংশ। কিন্তু এর মধ্যে টিকেটের দাম তো বাড়েনি, মালমাল পরিবহনের মাশুলও বেড়েছে সামান্য।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান অর্থ উপদেষ্টা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা সরোজ কান্তি দেব গবেষণা করছেন টিকেট প্রাইসিং-এর ওপর। তিনি জানান, সর্বশেষ ১৯৯২-৯৩ অর্থ বছরে রেলওয়ের পার প্যাসেঞ্জর-কিলোমিটার ব্যয় ছিল ৫৩ পয়সার মতো। আর এ খাতে প্যাসেঞ্জার প্রতি রেল পেত মাত্র ২১ পয়সা। আর ২০০২-০৩ অর্থবছরে প্রায় ৯৫ পয়সা খরচের বিপরীতে যাত্রীর কাছ থেকে রেল পেত ৪০ পয়সা। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে খরচের হিসেব বের করা না হলেও যাত্রীর কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে কিলোমিটার প্রতি ৩৮ পয়সা।
এই প্রতিবেদনটি লেখার পর আরো ৫টি বছর কেটেছে। লোকসানের পরিমাণ আড়াইশ কোটি টাকা থেকে হয়েছে ৬ শ কোটি। কিন্তু ভাড়া বাড়েনি। দু শ টাকার বাসের ভাড়া যেখানে ৩৮০ টাকা হয়েছে, ট্রেনে সেই দেড় শই রয়ে গেছে।
৬.
এবার একটা ভালোবাসার গল্প বলি। ফেসবুকে ঘাটতে ঘাটতে বাংলাদেশ রেলওয়ে নামে একটা গ্র“পের দেখা পেলাম। রেলের ইঞ্জিন, বগি, কারখানার চমৎকার চমৎকার সব ছবি। আমি আবেগাপ্লুত পড়ি। মনে হলো রেইন টিতে ঢাকা লাল লাল দালানের সেই রেল পাড়াতেই ফিরে গেছি। শুধু ছবি নয়, রেলের ইঞ্জিন-বগি-ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে কৌতূলোদ্দীপক সব তথ্য। আমি ত ভেবে বসলাম বিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞদের এ বুঝি অষ্টবজ্র সম্মিলন। এখানে আমার মুখ না বাড়ানোই শ্রেয়। কিছুদিনের মাথায় আমার ভুল ভাঙতে শুরু করল। এদের বেশির ভাগই রেলের লোক নন। কেউ ছাত্র, কেউ পেশাজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। এরা রেলকে ভালোবাসে। তাই রেলে ঘুরে বেড়ায়। রেলের ছবি যোগাড় করে। রেলের খবর রাখে।
আবার এই গ্র“পে আরেকটা অংশ পেলাম যারা রেলেই চাকরি করেন। কেউ কেউ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। খুব গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততার চাকরি। তারপরও গ্র“পকে তারা যথেস্ট সময় দেন। ওই ট্রেন লেট কেন, ওই ট্রেনের আরো তিনটে বগি কই: এরকম নানান প্রশ্নের সুন্দর করে গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছেন তাঁরা। আমি কিছুটা অবাক হই। এতো উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের কাছে এমন সংবেদী আচরণ ভাবনারও অতীত।
আমার বিস্ময়ের আরো কিছুটা বাকি ছিল। একদিন দেখি ওই গ্র“পেরই এক কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে বসলেন (নাম্বারটা ফেসবুক থেকেই পেয়েছেন)। পাক্কা আধা ঘন্টার আলাপ। আমি শুধু কথা সংক্ষেপের চেষ্টা করি, তিনি নতুন নতুন প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা দীর্ঘ করেন। আর আমার মধ্যে বেড়ে চলে অপরাধবোধ। ইস, এভাবে কথা বলে লোকটার সময় নষ্ট করার কোন মানে হয়। তারপর আরো কয়েকদিন আলাপ হলো। আলাপ হলো আরো কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে। বাবার চাকরির সময় যেসব পদের লোকদের আমার কেবল কল্পলোকের মানুষ বলেই মনে হতো, তারাই এখন বন্ধুর মতো কথা বলে যাচ্ছেন, কিছুটা বিব্রত আমি। তাঁদের বক্তব্য স্পষ্ট, চিন্তা স্বচ্ছ। তাঁঁদের সবারই একই কথা: আমাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। সরকার যদি আরেকটু মনোযোগ দেন তাহলে রেল আবার সেই পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
এঁদের সঙ্গে কথা বলি আর ভাবি এই যুদ্ধে কে জিতবে: কালো বিড়াল না ভালোবাসা?