আজকাল সব কিছুতেই যেন অরুচি ধরে গেছে কুলসুমের। যদিও আগের মতো হাত টানাটানি নেই, খরচ করতে পারছে দু’হাতে, তবু যেন মন ভরে না। এরই মাঝে মা সখিনা বেগম চাপ দিয়েছেন তিন রুমের একটি পাকা ঘর তুলে দিতে।
একটা সময় কত কাঙাল ছিল বাইরের মুক্ত জীবনে ঘুরে বেড়ানোর স্বাদ পেতে। কিন্তু সংসারে স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতন, শ্বশুর-শাশুড়ির অকথ্য-ভাষার চাবুক সব মিলে যেন একটা দ্রোহের ধনু বানিয়ে তুলেছিল তাকে। অথচ আজকাল সেই গ্লানিময় নরকে ফিরে যেতেই যেন তার মন আকুল হয়ে থাকে সারাক্ষণ।
অবশ্য হাশেমের অত নিগ্রহ সয়েও তার কখনো তার মনে হয়নি সংসার ছেড়ে আসবার কথা। কিন্তু জীবনের সহজ সরল পথেও ক্রমাগত হোঁচট খাওয়া উচ্চাভিলাষী মায়ের মন্ত্রণা তাকে সাহস যুগিয়েছিল মোস্তফা ওরফে মস্তুর আহ্বানে সাড়া দিতে। তাই হয়তো হাশেমকে ডিভোর্স দেবার পেছনে মা সখিনা বেগমের লোভকেই দায়ী করে সে।
যৌবনে টাকার মোহে ভালো-মন্দ বাছ-বিচার না করেই সখিনা বেগম গো ধরেছিলেন কৃষকের ছেলে আধা কৃষক আধা শিক্ষিত গফুর মিয়াকে বিয়ে করবেন বলে। কিন্তু পরিবারের চাপ আর অসম্মতি অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বরং সখিনা বেগম আত্মহত্যার ভয় দেখিয়েছিলেন।
সন্তানের মৃত্যু কোনো পিতামাতার কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই বাবা মনু মিয়া চোখের জল মুছে নিয়ে অবনত মস্তকেই কন্যার বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করতে গিয়েছিলেন। অনভ্যস্ত পরিবেশ আর পরিবার কোনোটার সংগেই তার সখ্য না হলেও প্রকৃত মোহ ভাঙতে আরম্ভ করেছিল শেফালি আর কুলসুমের জন্মের পর। যার পরিণতি তালাক নামক শব্দে এসে পূর্ণতা পেয়েছিল। বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল সখিনা বেগম আর ওয়াসিমের দাম্পত্য জীবনের পচা-গলা সম্পর্কের রজ্জু।
মায়ের জীবনেও তালাক। কন্যার জীবনেও তালাক। এ ছাড়াও মাতা-কন্যার জীবনে অনেক মিল থাকলেও যুগের হাওয়ায় তার অনেক কিছুই বদলে গিয়ে থাকবে। যে কারণে মস্তু মিয়ার প্রবাস মাতা-কন্যাকে ধাবিত করে উশৃঙ্খল জীবনের প্রতি। মাসে মাসে মেয়ের হাতে টাকা আসে। সেই টাকা দুহাত ভরে উড়ানোর সুখে মেয়ের চোখের চাকচক্য বাড়ে। মেয়ের চোখের দ্যুতি দেখে মা সখিনা বেগম খুশি হলেও কুলসুমের আসন্ন পতন দেখতে পেয়েও পাত্তা দিতে চান না। প্রবাসীর বউ এক আধটু এমন হয়েই থাকে ধারণাটিকে যেন আরো পাকাপোক্ত করে দিতে চান কন্যার জীবনে। কিন্তু স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারলেও সন্তান পরিত্যাগ সহজ ছিল না কুলসুমের পক্ষে। মায়ের মন সন্তানের জন্য হাহাকার করলে জগতের এমন কোনো জৌলুস নেই তাকে আড়াল করতে পারে।
নতুন শ্বশুর বাড়ি তার জন্য জেলখানা না হলেও নিজেকে নজরবন্দী মনে হয়। তাই ছুতানাতায় নানীর বাড়ি যাওয়া একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানীর বাড়ি আর স্বামীর বাড়ির মধ্যবর্তী অংশে প্রাক্তন স্বামী হাশেমের বাড়ি। যেখানে আছে তার একমাত্র সন্তান। বেশ খানিকটা দূরত্বের ব্যবধানে অনেককে বোকা বানানো সহজ আর নিরাপদ।
হাশেমের বাড়ি এক সময় তারও ছিল। সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে এলে কে বা দূরবীন লাগিয়ে দেখতে আসছে? তা ছাড়া নানীর বাড়ি থেকে বাজারের কথা বলে বের হয়ে আসা যায় খুব সহজে। তখন সে কোথায় আছে তা জানবার সুযোগ নেই কারো। কাজেই পুরোনো সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ডালপালা আর নতুন পাতায় সবুজ হয়ে উঠলে নির্দ্বিধায় নতুন স্বামীকে বলতে পারে- তুমি এখন দেশে আসবার প্রয়োজন নাই। টাকা-পয়সা খানিকটা বেশি পাঠালেই হবে।
মস্তু জাপানী মূলার রঙে অন্ধ বলে মূলার গায়ে লেগে থাকা ক্ষেতের মাটি আর ময়লা দেখতে পাবে না বিশ্বাসটা হয়তো বেশ শক্ত আর পোক্ত হয়েই কুলসুমের মনে গেঁথে ছিল। কিন্তু সময় বড্ড নির্লজ্জ। তার মাঝে কোনো রকম রাখঢাক নাই। নানীর বাড়ি আসবার পথেই হাশেমকে রিঙ দেয় কুলসুম।– কেমন আছ? আমার বাচ্চাটা কেমন আছে?
হাশেম তখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কুলসুমের ফোন পেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, আমি তো ভালো আছি। তোমার বাচ্চা কেমন আছে নিজের চোখে দেখে যাও।
-সত্যি বলছ?
-তো কি মজা করছি?
-মা রাগারাগি করবেন না?
-বাবা মারা যাবার পর মা এখন বাবুরামের সাপ। তোমার ভয় নাই।
কুলসুম যেন উড়তে থাকে। অদৃশ্য পাখা পতপত করে মনের আকাশে। ফোনের লাইন কেটে দিয়ে এগিয়ে যায় সিএনজি অটোরিকশা স্টেশনের দিকে। কাদা ভর্তি মেটে পথে যেতে রাজি হয় না কোনো চালক। মেইন রোড ধরে যেতে বললে একজন জানায়- হেই রাস্তাত যাইতাম না। পুলিশে ধরে।
অগত্যা দীর্ঘদিনের অবহেলিত তিন-চাকার রিকশাই ভরসা। রিকশায় উঠতেই ফের ফোন বাজে। মস্তু মিয়ার ফোন। – শোনো, কাগজপত্র সব প্রায় ঠিকঠাক। মাস দেড়েকের মধ্যেই তুমি আমি এক ছাদের নিচে থাকতে পারব।
-তার আর দরকার নাই। হাশেমকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আমি।
-তাহলে আমার অত চেষ্টা শ্রম টাকা-পয়সা খরচের কী হবে?
-আমি জানি না। তার চেয়ে ভাল হয় আমাকে তালাক দিয়ে দাও।
-তাহলে হাশেমকে ছেড়ে আমাকে ধরেছিলে কেন?
-সেটা তখনকার ব্যাপার ছিল। আর এখনই যদি আসতে চাও, তাহলে যেসব জিনিসপত্র আনতে বলেছি তার প্রত্যেকটা চাই!
-তোমার চাহিদা পূরণ করতে গেলে আমার এখন পাঁচলাখ টাকা লাগবে।
-তাহলে দেশে আসবার ভাবনা বাদ দাও।
কুলসুম ফোন বন্ধ করে দেখতে পায় রিকশা থেমে আছে। চালক রিকশা ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার এক পাশে।
-কী হলো তোমার বুড়া মিয়া? রিকশা থামালে কেন?
কুলসুমের কণ্ঠে বিরক্তি আর রাগ দুটোই খনখন করে বাজে।
-রিশকা আর যাইতো না।
নির্বিকার কণ্ঠে জানায় বুড়ো রিকশা চালক।
-কী হইছে?
-ফিরিবল নষ্ট!
কুলসুম রিকশা থেকে নেমে ফিরে যেতে থাকে সিএনজি অটোরিকশা স্টেশনের দিকে। ফের ফোন বাজতে থাকে তার।
বুড়ো রিকশা চালক পিছু ফিরে বিড়বিড় করে একবার ‘নডি’ বলে কাউকে গালি দেয়। তারপর রিকশা টেনে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে।
--------
***ছবিটি নিয়েছি গুগুল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৫২