এক যুগেরও বেশি সময় পেছনের কথা।
কতবার দেখা হলে মানুষ চেনা যায়!
কতবার সাক্ষাতে এক শিল্পীর জীবনের স্কেচ করা যায়।
কিংবা কতবার সামনে থেকে গান শুনলে বা কনসার্টে বসে শিল্পীর গান দেখলে বোঝা যায় সেই গানের গভীরতা কত! জানা আছে কি কারো সিই হিসাব?
নগরবাউল জেমসকে নিয়ে এটি হয়তো অর্ধশততম লেখা আমার। কিংবা তাঁর অধিক কিনা তা জানে না এই জীবনের পাটিগনিত। এদেশের রক মিউজিকের 'স্বর্ণালী যুগ' বলে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে যে সময়টা। সবাই বলা-কওয়া করছে ৯০ দশকের সময়ই নাকি ছিল সেটা। সে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। হ্যাঁ। তিনিই নগরবাউল। জেমস। গানের ধারাবাদল, কিংবা সুরের প্যাটার্ন, কিংবা কম্পোজিশনে একেবারে ভাংচুর বিবর্তন। এভাবেও গান গাওয়া যায় নাকি? এভাবে এই ঢঙে পারফর্ম করা যায়! জেমসকে নিয়ে এরকম অনেক দৃষ্টান্ত লেখা যাবে, প্রশ্ন তোলা যাবে... প্রশ্ন তোলার ছিল। চলুন স্মৃতির পৃষ্ঠে কিছু সময় উল্টানো যাক-
#মনে পড়ে শুধাংশু, মনে পড়ে সাত এক!
প্রায় ১৪ বছর আগে, অর্ণব ব্যানার্জী রিঙ্গো নামে এক নির্মাতা তখন ঢাকা শহরের বিঙ্গাপন বানিয়ে বেশ নাম কুড়িয়েছেন। তিনি শুরু করলেন কয়েকটি মিউজিক ভিডিও নির্মানের কাজ। দেশের শীর্ষ ব্যান্ড তারকাদের নিয়ে। শুটিং চলছে। ক্যামেরা লাইট সেট। একটা সাদা দেয়ালে নানান এক্সপ্রেশন নেয়া হবে শিল্পীর। আর গাইবেন জেমস। হঠাৎ জেমস রিঙ্গোকে বললেন, 'এই থাম, এখন গান হবে না, মুড নেই।'
আমরা অবাক! কী হলো! তবে কি আজ শুটিং হবে না?
রিঙ্গোও খোব টেনশনে পড়ে গেল। অনেক বাজেটের কাজ, ঠিক সময়ে জমা দিতে না পারলে গচ্চা যাবে অনেক টাকা। আমাকে সহ বেশক'জনকে রিঙ্গো বলছেন আপনারা বোঝান একটু।'
বিটিভির ঈদ অনুষ্ঠানমালায় যাবে গানগুলো। তখনকার সবচেয়ে বড় বাজেটের কাজ ছিল সেটি।
একা নিমগ্ন হয়ে গেলেন জেমস। কিছুক্ষণ খোলা আকাশের দিকে তাকালেন। খানিক চোখ ডললেন! বোঝা গেল না তাঁর অভিব্যক্তি।
আমরা ঈশৎ দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখছিলাম। গানটি মুক্তিযুদ্ধের গান ছিল। গানটি ছিল- এদেশকে নিয়ে স্মৃতিতাড়িত এক গান। আমি কাছে গেলাম। বললেন, 'গানটার ভেতরে কি যেন এক মোচর আছে। আমার এক পরিচিত মানুষের কথা মনে পড়ে যায়, গানটি শুনলে। আসলে ৫২, ৭১ এসব উত্তাল সময়ে কী দিনই না ছিল। ভাবলেই অবশ হয়ে যায় শরীর।' একা আনমনেই বলছিলেন জেমস।
এই যে নিজের গানে, নিজেই আবেগতাড়িত হয়ে যাওয়া। এরই নাম হয়তো শিল্পীমন। গানটার ভেতরে যিনি তখন বাস করেন। এরপর সেই বিকেলে অনেক কথা। অনেক ভাবনার বিচ্ছুরণ। তখন জেমস এদেশের নতুন ক্রেজ। দেশে কোটি তরুণ ভক্ত তারই ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে। এর ভেতরে কেউ কেউ আবার নাক সিঁটকাচ্ছেন।
'এইভাবে আবার কেমন গান! এ কেমন গায়কি।'
কিন্তু ধাক্কা খেয়ে সেই দর্শকও আবার প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন জেমসের।
#সাউন্ডগার্ডেনে দিন রাত একাকার।
নগরবাউলকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে এলিফেন্ট রোডের সাউন্ডগার্ডেনের কথাটা না লিখলে তা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। এখানেই, এই স্টুডিওতেই একসময় জেমস ও তার ফিলিংস ব্যান্ডের অবিরাম চলাচল, আড্ডাবাজি আর গানের কারখানা বিরাজমান ছিল। সেলফোনের উৎপাতের যুগ তখনো আসেনি। সেসময় ভোরের কাগজে চাকরির পাশাপাশি রোজ খবরের উপাত্ত খুঁজতেই বিকেলে চলে যেতাম সাউন্ড গার্ডেনে। পরিমল নামের যে ম্যানেজার ছিলেন, সে-ই খবর দিতেন কখন কার স্টুডিও শিফট চলছে।
কিন্তু একটি ব্যান্ড দলের কেনো নির্দিষ্ট শিফট ছিল না। সবাইকে পরিমল বলেই নিতেন জেমস ভাই যখন তখন শিফট চেয়ে বসতে পারেন। তখন কিন্তু আপনাকে শিডিউল পরিবর্তন করতে হবে। এই ছিল অলিখিত নিয়ম। হয়তো এমনও দিন গেছে, সারাদিন রাতভর আড্ডাবাজিতে সময় কাটিয়ে দিয়েছেন জেমস, ফান্টি, আসাদসহ পুরো দল। গিটার ধরে জ্যামিং চলছে, চলছে গানের লিরিক ঠিকঠাক করার কাজটিও। মাঝে প্রতিদিনই ভক্তের উৎপাত।
একবার ঠিক জেমস ভাইয়ের মতো বড় বড় চুল নিয়ে সুদূর দিনাজপুর থেকে এক ছেলে হাজির। তখন জেমস ভাইয়ের বড় বড় চুল ছিল।মাঝে মাঝে ঝুঁটি করেন তিনি তখন। স্টুডিওতে এলেই তা ছেড়ে দিয়ে বসেন। সেই ছেলেটিও ঠিক জেমস ভাইয়ের আদল ধরে বসে আছেন স্টুডিওতে। এসে বলছেন, একবার গুরুর সাথে দেখা করতে চাই।
পরিমল ওকে দেখে মিটমিটিয়ে হেসে থাকে বলেছেন, 'এই বেশ ধরে আইসেন ক্যান? আর তিনি আজ না-ও আসতে পারেন। স্টুডিওতে অন্যের শিফট চলছে। আপনি এখন যান।'
কিন্তু সেই ছেলে কোনভাবেই যাবে না। সেদিন জেমস ভাইয়ের স্টুডিও ওয়ার্ক করার কথা না। কিন্তু তিনি এলেন সন্ধ্যা নাগাদ হঠাৎ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবদি সেই ছেলে সাউন্ড গার্ডেন স্টুডিওর নিচের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আমি স্টুডিয়ের জানালা দিয়ে দেখছিলাম তখন, এক ভক্তের পাগলামি। জেমস ভাই এলেন। সেই ভক্ত হন্ত দন্ত হয়ে গুরু গুরু বলে সালাম ঠুকলেন।
'কি হয়েছে বল? এরকম জঙলি হয়ে এসেছিস কেন? যা ন্যাড়া হয়ে আয়।'
ব্যাস মুহূর্তের ভেতরে ছেলে উধাও। চলে গেল। ঠিক প্রায় ২০ মিনিটের পর ছেলেটি একেবারে ন্যাড়া হয়ে জেমস ভাইয়ের সামনে হাজির। আমরা তখন একজন আরেকজনের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছি।
আমি জিঙ্গাসা করলাম, এতদিনের কষ্ঠ করে রাখা চুলগাছি এক কথাতেই ফেলে দিলে?
ছেলেটি বলল, আমি গুরুর জন্য সব পারি, সব পারব।
#রংপুরের এক পাগল ভক্ত।
রংপুরের 'শাইখ' নামের এক ছেলে ছিল- জেমস ভাইয়ের অন্ধ ভক্ত। জেমস যেখানেই যেতেন, যেখানেই কনসার্টে গাইতেন, শাঈখও সেখানে হাজির।ছেলেটি পরিবারের বড় সন্তান। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, তবুও বিয়ের কোন খবর নেই। একবার এক কনসার্টের গ্রিনরুমে জেমস ভাই মজা করতে করতেই বললেন, 'কিরে তুই বিয়ে করবি কবে?
গুরু আমি বিয়ে করব না। বিয়ে করলে তো আপনার কাছে হুটহাট করে এভাবে আসতে পারব না। আমরা সবাই হয়তো হো হো করে হেসে উঠেচি সেই সন্ধ্যায়। কিন্তু ওই পাগল ভক্তের নির্মল মন এক শিল্পীর প্রতি যে গভীর অনুরাগ, তা হয়তো মাপতে পারি নি।
ঠিক ঠিকই প্রায় পুরো যৌবন বিয়ে না করে সারাক্ষন জেমস ভাইয়ের সাথে ছায়া শরীর হয়ে রইলেন। শাঈখ খোব প্রখ্যাত ভক্তের তালিকায় ছিল তখন। কারন বেশ ক'টি পত্রিকায় তাকে নিয়ে ফিচারও হয়েছে।
জেমস ভাইয়ের খোব কাছাকাছি থাকাতে, তখন অনেকেই জেমস ভাইয়ের কোন আপডেট জানতে শাঈখের কাছে ফোন দিতেন। শাঈখের কাছে জেমস ভাইয়ের আগাম শিডিউল মুখস্ত।
#এক মাঝরাতের আড্ডাবাজি।
জেমস ভাই তখন উত্তরা নিবাসী। আমি ও পাক্ষিক আনন্দধারার রিপোর্টার সকাল আহমেদ (এখনকার প্রখ্যাত নির্মাতা) ঠিক করলাম জেমস ভাইয়ের সাথে টানা দুই দিন, দুই রাত থাকব। যে কথা সেই কাজ। আমরা দুই ভাউন্ডুলে যার যার অফিস থেকে ছুটি নিলাম। জেমস ভাইয়ের সারাদিন প্রাকটিস, নানান মানুষের সাথে কথাবার্তা। অতঃপর রাত, সব দেখব।
জেমস ভাই বাসা থেকে বেড় হবেন না। তাই বাসাতেই আমরা খাচ্ছি, ঘুরছি একেবারে মেহমানের মত। আড্ডা দিচ্ছি। কোন অফিসিয়াল কথা না। নানান আলোচনা।
জেমস ভাইয়ের তখনকার বাসায় নানান বিখ্যাত পেইন্টিং ছিল। সেই পেইন্টিং-এর ব্যাখ্যা দিয়ে জেমস ভাই বলছিলেন, 'দ্যাখ, আমি ওইসব বিমূর্ত চিত্রকলার পক্ষে না। আমার কাছে, যা স্পষ্ট, স্নিগ্ধময় লাগবে তা-ই ভালো লাগে।'
মনে আছে সেই সন্ধ্যায় জেমস ভাইয়ের ঘরে টাঙানো এক নিঃসঙ্গ রাত্রিবাস-এর ছবি ছিল। গভীর এক অরণ্যে কুপি জ্বালিয়ে এক মেয়ে অপেক্ষা করছে কারো জন্য। এরকম ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়। জেমস ভাইও তাই বলছিলেন, 'তানভির চেয়ে দেখ। এই ছবিটার দিকে তুই ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে দেখে একটা সিনেমা দেখার স্বাদ নিতে পারবি। তুই তর গল্পটা সাজিয়ে নিতে পারবি। আমার কাছে এরকম চিত্রকলাই পছন্দ।'
আমি বসে ভাবছিলাম, একজন এতবড় রকস্টার এত অসাধারণ চিত্রকলা নিয়ে এত চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন কিভাবে?
উত্তরার বাড়িটি ছিল বেশ নির্জন। বাইরের দারোয়ান কামরুল ফ্রায় সময়ই গুনগুন করে গাইছে, 'চলে যাও সব সুখের সারথী/ চলে যাও সব সুখ নিয়ে।'
খেয়াল করলাম তাঁর প্রতিটি সহকারী, কাজের লোক সবাই তাঁর গানের ভীষন ভক্ত। এমনটা কিন্তু বিরল। অনেক বড় বড় শিল্পীর বাসায় গিয়ে দেখেছি, কাজের লোকেরা তার বাড়ির মালিকের কাজ সম্পর্কে খোঁজই রাখেন না।
সারাদিন থাকার পর রাত ২ টার দিকে উত্তরা থেকে শহর ঘুরতে বের হলাম। জেমস ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন। আমরা বসে আছি। শহরে দায়িত্বরত দুই-একজন ট্রাফিক সার্জনকেও দেখলাম জেমস ভাইকে চেনেন, যে এই রাতের ঢাকা ঘোরার বিষয়েও জানেন।
সেরাতে চলে গেলাম ঠিক শাহবাগ মোরটায়। যেখানে গরম গরম পরোটা আর ডিমবাজি , চিকেন তরকারি রান্না চলছে। ফুটপাতের সেই দোকানে জেমস ভাই যেতেই সবাই আলাদা প্রস্তুতি নিল। এরপর কোন কিছুর অর্ডার দিতে হল না। নির্ধারিত মেন্যু অনুযায়ি চলে এল। এমনকি গাড়ি থেকে নেমে আমরা যে জায়গাটিতে বসলাম, সেটিও তার জন্য নির্ধারিত। আশেপাশের তরুনেরা সবাই একজোট হয়ে জেমস ভাইয়ের গান গেয়ে শোনায়। ওরা প্রায় প্রতিদিনই অপেক্ষা করে এই মাঝরাতের। নগরবাউল জেমস কখন আসবেন? এরপর তাঁকে গান শোনিয়ে ঘরে ফিরবেন। একদল ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আমরা ভোররাতে আবার জেমস ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। তাঁর সাথে থেকে অদ্ভুত এক নগরী দেখলাম।
এমন হাজার স্মৃতি তাকে নিয়ে। এসব ভাবছি যখন, বারিধারা জেমস ভাইয়ের স্টুডিওতে বসে। তখন সন্ধ্যা প্রায়। ফটোগ্রাফার সোহেল মামুন খোব টেনসনে পড়ে গেছেন। তানভীর ভাই, আরেকটু পর সানলাইট চলে গেলে ছবি ভালো আসবে না। ঈদসংখ্যায় কী ছবি দেব তখন? প্লিজ জেমস ভাইকে একটা ফোন দেন। তিনি বাসা থেকে রেডি হয়ে আসছেন কিনা?
ভেতরে প্রাকটিস সেশন চলছে মিউজিশিয়ানদের। খুব সহসা কোন কনসার্টের সিডিউল নেই। তবু নিয়মমাফিক প্রাকটিস থামে না নগরবাউলের। সেই প্রায় দেড় যুগ আগের সাইন্ডগার্ডেনের বৈঠকখানার কথা মনে পড়ল। বারিধারার এই সুসজ্জিত স্টুডিওতে বসে জেমস ভাইয়ের সাথে আবারও আলাপ জুড়লাম।
১. কেমন আছেন?
জেমস- ভালো আছি। এইসব থাকাথাকি তো নিজের ভেতরেই। আমি নিজের ভেতরটা সবসময় ভালো রাখার চেষ্টা করি।
২. এখনকার গানের ফিরিস্তি নিয়ে জিঙ্গাসা করে যখন আপনাকে, কী বলেন বা ইন্টারভিউ দিতে এখন কেমন লাগে?
জেমস- আমি ওসব প্রশ্নের ধার ধারি না। কোন ইন্টারভিউ তো দিচ্ছি না। তোরা অনেকদিনের চেনা, তাই দেখা সাক্ষাত হচ্ছে। এছাড়া ফর্মেট ইন্টারভিউ দিতে ভালো লাগে না। কোন টকশোতেও তাই যাই না্। কি হবে? যা বলার তা তো গান দিয়েই বলছি। এখন একদম নিজের মতো করে থাকি। একদম।
৩. আগেও তো তাই ছিলেন। নগরবাউলের আদলটা তো এমনই জানি।
জেমস- তা হয়তো তোরা কেউ কেউ জানিস। কিন্তু তখন তো এত এত চ্যানেল ছিল না। এখন প্রতিদিন অমুক চ্যানেলের মালিক থেকে প্রডিউসারদের ফোন, টক শো বা যে কোন অনুষ্ঠানে হাজির হতে হবে। আমি না করে দেই বরাবর।
৪. আর টিভি লাইভ?
জেমস- সেটাও খোব বেছে বেছে। দ্যাখ, এখন তো নতুন কিছু না দিতে চাইলে খামাখা কেন আমি বক বক করতে যাব। কি হবে। এই ভালো নিজের গান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। টিভি লাইভেও খোব বেছে বেছে যাই।
৫. কিন্তু নতুন গান কি বেরুবে না?
জেমস- হে, বেরুবে। কেউ চাইলে। এবং তা অবশ্যই প্রফেশনাল ডিল-এ হতে হবে।
৬. কিন্তু আপনার গান, এসময়ে কেউ চাইবে না, এটাতো ভাবাই যায় না-
জেমস- হা হা হা। এই উল্টাপাল্টা মিনিং বের করে ফেলা। তোর টক শো করতে করতে এই অভ্যেস হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। হা হা হা। এজন্যই তো টক শো তে জাই না। আমাদের গান প্রফেশনালি, আমাদের পারিশ্রমিক, প্লান সব মিললে তবেই তো দেবো। তবেই তা বিক্রি হবে। এখন তো আর সেই বয়স বা সেই সময় নেই আমার ক্যারিয়ারের যে এই ঈদে আমার অ্যালবাম না দিলে আমাকে সবাই ভুলে যাবে। নগরবাউলকে মনে রাখার মতো অনেক গান আমি শ্রোতাদের হৃদয়ের ভেতরে গেঁথে দিয়ে এসেছি। তাই এখন এতটুকু সাবধানী হয়ে তো থাকতেই হবে। তবে নতুন গান হচ্ছে। কারন সুর কম্পোজিশন তো আর অফিসের চাকরি না যে এই ২০১৫-তে একটা লক্ষমাত্রা থাকবে, একটা সুর করতে হবে। একটা কম্পোজিশন। সেগুলো আমরা সবাই যখন জ্যাম করি, তখন কত সুর যে বের হয়। কত সুর ফেলে, ঝেড়ে দেবার পরও দারুণ কিছু গান আমাদের জমছে। সেগুলো তৈরি হচ্ছে। কিছু তৈরি হয়ে আছে। প্রফেশনাল বনিবনা হলে অবশ্যই দেব। এবং অবশ্যই তার সঠিক মূল্য দিয়ে কোম্পানিকে কিনে নিতে হবে।
৭. আচ্ছা জেমস ভাই, একটা কমন প্রশ্ন করি। এই পাইরেসি আতঙ্ক বা এই যে মিউজিক জেনারেশনের পালাবদল- এগুলো আপনাকে ভাবায় না। আপনার ব্যাখ্যাটা কেমন?
জেমস- মোটেই না। কারণ গান বাঙ্গালি শোনে না- এটা বলা যাবে না। বরং গান শোনা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ওদের কারো কান থেমে নেই। এখন এই কানে সুর ঢোকানোর জন্য কার থেকে কিভাবে আমি পয়সা নিয়ে এই শিল্পকে বাঁচাব, সেটা তো তার ব্যাপার। এটা তো আমার দায়িত্ব না। তাই বাজে এক্সকিউজ দিয়ে কিছু হবে না। ধরা যাক, আমার নেট বাইট থাকলে আমি এখন ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো- এমন আরো কত কিছুতে ফ্রি কথা বলতে পারছি। এগুলোকে কি সেল কোম্পানি পাইরেসি বলছে। ওরা তো সময়ের সাথেই যুদ্ধ করে টিকে আছে। প্রতিদিন নানান রঙের প্যাকেজ দিচ্ছে ওরা। এখন যদি সেই ল্যান্ড ফোনের আমলটাকে আমি ক্যাসেট যুগ বলি, তাহলে এই ইন্ডাস্ট্রি যুগের সাথে কতটা বেড়েছে, সেটা নিয়ে আগে প্রশ্ন তোলতে হবে। এসব বাজে বাহানা। তবে এখন অনেক ডিস্ট্রিবিউটার তৈরি হয়েছে। গানের সুদিন ছিল, আছে, থাকবে। তবে কনটেন্ট ভালো করতে হবে। ভালো একটি সুর মানুষের কানে লাগাতে পারলে, সেটার কোন ক্ষতি নেই। তার লাভ শিল্পী পাবেই।
৮. আচ্ছা, আপনার কথার বাণী বা সুরের চলন এসময় এসে এই যে এপিকে পরিণত হওয়া। এখনকার সস্থা গান নিয়ে আপনি কি বলবেন। গানের কথায় সেই গল্পটা এখন কেন তৈরি হচ্ছে না?
জেমস- এটা আমি কি করে বলব। যারা করছে, তাদের জিঙ্গেস কর। কারণ ওঠা ওদের দায়িত্ব।
৯. ক্যারিয়ারে যখন সব প্রাপ্তি হয়ে যায়, তখন কেমন কাটে একজন কিংবদন্তীর জীবন?
জেমস- আমি জানি না। ওইসব উপাধি আমার জন্য নিশ্চয়ই না। কারণ আমি তো বদলাইনি। সেই একইভাবে রুটিন মেপেই গানের সাথেই আছি। বা আগোছালোভাবেই আছি। তবে এখন জীবনধারা পাল্টেছে। এখন যেমন ফটোগ্রাফিতে সময় দেই, নিজের রেস্টুরেন্টে সময় দেই, কিংবা রেডডটে সময়।
১০. ফটোগ্রাফির বিষয়টা যেহেতু এল, প্রশ্ন করি. এটা কি করে, কি ভেবে শুরু করলেন?
জেমস- এটা একটা ভালোলাগা। ভালো লাগে তাই ছবি তুলি। জানি না, এই ভালো লাগাটা কতদিন থাকবে। তবে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে এই কাজটা করি। জীবনে যা কিছুই, যখনই করেছি, খুব মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। এটাও আমার তেমনি এক ভালো লাগার জায়গা। আর অন্য ব্যবসাগুলো হয়তো, সেভাবে আমি দেখি না। এটা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী চলছে।
১১. এখনকার ছেলে-মেয়েদের গান শুনছেন। কেমন করছে ওরা?
জেমস- আমি শুনি নাই সেভাবে। তাই বলতে পারব না। কারণ আমি ওইভাবে গান শোনার সময়ও পাই না।
১২. এদেশে বলিউডে একমাত্র আপনি যে ক-টি গান গেয়েছেন তা সাফল্য পেয়েছে আশাতীত ভাবে। বাংলাদেশি শিল্পী হিসেবে এটা বড় অর্জন। এর মাঝে ওখানকার একটা অডিও কোম্পানি থেকে অ্যালবাম রিলিজের কথাও শুনতে পেয়েছিলাম। সেটার কাজের কতদূর?
জেমস- না, সেগুলো এখনও কনফার্ম হয়নি। আর বলিউডের এক-একটি কাজ অনেক পরিকল্পনা নিয়ে হয়। এ কারণে ওই ছেলেমানুষির মত কাজ না করেই আমি বলতে পারি, অমুকের সাথে কথা হয়েছে। অমুকে ট্রাক পাঠিয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কোন গান ফাইনাল না হওয়া পর্যন্ত আমরা মিডিয়ায় স্টেটমেন্ট দিইনি, দেবোও না।
১৩. দেশের বাইরের শোগুলো কেমন এনজয় করেছেন? এই যে, এখনকার গ্লোবালাইজেশনে হয়তো দুই দিনের তারকা শিল্পীও ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাচ্ছে। হয়তো বড় কোন শো করছে না। কিন্তু বিদেশে যাচ্ছে। আপনারাও দীর্ঘ একটা সময়ের পর দেশের বাইরে যাওয়া শুরু করেছিলেন। এই কানেক্টিভিটির যুগে প্রবাসী আয়োজকরা কতটা ভূমিকা রাখছে বাংলা গানের ব্যাপারে?
জেমস- খুবই ভালো করছে। কারণ স্বাধীনতার দীর্ঘ কয়েকবছর পর তো বাংলাদেশের বিশাল গোষ্ঠির যুব ও তরুণেরা এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। কারো কারো ক্ষেত্রে দুই জেনারেশন রয়েছে বিদেশে। তাই এগুলো ধীরে ধীরে আরো বাড়বে। আস্তে আস্তে এমনও হতে পারে যে বিদেশ থেকেই বাঙলা গান রিলিজ দেয়া শুরু হবে। দেখা যাবে, সেখানকার প্রবাসীদের ভেতরেই শুরু হতে পারে। আর এমনটা ভাবছি কেন, যে আমরাই শুধু যাব। এমনওতো হতে পারে আমেরিকান কোন প্রবাসীর গাওয়া বাংলা গান এমন জনপ্রিয় হলো, তাকে বাংলাদেশের মানুষ টাকা দিয়ে নিয়ে আসতে পারে। তাই গানটা এখন টোটাল গ্লোবাল। আমি ইউটিউবে যখন গান রিলিজ দিচ্ছি, সেটা তো নির্দিষ্ট কোন শহর বা গ্রামের জন্য দিচ্ছি না। সারাবিশ্বের জন্য গান তৈরি করতে হচ্ছে এবং এটা বাড়বে দিনকে দিন।
১৪. এই বিশ্বব্যাপী গানের ব্যাপ্তি, বিচ্ছুরণ যখন ঘটছে, তখন কি মনে হয়না যে, নগরবাউলে গানগুলো আবার রি-অ্যারেন্জ করে শ্রোতাদের ভেতর পৌঁছানো দরকার?
জেমস- সেগুলোর কাজ এরই ভেতরে আমরা শুরু করেছি। কারন অনেক গানের সাউন্ডের অবস্থা সেরকম ছিল না। সেদিক বিবেচনা করেই আমরা আমাদের গানগুলো সাজাচ্ছি।
১৫. পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা বা বামবা মিটিং-এ কি থাকেন?
জেমস- এখন থাকার চেষ্টা করি। এটা কোন অফিসিয়াল মিটিং বলে না, একসাথে দেখা হলো, আড্ডাবাজি হলো, এটার জন্য থাকি। আমরা তো বিচ্ছিন্ন ছিলাম না কখনো, কখনো হইনি। এখন হয়তো দেখা সাক্ষাৎ কম হয়। কিন্তু আমাদের এই হৃদ্যতা আগের মতোই রয়েছে। সেই জন্য বামবার বিভিন্ন মিটিং-এ যাই।
১৬. এছাড়া রেডডট তো এখন খুব বড় প্রতিষ্ঠান। আপনার পার্টনার গাজী শুভ্রর সাথে এই দীর্ঘ পথচলা প্রসঙ্গে বলুন-
জেমস- খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে শুভ্র ও আমাদের রেডডটের তৈরি 'বিউটিফুল বাংলাদেশ'-এর ক্রেডিট নিয়ে এক প্রতারক দেশের বাইরে গিয়ে সম্মাননা নিয়ে এসেছে। অথচ সে আমাদের একজন ক্রু ছিল মাত্র। আর এটা আমরা সবাই জানি যে এদেশের এই অসাধারন ভিডিওটি শুভ্র বানিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা অফিসিয়ালি এগুচ্ছি। একটা প্রেস কনফারেন্সেও কথা বললাম। কিন্তু তার আগে আমাদের নিজেদের নৈতিকতা ঠিক রাখতে হবে। যে লোকটি এ কাজ করেছে, তার বিরুদ্ধে একাধিক ক্লেইম আছে। এসব ভেবে খুবই কষ্ট লাগে। দুঃখ হয়। আর রেডডট এমনিতেই খুব ভালো করছে। আমার কাছে তো মনে হয় শুভ্র একটা এত ঝামেলামুক্ত ছেলে, যাকে পার্টনার হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আমি তো খোব একটা প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করি না। ও-ই সব দেখে।
১৭. রেড ডট তো চলচ্চিত্র নির্মানের ঘোষণা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে নগরবাউলের গান কেমন থাকবে?
জেমস- এটা নির্মাতার ব্যাপার। আর রেড ডট আর জেমস দুটি আলাদা সত্তা। সুতরাং সেখানেও সবকিছু বনিবনা হলেই তবেই গান হবে। হা হা হা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে জেমসের ভীষণ আশাবাদ। একই সাথে বললেন, আমি আমাদের দেশে শোবিজ ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে দারুন আশাবাদী। কারণ আমরা বিভিন্ন সেক্টরে মেধা দিয়েই সারা বিশ্বের সাথে মাথা উঁচু করে রয়েছি। সেক্ষেত্রে আগে যে বাধা ছিল, সেটি এখন নেই। এখন আমরা এই বিশ্বায়নের মিউজিক করেই অনেকদূর যেতে পারব। একসময় বাংলা গান, বাংলা রক বিশ্ব মাতাবে সেদিন খোব দূরে নয়।
বারিধারার নিজের বিশাল স্টুডিওতে সর্বাধুনিক সব যন্ত্রের সংযোগ। সেখানেই অনেক্ষণ বসে বললেন, 'খুব বেশি কাজ করার তো ইচ্ছে নেই আর। বেছে বেছে কিছু ভালো গান দেবো হয়ত আর কিছু কাল। আর নিজের যা ভালো লাগেনি তা তো কোনদিনই করিনি আমি। সে যে ক্ষেত্রেই হোক। এখনো তা-ই। আলাপ শেষে আবারও ঢুকলেন প্রাকটিস সেশনে। গিটার হাতে গাইতে শুরু করলেন, 'সুলতানা বিবিয়ানা/ সাহেব বিবির বৈঠকখানা।'
দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে কানে খানিক বিভ্রম হলো, পুরানো সেই সিডিটাই বাজছে নাকি? যেখানে অপরুপ কোনো এত ভাস্কর্য গেয়ে চলেছেন তাঁর কোনো কালোত্তীর্ণ গান।
সেই একই কণ্ঠ মাধুর্যতায়। একই মাদকতায়।
এরই নাম জেমস। তিনিই এই নগরের সেরা বাউল।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ও লিখেছেন- তানভীর তারেক।
লেখাটি ইত্তেফাক ঈদসংখ্যা ২০১৫ থেকে সংগৃহিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ ভোর ৫:৪২