(ছবিটি গুগুল থেকে নেয়া।)
দু কাঁধে দুটো স্টেনগান আর হাতে শুকনো খাবারের পুটলি ঝুলিয়ে খুব সন্তর্পণে হাঁটছিল সামাদ। হয়তো বা এ জন্যেই তাকে পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল অনেকটা। যদিও সে চেষ্টা করছিল এগিয়ে গিয়ে দলের সঙ্গে মিশে যেতে, তবু কাঁধ আর হাত-পা অবসন্ন হয়ে আসতে চাচ্ছিল বারংবার। ইচ্ছে হচ্ছিল পথেই বসে পড়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়।
কয়েকদিনের পর্যবেক্ষণে জানা গেছে অন্যান্য গ্রামের তুলনায় এই শ্রীমন্তপুর গ্রামটা বড় হলেও মোটামুটি নিরাপদ। চারদিকে বেত আর মোরতার ঘন জঙ্গল যতটা চোখে পড়ে সে তুলনায় ঘরবাড়ি ততটাই কম। বেশির ভাগই শনে ছাওয়া মাটির ঘর। তারপরও যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একজন নিঃসঙ্গ যোদ্ধাকে সতর্ক থাকতেই হয়। যেহেতু দেশীয় কিছু মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় রয়েছে। আর এ ভাবনাগুলোই সামাদের মাথাটাকে প্রায় গরম করে রেখেছিল।
সে সঙ্গে এটাও ভাবছিল যে, রেজাকারগুলো কেনই বা সব মুসলমান ধর্মের? মুক্তিযুদ্ধে যেমন সব ধর্মের মানুষ জড়িত, রেজাকারদের সঙ্গে কেন কোনো হিন্দু নেই? কোনো বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান? নাকি আছে? সংখ্যায় কম বলে চোখে পড়ে না? নাকি সত্যি সত্যিই সব রেজাকার মুসলমান? এমন কি ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থেকেও নিজেদের ইসলামের ঠিকাদার মনে করে এসব লোকজন। অবশ্য এ পর্যন্ত যে ক’টি অপারেশন হয়েছে অমুসলিম রাজাকার একটিও ধরা পড়েনি বা মারা যায়নি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
শ্রীমন্তপুর গ্রামটির পরেই গাজীপুর। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোটখাটো একটি ঘাঁটি রয়েছে। সেখানে গিয়েই তাদের দলের লোকজন যোগ দেবে। কিন্তু তার আগেই সামাদের চোখে পড়ে খালের পাড়ে একটি হিজলের ছায়ায় আশি-পঁচাশি বয়সের এক বৃদ্ধ কাত হয়ে পড়ে আছেন। পরনে ময়লা ধূতি আর ফতুয়া। মাথার সফেদ চুলে কতদিন তেল চিরুনি লাগেনি কে জানে। মুখের দাড়ি না কামানোর ফলে অনেকটা বেড়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটির পাশে কাঁধের অস্ত্র দুটো আর হাতের পুটলিটা নামিয়ে রেখে বসে পড়ে সামাদ। বলে, দাদু আছেন কেরুম?
বৃদ্ধের মুখে কোনো শব্দ ফোটে না। দেখেই বোঝা যায় বেশ দুর্বল।
পাকিদের নানা রকম অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামের আনাচ-কানাচের পথ ধরে ভারতীয় সীমান্তের দিকে ছুটছে। এ বৃদ্ধও হয়তো তেমনই কোনো একটি দল থেকে পিছিয়ে পড়া অথবা সঙ্গের লোকজন নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সঙ্গে নেয়নি ইচ্ছে করেই। লোকটির দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হয় সামাদের। ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারে না সে। মানুষটিকে এড়িয়ে গেলেও এক রকম দায়িত্বে অবহেলা করা হবে। অন্য দিকে আরো পিছিয়ে থাকলে দল থেকে বাদ পড়ে যাবে। এভাবে দোটানায় বেশ কিছুটা সময় অপচয় করে বৃদ্ধের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল চোখ দুটো বন্ধ। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা তা পরখ করতে বৃদ্ধের নাকের সামনে হাত রাখে। ঠিক নিশ্চিত হতে না পেরে গায়ে হাত দিয়ে ডাকে, হুনতাছেন? ও বুড়া দাদু!
বৃদ্ধ চোখ মেলতেই সামাদ ফের জিজ্ঞেস করে, কই যাইবেন?
বিড়বিড় করে মানুষটি কিছু বলে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না সামাদ। মনে মনে ভাবে যে, মানুষটিকে আশপাশের কোনো বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারলেও অনেকটা উপকার হতো। এখানে এভাবে একাকী পড়ে থাকলে আরো দুর্বল হয়ে হয়তো মারা যাবে লোকটি। শেষটায় বৃদ্ধকে টেনে তুলে বসিয়ে দেয় সে। তারপর উঠে গিয়ে খালের পানিতে নেমে এক আঁজলা পানি নিয়ে এসে বৃদ্ধের মুখের সামনে ধরে বলে, জল খান!
বৃদ্ধ মুখ না বাড়িয়ে বললেন, তোর জাত কী?
কথা শুনে সামাদের দুহাতের আঁজলা চুইয়ে পানি পড়ে যায়। মনে মনে বিরক্ত হলেও ফের পানির কথা জিজ্ঞেস করতে ভরসা পায় না। বলে, উঠতে পারবেন? সামনের বাড়িডায় আপনেরে দিয়া যাই!
বৃদ্ধ লোকটি হঠাৎ সামাদের দু কাঁধ খামচে ধরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে।
সামাদ ভাবছিল যে, সামনের বাড়ির লোকজন কোন জাতের কে জানে। অথবা মানুষ জন আছে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া মানুষ থাকলেও বৃদ্ধের স্বজাতের মানুষ না হলে সমস্যা আরো জটিল হয়ে পড়তে পারে। আর সত্যি সত্যিই বাড়িটা জনশূন্য দেখে খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সে। হাঁকডাক করেও কারো কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে বৃদ্ধকে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে ভেতর বাড়ির দিকে যায় সে।
মাটির ঘরের বদ্ধ দরজা ঠেলতেই খুলে যায়। ভেতরে কেউ নেই। প্রায়ান্ধকার ঘরের পেছনের দিকে আরেকটি দরজা দেখতে পেয়ে সেটি খুলে একটি উঠোনে এসে নামে সামাদ। উঠোনের দক্ষিণাংশে একটি তুলসী বেদী। যেখানে একটি ছোটখাটো তুলসী গাছ উঁকি মারছে কয়েকটি মাত্র পাতা নিয়ে। উঠোনের পশ্চিম প্রান্তে আরেকটি শনে ছাওয়া মাটির ঘর। দরজা খোলা। তার সঙ্গেই দক্ষিণে লাগোয়া আরেকটি টালি ছাওয়া ছোট ঘর। হয়তো বা রান্নাঘর। উঠোনের ডান প্রান্ত একটি চালার নিচে দুটো গরু বাঁধা। দুটো প্রাণীই বসে আছে চুপচাপ। সামনে ঘাস-বিচালির কোনো চিহ্ন নেই।
গরু থাকলে মানুষও থাকবে। এমন একটি ভাবনা থেকেই আশান্বিত হয়ে সে এগিয়ে যায় পশ্চিম ভিটের ঘরটির দিকে। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ‘কেউ আছেন নি?’ বলতেই একটি কুকুর বেরিয়ে ছুটে যায় তার সামনে দিয়ে।
তড়িঘড়ি ঘরে ঢুকেই সামাদের চোখে কিছু পড়ে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে কান পেতে কিছু একটা শুনতে চেষ্টা করে। তখনই সে শুনতে পায়, সতু আইলি রে দাদা?
ঘরের বন্ধ জানালা দুটো খুলে দিতেই ঘরের ভেতরকার অন্ধকার ভাবটা কেটে যায়। আর তখনই তার চোখে পড়ে ঘরের এক কোণে একটি বিছানার ওপর সাদা কাপড়ের পুটলির মতো কিছু। আর শব্দটা সেখান থেকেই এসেছে। ঘরের আরেক কোণে আরেকটি শূন্য চৌকি। সে এগিয়ে গিয়ে দেখে একজন বয়স্কা নারী। মাথা ভর্তি সাদা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ছোটখাটো একটি শরীর। প্রায় নিথর। বয়সের কারণে হয়তো চলাফেরা করতে পারেন না। কত বয়স হবে অনুমান করা কঠিন। আর তাই হয়তো বোঝা হালকা করতেই বৃদ্ধার কাছের মানুষ, বিশেষ করে সতু নামের নাতি নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে অসহায় মানুষটাকে ফেলে পালিয়েছে। স্বার্থপরতার নমুনা দেখে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় সামাদের।
বৃদ্ধার কাতরানো শুনে তার কপালে হাত রাখে সামাদ। জ্বর অনেক। এখনই জলপট্টি দিতে হবে। পারলে পুরো শরীর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। সে বৃদ্ধার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, দিদি মা কিছু কইলা?
-গলাডা শুকাইয়া গেছে দাদা!
-আনতাছি।
বলে, ঘরেরএদিক ওদিক তাকায় সে। কিছু একটা খোঁজে যেন। মোটামুটি কাঁসার তৈজসপত্র সবই আছে। মুখ ঢাকা দেওয়া একটি মাটির কলস দেখে সেটা নেড়ে দেখলো পানি ভরা আছে। তার পাশেই একটি কাঁসার গ্লাস মাটিতে পড়ে আছে কাত হয়ে।
সেটি তুলে নিয়ে কলস থেকে পানি ঢেলে নিয়ে সেটাকে ভালো মতন ধুয়ে নেয়। পরিষ্কার গ্লাসে ফের কলস থেকে পানি ঢালতে ঢালতে সে ভাবে যে, যুদ্ধ হচ্ছে দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্যেই। এই যে দুটো প্রবীণ প্রবীণাকে দেখবার মতো কেউ নেই। তাদের অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়ে কি যুদ্ধ করতে পারবে সে? তাঁদের দুজনকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাটাও কি একটা যুদ্ধ নয়?
বৃদ্ধার কাছে গিয়ে তার পিঠের নিচে একটি হাত দিয়ে বলে, দিদিমা উইঠ্যা বইতে পারবা?
-তোল দাদা।
বৃদ্ধাকে তুলে বসাতেই মল-মূত্রের একটি বিদঘুটে গন্ধ এসে নাকে লাগে সামাদের। অবস্থা দেখে তার মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। বেচারি কদিন ধরে এক নষ্ট কাপড়ে অনাহারে আছেন কে জানে! প্রাণের মায়া কি এতোটাই যে, অসহায় মানুষের জন্যেও টান থাকে না?
বৃদ্ধাকে ফের শুইয়ে দিয়ে বাইরে থেকে বৃদ্ধ লোকটিকে ভেতরের ঘরে নিয়ে আসে সামাদ। শূন্য চৌকিটাতে বসিয়ে দিয়ে নিজের পুটলি থেকে খানিকটা মুড়ি বের করে একটি থালায় করে সামনে রাখে। তারপর কাঁসার গ্লাসে ফের পানি নিয়ে এসে বৃদ্ধের সামনে বাড়িয়ে ধরতেই বৃদ্ধ বললেন, তোর জাত-পাত জানি না, জল মুখে দেই কেমনে?
-আমি জাতে বামুন।
-বামুন হইলে পৈতা কই?
-রেজাকারগো ডরে পৈতা ফালাইয়া দিছি।
সামাদের কথা শেষ হয় কি হয় না, বৃদ্ধ প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে পানি ভর্তি গ্লাসটা কেড়ে নেন। তারপর ঢক ঢক করে গ্লাস শূন্য করে দিয়ে বললেন, কইলজাডা শীতল করলি দাদা!
-তুমি মুড়ি খাও! আমি দিদি মার গাও মুছাইতে হইব।
বৃদ্ধের কথা শুনবার সময় নেই সামাদের। একটি পুরোনো গামছা চোখে পড়তেই সেটা ভিজিয়ে বৃদ্ধার কপালে জলপট্টি দিয়ে দেয়। খানিকটা আরাম পেতেই হয়তো তিনি আহ শব্দে চোখ বোজেন।
ঘর থেকে বের হয়ে টালির ছাউনির ঘরটাতে ঢুকতেই একটি পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর চোখে পড়ে তার। মাটির দেয়ালে লাগানো বাঁশের মাচায় গোছানো হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি রাখা আছে। যেন কিছুক্ষণ পরই ঘরের মানুষটি এসে চুলো ধরাতে বসবেন। ঘরের কোণে একটি কোদাল আর শাবলও রাখা আছে। শুধু একটি টিনের বালতি একটি কাঠের জলচৌকির ওপর উপুড় করে রাখা আছে। চালের দিকে জড়ো করে রাখা অনেক শুকনো ডালপালা। আরেক কোণে শুকনো পাতার স্তূপ। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থেকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে মাথা চুলকায় সে। তারপর বেরিয়ে এসে ফের আগের ঘরটাতে ঢোকে।
দুই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই সামাদের চোখে পড়ে ঘরের কোণে একটি মাটির মটকা। এগিয়ে গিয়ে মটকার মুখ থেকে মাটির সরা সরিয়ে ভেতরে হাত দিয়ে এক মুঠো সেদ্ধ চাল বের করে আনে। মনটা খুশি হয়ে ওঠে তার। ঘরে মটকা ভর্তি চাল যখন আছে বাকি তেল-নুন-মশলাপাতি কম-বেশি পাওয়া যাবেই। এখন প্রথম কাজ হবে বৃদ্ধার পরিচ্ছন্নতা। বিছানা আর পোশাক পালটানো। তারপর রান্না-বান্নার ব্যবস্থা।
ভাবতে ভাবতে সামাদের মন থেকে অবসাদ কেটে যায়। ফের রান্নাঘর থেকে বালতিটা হাতে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে যায়। বাড়ির পেছন দিকে একটি পুকুর চোখে পড়ে। পুকুরের কাছাকাছি একটি বড়সড় খড়ের গাদাও দেখা যায়। বালতি রেখে বেশ কিছুটা খড় টেনে গরু দুটোর সামনে ফেলতে ওরা নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ায়।
বৃদ্ধকে প্রায় বয়ে আনতে গিয়ে দলছুট হয়ে যাবার কারণে মনে যে অপরাধ বোধটা তাকে খোঁচাচ্ছিল, বৃদ্ধার অবস্থা দেখে মনের সেই অপরাধ বোধ পুরোপুরিই মুছে গেছে। হাতের বালতি পুকুরের পানিতে ডোবাতে ডোবাতে সামাদ ভাবে, অসহায় দুটো বয়সী মানুষের নিরাপত্তা, সেবা-যত্ন মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান আর পবিত্র কিছু না হলেও পাকি আর রাজাকারদের মতো অমানবিক কিছু নয়।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০২