আজ আপনাদের নিয়ে যেতে চাই চার হাজার বছরেরও পুরনো কোন এক সভ্যতার কাছে যার ইতিহাস রচিত হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায় । ব্যাবিলনের কথা বলছি । যে সভ্যতা আজও তার পরিচয়কে সমুন্নত রেখেছে শূন্য উদ্যানের ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়ে , তার প্রতিটি ট্যাবলেটের খোদিত অংশে । ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান আজও আমাদের নিকট সপ্তাশ্চর্যের একটি ।
উপরিউক্ত ছবিটি বর্তমানে ইরাকে ব্যাবিলন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের একটি ছবি । ব্যাবিলিয়নদের ইতিহাস নিয়ে বলবার আগে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী আক্কাদ ও সুমেরীয় সভ্যতা নিয়ে কিছু কথা বলি । মুলত এই সভ্যতার পতনের পর মেসোপটেমিয়ায় ব্যাবিলন সভ্যতার জন্ম হয় এবং শিল্প ও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ব্যাপক সমাদৃত হয় ।
প্রথমেই আক্কাদ সভ্যতার একটি ম্যাপ দিচ্ছি ।
ম্যাপটিতে হালকা নীল রঙের অংশটি আক্কাদ সাম্রাজ্যের সীমানা প্রকাশ করছে । আক্কাদ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটে সম্রাট সারগনের দ্বারা । খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৩৪ থেকে ২২৭৯ অব্দ পর্যন্ত ছিল তার সাম্রাজ্যের সময়কাল । সারগনের বিশাল সাম্রাজ্য ছিল মেসোপটেমিয়া , বর্তমান ইরান , এশিয়া মাইনর এবং সিরিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে বিস্তৃত । তার সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল আক্কাদে ।
উপরের ছবিটি ধারণা করা হয় যে এটি সারগনের একটি প্রতিমূর্তি । তিনি তার শাসনামলে বহু রাজ্য জয় করেন । তার উপাধি ছিল The Great King, The True King, The legitimate King । ওয়েইডনার ক্রনিকল থেকে জানা যায় যে তিনিই ব্যাবিলন নগরের প্রতিষ্ঠাতা । ক্রনিকল হল এক প্রকার কালপঞ্জি । ক্রনিকল থেকে সারগনের বংশধারা সম্পর্কেও আমরা জানতে পারি । তৎকালীন রাজতান্ত্রিক সময়ে সারগনের বংশধররাই সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিল । যেমন সারগনের পর সারগনের পুত্র রিমুশ সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন । এরপর তার আরেক পুত্র মান ইশিতুশু, তারপর সারগনের নাতি নারামসিন এবং পরবর্তীতে নারামসিনের পুত্র শারখালিশারি সিংহাসন অধিকার করেন ।
খ্রিষ্টপূর্ব একুশ শতকের দিকে সিরিয়ার সেমিটিক ভাষা ব্যবহারকারী অ্যামোরাইট জাতি মেসোপটেমিয়ার বিশাল অংশ দখল করে । প্রথম ব্যাবিলনিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় ঐ সময়ের অ্যামোরাইট জাতির প্রধান সুমু এবাম কর্তৃক খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৯৪ সালে । অ্যামোরাইটরা সুমেরীয় কিংবা আক্কাদিয়ানদের মত ছিল না । এমনকি তারা মেসোপটেমিয়ার আদি অধিবাসীও ছিল না । তারা ছিল অর্ধ নোমাডিক সেমিটিক জাতি । ব্যাবিলন তখন পার্শ্ববর্তী অঞ্চল কর্তৃক পরিচালিত হত ।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯২ সালে হামুরাবি ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন । তিনি ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের আইনকানুনগুলো সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ করেন । ইহা কোড অব হামুরাবি নামে পরিচিত । তিনি ব্যাবিলনকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন । তার সময়ে সুমেরীয় সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার হয় । তার সময়ে ব্যাবিলন সভ্যতা সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে । তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন ।
হামুরাবির সময়ে ব্যাবিলনের মানচিত্র নিম্নে দেওয়া হল
হামুরাবির সময়ে গনিতশাস্ত্রের ব্যাপক উন্নতি হয় । নিম্নোক্ত ট্যাবলেটটি ইরাক মরুভুমি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে । এটি বর্তমানে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে সংরক্ষিত রয়েছে ।
এবার ব্যাবিলনিয়ানদের সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক । তারা ১ কে লিখত নিম্নোক্ত প্রতীক দ্বারা ।
আর দুই থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাগুলো তারা এই দাগের গুণ আকারে প্রকাশ করত । নিম্নে তা দেয়া হল । আপনারা চেষ্টা করে দেখুন তো এই ধারা বুঝতে পারেন কিনা ।
দুই
তিন
চার
পাঁচ
ছয়
সাত
আট
নয়
দশ
এগার
বিশ
চল্লিশ
ব্যাবিলিয়ন ট্যাবলেটগুলো শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার । নিম্নে কিছু ট্যাবলেটের ছবি দেওয়া হল । অনেকগুলো ট্যাবলেট ইয়েল ইউনিভারসিটিসহ নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে ।
হামুরাবির মৃত্যুর পরবর্তী কয়েকশ বছর ব্যাবিলনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর হাতে। হিট্টাইট, অ্যাসিরিয়ান, ক্যাসাইট এবং ক্যালডিয়ান জাতি প্রায় হাজার বছর ব্যাবিলনের ক্ষমতা হরণ করে। তারপর খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৫ সালের দিকে নাবোপোলাসার এর নেতৃত্বে ব্যাবিলন আবার জেগে ওঠে। তিনি অ্যাসারিয়ানদের রাজধানী নিনেভে দখল করে নেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে নেবুচাদনেজার ক্ষমতায় আসেন। তিনি ব্যাবিলনকে আরো সমৃদ্ধ এবং জাঁকজমকপূর্ণ করে গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন স্থাপত্য ও শিল্পের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির, প্রাসাদ ও স্থাপত্য পূনর্নির্মাণ করেন। ব্যাবিলন শহরকে গড়ে তোলেন সুরোম্য ও আকর্ষণীয় করে।
সম্রাট নেবুচাদনেজার সম্রাজ্ঞীর প্রেরণায় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্মাণ করেন সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম ব্যাবিলনের শুন্য বা ঝুলন্ত উদ্যান । প্রথমে নির্মাণ করা হয় বিশাল এক ভিত, যার আয়তন ছিল ৮০০ বর্গফুট। ভিতটিকে স্থাপন করা হয় তৎকালীন সম্রাটের খাস উপাসনালয়ের সুবিস্তৃত ছাদে। ভিত্তি স্থাপন করার পর মাটি থেকে এর উচ্চতা দাড়িয়েছিল ৮০ ফুট। এই ভিত্তির উপরেই নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং বিস্ময়কর পুস্পবাগ। ৪০০০ শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে তৈরি করেছিল এই বাগান। বাগান পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ছিল ১০৫০ জন মালী। ৫ থেকে ৬ হাজার প্রকার যুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল এই ঝুলন্ত বাগানে। ৮০ ফুট উচুতে অবস্থিত বাগানের সুউচ্চ ধাপগুলোতে নদী থেকে পানি উঠানো হত মোটা পেচানো নলে সাহায্যে। ৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী পারস্য রাজ্যের সাথে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এই সুন্দর উদ্যানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় । একইসাথে ইতি ঘটে ব্যাবিলিয়ন সভ্যতারও । পারস্য সম্রাট সাইরাস ৫১৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জেরুজালেম দখল করে শহরটি ধ্বংস করেন। তাদের উপসনালয় এবং রাজপ্রাসাদ পুড়িয়ে দেন। তার সময় থেকেই ব্যাবিলনের সাম্রাজ্য ম্লান হতে থাকে। তার পরবর্তীকালে নেবোনিডাস সম্রাট হন। তবে ব্যাবিলনের সমৃদ্ধি হারিয়ে যেতে থাকে। ব্যাবিলন এখন ধ্বংস স্তুপ। পারসিয়ান সম্রাটের প্রচন্ড আক্রমণে নিমিষেই ধুলোয় মিশে গিয়েছিলো ব্যাবিলন নগরী ।
এবার নিচে দিচ্ছি ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যান এবং ব্যাবিলিয়নদের স্থাপনার কিছু ছবি । এই ছবিগুলো ইতিহাস এবং প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আলোকে অংকিত হয়েছে ।
আর নিচের ছবিটি থেকে বোঝা যাবে ব্যাবিলনের বর্তমান অবস্থা ।
ব্যাবিলিয়ন সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে নিচের লিঙ্কগুলো দেখতে পারেন ঃ
View this link
View this link
View this link
View this link
View this link
View this link
View this link