১
ধানগাছে থোড় আসবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতের আশপাশে কেমন একটা মন আকুল করা মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়ায় হাওয়ার ভাঁজে ভাঁজে। সে সঙ্গে মৌমাছির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা জাতের ফড়িং প্রজাপতির আনাগোনাও বেড়ে যায়। এ সময়টাতে ঘরে মন টেকে না সফদর আলির। নানা ছুতো-নাতায় দিনভর সে ঘুরঘুর করে ক্ষেতের আশেপাশে। ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটবার সময় যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে।
ফজরের নামাজ পড়া হয়ে গেলে ক্ষেতের অবস্থা দেখার জন্য মসজিদ থেকে সরাসরি মাঠে এসে উপস্থিত হয় সে। আর মিষ্টি গন্ধটা শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয় বুক ভরে। সবুজাভ ধানের পেটে থাকা দুধ তখন শক্ত হতে থাকে আস্তে ধীরে। তেমন নাজুক সময়টাতে খুব বেশি শিশির পড়লে কালো হয়ে যায় সেসব ধান। শেষে পরিণত হয় চিটা ধানে। কালো হয়ে যাওয়া ধানগুলোকে লোকজন লক্ষ্মীর গু বলে জানে। যদিও সফদর আলির ক্ষেতে এমন কোনো লক্ষণ ফুটে ওঠেনি তবু কখন যে ব্যাপারটা ঘটতে আরম্ভ করবে তা নিশ্চিত বলা কঠিন।
উত্তর পাড়ার সামু পাগলার মেয়ে জামাই আতর আলি ফজরের নামাজের সময় দু রাকাত সুন্নত পড়ে নিয়ে ইমাম জুনু মোল্লাকে বলেছিল, মলিসাব, আমার দুইডা ক্ষেতই লক্ষ্মীর গু দিয়া ভইরা গেছে। জমাত শেষে যদি একবার দোয়া-দুরুদ পড়তেন।
জুনু মোল্লা কিছু বলে উঠবার আগেই ওইচ্চা ব্যাপারী রেগে ওঠে আতর আলির ওপর, লক্ষ্মীর গু কী রে ব্যাডা, আল্লার কাম লক্ষ্মীয়ে করবো কী?
ওইচ্চা ব্যাপারীর ভালো নাম ওয়াসেক গাজি। এক সময় লোকটি পাট ব্যবসা করতো। শোনা কথা শোনা যায়, বাজার থেকে পাট নিয়ে এসে সে পাটে পানি ছিটিয়ে দিতো ওজন বাড়ানোর জন্য। খুচরা গাহাক অত কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। বয়সের চাপে এখন মসজিদে না এসে পারে না। অথবা রাতভর ঘুমাতে পারে না বলে ভোর ভোর মসজিদে চলে আসে। আজান দেয় নিজের ইচ্ছেতে। সে আতর আলিকে আরো ধমকে বলেছিল, মসিদে বইয়া খোদার নাফরমানি কথাবার্তা কইলে আর আইস না!
আতর আলি পালটা বলেছিল, জন্মের পর থাইক্যা এই কথাই হুইন্যা আইতাছি, নতুন কথা কী আর কমু?
-ধান কালা অইয়া গেছে কইতে কি আঁট লাগে?
দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ফের বলে উঠেছিল ওইচ্চা ব্যাপারী।
সফদর আলি সে সব কথাবার্তা শুনেও কিছু বলতে আগ্রহ বোধ করেনি। যদিও তার মনে হচ্ছিল ওইচ্চা ব্যাপারী খুব ন্যায় সংগত ভাবে কথাগুলো বলেনি। সে নিজে নামাজের সুরা কেরাত যতটা না জানে তার চেয়ে আরো কম জানে আল্লা-রসুল আর ধর্ম সম্পর্কে। না জেনে ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করলে বা মিথ্যা বললে শেষ বিচারের দিনে জিহ্বা কাটা যাবে। জুম্মার খোতবা বা অন্যান্য ওয়াজ মাহফিলের সময় এমন অনেক কথাই শোনা যায় মোল্লা-মাওলানাদের মুখে। কিন্তু কোনো মেয়ের তিনকুলে কেউ না থাকলে সে ঘরে বসে থাকলে তার খাওয়া পরার ব্যবস্থা কীভাবে হবে তা নিয়ে কোনো কথা বলতে শোনা যায় না এসব কথার রাজাদের।
ক্ষেতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ওইচ্চা ব্যাপারীর কথাগুলো নিয়েই মনেমনে নাড়াচাড়া করছিল সফদর আলি। লোকটা ওভাবে রেগে না উঠে আতর আলিকে বোঝাতে পারতো। কিন্তু বাজারে গেলে লোকজনের এসব হারাম হালাল নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় থাকে না। টাকার গায়ে, ধান-চালের গায়ে হিন্দু মুসলমান লেখা থাকে না। তবু লোকজন এসব নিয়ে নানা রকম নিয়মের কথা শোনায়। ওইচ্চা ব্যাপারীর বাপও গতকাল লক্ষ্মীর গু বলেছে ধানের কালো হওয়া অবস্থাকে। লোকটা কি তার বাপকে এমন কথা বলতে পেরেছিল? মসজিদের ভেতর একবার কথাটা মনে হলেও বিতর্কের ভয়ে রা করেনি সে। বলা যায় না কোন কথা থেকে কোন কথার জন্ম হয়ে জীবনে কখন অশান্তি নেমে আসবে।
বাড়িতে ঢুকবার মুখেই তার চোখে পড়ে উঠোনের এক পাশেই খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে ষাঁড় গরুটা। এদিক দিয়ে তার বউ আমিনা ভালোই বলা যায়। গরুর দেখাশোনা, গোয়ালঘর সাফসুতরো রাখা, বাড়ি-ঘর, উঠান ঝাঁটপাট দিয়ে বেশ পরিচ্ছন্ন রাখে। তবে মানুষ হিসেবে বউটার চোটপাট সাধারণের তুলনায় কিছুটা বেশি বলেই মনে হয়। অবশ্য তার কথাগুলো এ পর্যন্ত কোনোটাই অকাজের বলে মনে হয়নি। যেমন জমি তার মতে ষাঁড় গরু পুষে লাভ নেই। যেহেতু জমি চাষের কাজ হ্যান্ড ট্রাক্টর দিয়েই চলে। ধান মাড়াইতেও গরুর কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে শুধু শুধু ষাঁড় কেন পুষবে? তখন থেকেই একটা বকনা বা গাই গরু কিনবার চিন্তাভাবনা চলছে তার মনে। ষাঁড় গরুটা বেচে দেবে শুনতে পেয়ে দুজন গাহাক দেখেও গেছে। তবে বলে গেছে টাকার মিল করে শীঘ্রই তারা নিয়ে যাবে ষাঁড়টা।
বাড়িতে এসেই ষাঁড় গরুটার সামনে এলোমেলো হয়ে থাকা খড়গুলো গুছিয়ে দিয়ে ঘরে ঢোকে সে। দূর থেকেই হয়তো তাকে আসতে দেখেছিল আমিনা। তাই আগে থেকেই খাবার নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। তাকে দেখে বলল, হাত-মুখটা ধুইয়া আইতেন!
-আইতাছি!
বলেই ফের ঘর থেকে বের হয় সফদর আলি।
চাপকলের পাশে এলে প্রতিবারই তার মনটা একবার খারাপ হয়। চার-পাঁচ মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মীরা কলের মুখে লাল রঙ লাগিয়ে দিয়ে গেছে। আর্সেনিক মুক্ত কলের জন্য বাড়ির মানুষ সবাই মিলে টাকা জমা দিয়ে আবেদন করে এসেছে এক মাসেরও বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু কিন্তু এ পর্যন্ত আর্সেনিক মুক্ত কল বসাবার কোনো নাম গন্ধও নেই। খাওয়া আর রান্নার জন্য পানি আনতে আরেক বাড়িতে দিনে দুবার যেতে হয় আমিনাকে। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অতটা দূর থেকে পানি আনাতে ভয় হয় তার।
যদিও ডাক্তার আমিনাকে বলেছে সতর্ক থাকতে, তবু এ নিয়ে সে তেমন গা করে না। উলটো বলে, আমরারে প্যাডে লইয়া মায় পানি আনছে, উডান লেপছে, ধান সিদ্ধ করছে, ক্ষেতের মাডি কোপাইছে। আমরা পাঁচ বইন দুই ভাইয়ের কার কোন খুঁত পাইছেন বিদ্যা-শিক্ষা ছাড়া?
সফদর আলি আমিনার কথার পিঠে পালটা কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। তবু তার মনে চিনচিনে একটু শঙ্কা জেগেই থাকে। আগের স্ত্রী দশ বছর অপেক্ষা করে সন্তান হয় না বলে তাকে ছেড়ে চলে গিয়ে ছিল। অথচ ডাক্তার কোনো দোষ খুঁজে পায়নি তার।
২
সফদর আলি সকাল সকাল গরুটাকে বাড়ির পাশের ডোবা থেকে গোসল করিয়ে এনে উঠানের কোণে বেঁধে দিয়ে বলল, বউরে, আইজগা জুম্মাবার! তর মনে আছে এই কথা?
আমিনা রান্নাঘরে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। চুলা থেকে বেদম ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ধোঁয়ার তাণ্ডবে কাশতে কাশতে সে সেখান থেকেই জবাব দেয়, মনে আছে। হেইডা আসরের অক্তে!
আমিনার এ ব্যাপারটিতে বেশ মজা পায় সফদর আলি। ঘরের বেড়ায় টানানো দেয়াল ঘড়ি আছে একটি। আছে মোবাইল ফোনও। দুটো দিয়েই সময়ের পরিমাপ চলে। কিন্তু আমিনা এখনও সেই নানী দাদির আমলের হিসেবে কথাবার্তা বলে। তার সময় গণনা চলে নামাজের পাঁচ অক্ত ধরে। অথচ ডাক্তার বলেছিল শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে যেতে। অবশ্য এ সময়টাতে আসরের নামাজের আজান হয় বলে সেটাই তার কাছে সময় পরিমাপের মানদণ্ড হয়ে উঠেছে।
গরুটার সামনে খানিকটা খড় বিচালি টেনে দেবার সময় সফদর আলি দেখতে পায় রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে আমিনা। হাতে ছোট্ট একটি মাটির মালসা। পেটটা দিন দিন উঁচু হয়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে মুখটাও দিনকে দিন কেমন ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে। এ নিয়ে তার ভেতরকার দুরু দুরু ভাবটা কাটে না কিছুতেই। অনেক সাধ্য সাধনা-অপমান আর ধৈর্য ধরবার ফলে বাপ হবার মতো একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, ভাবলেই কেমন একটা আনন্দের শিরশিরে অনুভূতি ছুটোছুটি করতে থাকে মাথা থেকে পায়ের তলা অবধি। মনটা তখন আপনা আপনিই নত হয়ে আসে অদৃশ্য-লোকের সেই মহামহিমের প্রতি। ইচ্ছে করলে তিনি কত কিছুই না করতে পারেন। বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবার জন্যই তার করুণা অপার। তবু নানা রকম অজানা আশঙ্কা তাকে আমিনার অগোচরেই ডাক্তারের কাছে ছুটিয়ে মারে। তার অস্থিরতা দেখে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের তরুণী ডাক্তার মুখে হাত চাপা দিয়ে দাঁত লুকায়।
ডাক্তারের হাসি দেখে মোটেও বিচলিত না হয়ে সফদর আলি বলে, আম্মাগো, আপনে তো বুঝেন না আঁটকুড়া বদনামের কী কষ্ট! এই বদনাম তুইল্যাই তো আগের বউ ছাইড়া গেল আমারে।
-আপনার কষ্ট সবই বুঝি চাচা। আমি তো চাচিকে সবই বুঝিয়ে দিয়েছি। আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন।
-আপনের চাচির মুখটার দিকে চাইলে বুকটা কেমন ধড়ফড় কইরা ওডে। মনে কয় মানুষটার শইলের সব রক্ত পানি অইয়া গেছে। দেখতে চাপা পইড়া থাকইন্যা দুর্বার মতন লাগে অহন।
সফদর আলির কথা শুনে ফের হেসে ওঠে ডাক্তার। বলে, আপনি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন! সময় মতো ইশকুলে যান নাই কেন?
-আম্মারে, কী আর কইতাম দুঃখের কথা! বাপ অকালে মরলো। মায়ের একটাই পুত আমি। সংসার-ক্ষেতি সামলামু না ইশকুলে যামু?
একটি কাগজে দুটো ওষুধের নাম লিখে দিয়ে ডাক্তার সফদর আলির দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, এই ওষুধ দুটো নিয়ে গিয়ে খাওয়ান। ক্যাপসুলটা খাবারের পরে আর সিরাপটা খাবারের আগে খেতে দেবেন। আর শাকসবজি তো খাচ্ছেই প্রতিদিন।
সফদর কাগজ হাতে করে পাশের ওষুধের দোকানে দিতেই দোকানের ছেলেটা বলল, চাচিরে ভাত না খাওয়াইয়া খালি ওষুধই খাওয়াইবানি?
-এত কথা কইস না বজ্জাতের ছাও! ওষুধ দুইডা দে তরাতরি! নমাজের দিন দেরি করাইস না।
ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেই সফদর দেখতে পায় দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে কেমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছে আমিনা। সঙ্গে বসে আছেন পাশের ঘরের ছোট চাচি। অজানা শঙ্কায় বুক দুরু দুরু করে তার বুক। খানিকটা দ্রুত পা চালিয়ে এসে বলে, কী সমস্যা?
-বাজান!
আমিনার পাশ থেকে ছোট চাচি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা বলে ওঠেন। বউডারে বাপের বাড়িত থুইয়া আয়, নয়তো একটা কামের মানুষ রাইখ্যা দে! এই অবস্থায় কাজ-কাম করনডা...।
ছোট চাচি কথা শেষ না করে থেমে যেতেই আমিনা বলে ওঠে, বকুলডারে ফোন দেন দেহি।
সফদর আলি ঘরে ঢুকে জায়গা মতো ওষুধগুলো রেখে ফোন বের করে। তারপর কারো সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা দিয়ে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, আমিনার লগে কথা কন, বলেই ফোন বাড়িয়ে ধরে স্ত্রীর হাতের কাছে।
-কে ধরছে?
-আম্মায়।
আমিনা ফোন হাতে নিতেই এক পাশে সরে গিয়ে আমিনার কথা শুনতে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়ায় সফদর। কিন্তু আমিনা হঠাৎ কাঁদতে আরম্ভ করলে ব্যাগ্র কণ্ঠে সে জানতে চায়, কান্দ ক্যারে?
আমিনা হয়তো শুনতে পায় না স্বামীর কথা। সে বলছিল, আপনে আইয়েন তাইলে। না, ডর নাই। হাসপাতাল ডাক্তর ঘরের কাছেই। না না। অনেক লম্বা রাস্তা। পথেই তাইলে মইরা থাকমু। হ। বকুলরে ঘরে দিয়া আইয়েন।
ফোনের ও প্রান্তের কথা কিছুই শুনতে পায়নি বলে সফদর বলে, আম্মায় কী কইল, আইবো?
ফোন ফিরিয়ে দিতে দিতে আমিনা জানায়, আইবো দিন কয়েকের লাইগ্যা। পরে যাইয়া বকুলরে পাডাইবো।
-ভালাই অইছে।
সফদরের কণ্ঠে এক ধরনের প্রশান্তি ঢেউ তোলে। তারপর আবার বলে, তর এই সময় কাছের কেউ থাকলে আমার চিন্তা কমে।
ফোন রেখে দিয়ে সফদর আলি লুঙ্গি গামছা হাতে ঘর থেকে বের হতে হতে বলে, সিরাপটা ভাত খাওনের আগে এক মুখা খাইও। আর একটা ক্যাপসেল খাওনের পরে। আমি গাও গোসল দিয়া আইতাছি।
সফদর আলি যেতে যেতে শুনতে পায় ছোট চাচি বলছেন, ডরাইস না মা, উপরে আল্লায় আছে!
৩
খোতবার আযান হবার আগে দিয়ে জুনু মোল্লা বেশ কিছুক্ষণ হাদিস কোরান থেকে বয়ান করেন। এ সময় তিনি দেশের নানা পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। বলেন যে, আজকাল মেয়েদের লজ্জা-হায়া অনেক কমে গেছে। বাজারে গিয়ে পুরুষের সঙ্গে ধাক্কা-ধাক্কি করে বাজার-সওদা করে। বাসে পুরুষের ভিড় ঠেলে উঠে পড়ে। ঠেলা-গুঁতো খায় আর এ থেকেই বাড়ছে দুনিয়ার অশান্তি। বেগম রোকেয়া একটা খারাপ মহিলা ছিল। সে শিক্ষিত হইয়া নিজে খারাপ হইছে। অন্যদেরকেও খারাপ বানাইছে। কে বলছে তারে শিক্ষিত হইতে? আল্লায় মেয়েদের বানাইছেন স্বামীরে ভালোবাসতে আর বাচ্চা পয়দা করতে। তাদের বাইরে যাওয়া, বাজারে যাওয়া, চাকরি-বাকরি করনের দরকার কি?
সফদর আলির পছন্দ হয় না কথাগুলো। আগের বয়ানগুলোতে জুনু মোল্লা হাদিসের নাম বা কোরানের আয়াতের কথা বলতেন। নয়তো বা বলতেন আল্লা অথবা আল্লার রসুল বলেছেন। কিন্তু আজ কোরান হাদিসের উল্লেখ ছাড়া এ কী ধরনের বয়ান? তাহলে কি লোকটি নিজের মনগড়া কথা বলছে? এভাবেই এরা নানা রকম মিথ্যা চালিয়ে দেয় মসজিদের ভেতর। মেয়েরা বাইরে না গেলে, বাজার-সদাই না করলে চলবে? এ ধরনের মানুষগুলাই পড়শিকে ক্ষুধার্ত রেখে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মক্কা-মদিনা ছোটাছুটি করে। প্রতিবেশীর হক আদায় না করলে সে কি সাচ্চা মুসলমান হতে পারে?
সফদর আলি হঠাৎ আচ্ছন্নের মতো হাত তুলে বলে, সোয়ামীরে ভালা পাইতে আর বাচ্চা পয়দা দিতে তাগোরে বানান হইছে, কথাডা হাদিসে না কোরানে পাইলেন, এই কথা তো কইলেন না মলিসাব? আগের এক বয়ানে কইছিলেন, মা আয়শাও যুদ্ধ করছেন।
জুনু মোল্লা হঠাৎ রেগে উঠে বললেন, হাদিস কোরানের কী বুঝস তুই? মা আয়শা যখন যুদ্ধ করছেন হেই সময় আর অহনকার সময় কি এক হইল? হাদিস না কোরানের কথা তা জাইন্যা করবি কি তুই? কয় আয়াত কোরান জানস? কয়ডা হাদিস জানস, নাদান?
-আপনে তো জানেন। কথাগুলা কোরান না হাদিসের ঠিক মতন না জানলে ঘরে গিয়া বউরে কী কমু?
তীব্র রোষে জুনু মোল্লা বলে উঠলেন, ওরে জাহেল মূর্খ, এখানে তর চাইয়াও আরো অনেক শিক্ষিত মানুষ আছেন। ইশকুলের মাস্টার। কলেজের পরফেসার! তারা তো তর মতন অমন ফড়ফড় করে না।
-তারার বউ কেউ কেউ নিজেরা পড়তে পারে। হাটে বাজারে ইশকুল কলেজে যায়। আমার বউ তো বাপের বাড়ি ছাড়া হাটে বাজারে যায় না। মসিদেও আইবো না। আমি গিয়া তারে না কইলে জানবো কেমনে?
জুনু মোল্লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, সব কথা হাদিস কোরানে থাকতে হইব এমন কোনো কথা নাই।
-আপনেই তো আগে কইছেন হাদিস কোরানের বাইরে সব কথা শয়তানের বয়ান।
-এই, তর নাদানি বন্ধ করবি? জালিম কোহানকার! বুঝে না কথার আগা মাথা হ্যায় আইছে কথার টোক ধরনের লাইগ্যা।
হঠাৎ সফদর আলি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনের পিছে আর নমাজ পড়তাম না। হাদিস কোরানের লগে নিজের মনগড়া কথা কইবেন, জালিম আপনের থাইক্যা বড় কে আর আছে?
বলতে বলতে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে সফদর আলি। গ্রামের আরেক প্রান্তে আরো বড় একটি মসজিদ আছে। সেখানেই নামাজ আদায় করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ছোটখাটো মোল্লা-মাওলানারা নিজেদের অনেক জ্ঞানী আর চালাক ভাবে। যে কারণে তারা নিজেরদের জ্ঞানের প্রাচুর্য প্রকাশে প্রায়ই নানা রকম মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এমন অসৎ মানুষের পেছনে নামাজ পড়ে কেন নিজের ইমানের ক্ষতি করে মানুষ? অনেক শিক্ষিত আছে যারা আলিফ বা চেনে না। সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রতিবাদ করে না। যে শিক্ষা দেশের বা দেশের মানুষের কোনো উপকারে আসে না সেই শিক্ষা অর্জনের চেয়ে মূর্খতা অনেক ভালো। এসব জটিল থেকে জটিলতর কথা ভাবতে ভাবতে বড় মসজিদের দিকে জোরে সোরে হাঁটতে থাকে সে।
হঠাৎ খোতবা পাঠের শব্দ ভেসে আসে বড় মসজিদের মাইক থেকে।
সফদর আলি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। শেষে দেরি হয়ে যাবে ভেবে দৌড়াতে থাকে। যে করে হোক জামাতে তাকে সামিল হতেই হবে। সপ্তাহে একদিন জুম্মা। গরিবের জন্য হজ্বের সমান। সে আরো দ্রুত গতিতে ধাবিত হয়। খোতবা শেষ হলেই জামাত শুরু হয়ে যাবে।
-----------
পাদটীকা:
টোক= দোষ, খুঁত।
আঁট= কষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:১৩