আমেরিকার জনপ্রিয়তম এবং দীর্ঘ ক্যাভার্ন গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো লুরে ক্যাভার্। আমার জার্নি শুরু করার আগে এর কিছু বেসিক ইনফো না দিলেই নয়।এটা ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের সেনানদোহা ভ্যালিতে অবস্হিত এবং ১৮৭৮ সালে আবিষ্কৃত হয়, যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ২.৪ কিমি। এতে ১০ টি হলরুমের মত আছে,সবচেয়ে বৃহৎ হল রুমটির ছাদ প্রায় ১০ তলা ভবনের সমান উচু, আরো আছে উইশিং পুল,কেউ কেউ মিরর পুলও বলে।
এত জায়গা থাকতে বড় আপু আমাকে এখানে কেন প্রথম নি্য়ে এলো তা ক্যাভার্নে প্রবেশের পর বুঝতে পারলাম। লাইন ধরে টিকেট কেটে সিড়ি বেয়ে যেন পাতালপুরীতে নামতে লাগলাম। সমতলে নেমে চারপাশ দেখে আমি বাকরুদ্ধ,মুগ্ধ,বিষ্মিত! এ কোথায় এলাম!! এ যেন এক পাথর রাজার রাজ্যে পা রেখেছি, যেখানে সবকিছু কোন এক দৈবশক্তি বলে পাথরে পরিনত হয়েছে! কিছুটা উচু নিচু সরু পথ চলে গেছে সেই রাজ্যের ভিতর দিয়ে,আর ভেজা ভেজা মাটির সেই পথ ধরে আমিও চলতে লাগলাম নানান দেশের নানান বর্নের পর্যটকদের সাথে। প্রতিটি পথ শেষ হয়েছে এক একটি হলরুমে এসে।বুঝলাম শুধু আমি একাই মুগ্ধ নই,আমার আশেপাশের জাতীয় বিজাতীয় ভাইবোন,আঙ্কেল, আন্টিরাও বিষ্মিত। সেই সরু পথ কখনও কখনও সংকীর্ন হয়ে গেছে আবার কখনও কখনও দৃষ্টি দুই ধারের সৌন্দর্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে।
ছাদ থেকে নেমে এসেছে অসংখ্য অসংখ্য সূচালো মাথা বিশিষ্ট লম্বাটে ধরনের পাথর, অনেকটা আমাদের দেশের সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের শ্বাসমূলের মত। কোথাও কোথাও এই লম্বাটে মাথা আরো লম্বা হয়ে মাটির কাছাকাছি চলে এসেছে আবার ঠিক উল্টো দিক থেকে মানে মেঝে থেকেও আরেকটি লম্বাটে পাথর উপরের দিকে উঠে এসেছে। এভাবে একসময় তাদের মিলন ঘটে, তারা একত্রিত হয়ে এক অনন্য খাজকাটা ডিজাইন সম্বলিত পিলার তৈরী করে। সারাটা ক্যাভ জুড়ে এই পিলারের জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপ দেখা যায়। আসলে যত সহজে বললাম তত সহজে একটি পিলার তৈরী হয়না। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা জলরাশি, খনিজ পদার্থ,বালি মাটি ইত্যাদি নিয়ে পাথুরে ছাদ চুয়ে মাটিতে পড়তে থাকে।হাজার হাজার বছর ধরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঐ জলমিশ্রিত বালি মাটি মিলে একেকটি পিলার তৈরী হয়।এই একই সিস্টেম আমাদের বাসা বাড়ির ফ্রিজেও দেখা যায়। কিছুদিন ফ্রিজ পরিষ্কার না করলে ফ্রিজের বরফ চেম্বারের ছাদ থেকে আর ফ্লোর থেকে সরু সরু বরফের পিলার তৈরী হয়। আমি আসলে বেশী বুঝিয়ে ফেলছি।
সম্পূর্ন ক্যাভ জুড়ে নানা বর্নের মনোমুগ্ধকর লাইটিং করা ফলে পর্যটকদের কাছে এক রহস্যময় আলোআধারি পূর্ন অচিন জগত বলে মনে হতে থাকে। এখানে তাপমাত্রা কিছুটা ঠান্ডা,সবকিছু কেমন ভেজা ভেজা,পাথর ধরলে হাতে পানি লেগে যায়। কোথাও কোথাও পানি জমে ছোটখাটো জলাধার তৈরী হয়েছে,তাতে প্রতিচ্ছবি পড়েছে সূচালো পাথর আর পিলার গুলোর।পানি এতটাই স্বচ্ছ যে প্রতিচ্ছবিকে সত্যি ভেবে ভ্রম হতে বাধ্য। আর সেই সৌন্দর্যের কথা কি বলব! কেবল হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়। উইশিং লেকে টুরিস্টরা কয়েন ফেলছে। পুরো তলদেশ ভরে গেছে কয়েনে। বছরে ৩০হাজার ডলার আসে এই ছোটখাটো লেক থেকে যা পরে চ্যারিটিতে দান করা হয়। সম্পূর্ন জার্নিটিতে স্কুল কলেজ পড়ু্য়া অল্প বয়সী গাইডরা সাথে থাকে আর মজার মজার কথা বলে সবাইকে মাতিয়ে রাখে।
বের হয়ে সুভ্যেনির সপ থেকে এ্যামারেল্ড স্টোনের একটা আকরিক কিনতে বাধ্য হলাম,এত সুন্দর জিনিসটা ফেলে যেতে পারলাম না। সম্পূর্ণ ক্যাভটি দেখতে এক দেড় ঘন্টা লেগে গেলো। এরপর পাশেই ছিল কার মিউজিয়াম। সেখানেও ডু মারলাম। সেটা আরেক দেখার মত জিনিস।সেই গল্প আজ থাক। নটে গাছটি মুড়লো আমার গল্পটি শেষ হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪১