আজকে তোমারে মা সম্বোধন কইরা তোমার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা অযথা বাড়াইতে চাই না। তোমার ইমেইল আইডি নাই। যে কারণে তোমারে ইমেইল করতে পারি না। তোমার সুনির্দিষ্ট ঠিকানাও নাই যে, ডাক মারফত তোমার কাছে একটি চিঠি ভেজিয়া দিব। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হইল যে, তুমি অনেকদিন আগে থেকেই শ্রবণযন্ত্রের বিকলতায় ভুগতেছ। ফলত, দূরকথন যন্ত্রের মাধ্যমেও তোমার সংগে কথা বলার সুযোগ নাই। আর এখন যেখানে তোমার বসবাস, সেখানে কথা বলা দূরে থাক তোমার সঙ্গে দেখা করতেও আমার মন কোনোদিন কেমন কেমন করবে না।
একবার তোমার কোনো আচরণের প্রেক্ষিতে আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, তুমি আমারে পেটে ধরো নাই। এমন সন্দেহের কথা তোমাকে জানাইলে তুমি স্বাভাবিক ভাবেই আমার কোনো নতুন গল্পের থিম মনে করে পাত্তা দাও নাই। কিন্তু আছু ফুপুরে যখন বললাম, আসলে এই মা আমারে লালন পালন করলেও আসলে পেটে ধরে নাই। হাসপাতালে এই মায়ের সদ্যজাত ছেলে মারা গেলে বাবার পরিচিত নার্সেরা কোনো মৃত মায়ের সন্তান তুলে এনে তোমার বুকের কাছে রেখে গেছিল। অথবা তোমার ভাষ্য মতে বাবার গোপন স্ত্রীর সন্তান হওয়াও বিচিত্র কিছু না। দুর্ভাগ্যক্রমে বাবার সেই গোপন স্ত্রী একই সময়ে আমাকে জন্ম দিয়ে মারা গেলেন আর তুমি জন্ম দিলা একটি মৃত সন্তান। কাকতালীয়ভাবে তোমার আমার মাঝে একটি যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছিল নিষ্ঠুর মৃত্যু। ফুপু আমার কথা শুনে কান্না করতেছিল। আমি ফুপুরে সান্ত্বনা দিয়া বলছিলাম, তুমি তো গ্রামে থাকতা, শহরে তোমার ভাইয়ের কাজ-কারবার তো তুমি জানার কথা না। বাবাও নিজ থাইকা তোমারে কিছু বলে নাই। হয়তো তারা দুইজনেই ঠিক করে নিছিলেন যে, আর যাই হোক আমার জন্ম রহস্য চিরকাল গোপন রাখবেন। ফুপুর চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তেছিল। তিনি আমার হাত থেকে সিগারেট নিতে নিতে বলছিলেন, আরে ডাকাইত, এই কথা তুই পাইলি কই?
তুমি নিজের চোখেও দেখেছ যে, আছু ফুপু আমার কাছ থেকে সিগারেট নিয়া খাইতেন। কখনো আমার জ্বলন্ত সিগারেটের অর্ধেকটাও নিয়া নিতেন। সত্যিকার জন্মদাতার ঘ্রাণ পাইতাম বাবার শরীর থেকে। কিন্তু আমি যত মৃত্যুর দরজার দিকে আগাইতে থাকলাম, অর্থাৎ আমার বয়স বাড়তে থাকলো, মায়ের গন্ধ নামের সেই স্বর্গীয় সুবাস বিস্মৃত হইতে থাকলাম। তোমার চেহারা থেকে মায়ের সেই স্বর্গীয় আভা দিন দিন হারাইয়া যাইতে থাকলো। কেমন কঠিন কঠিন হইয়া উঠতে থাকলো তোমার মুখ। দৃষ্টি। তোমার কন্যা রত্নটি যখন স্বামী বিসর্জন দিয়া বাপের ভিটায় আশ্রয় গ্রহণ করলো, তার কয়দিন পর থেকেই আমার ভিতরে সেই বিশ্বাস পোক্ত হইয়া উঠতে থাকলো যে, তুমি আমারে পেটে ধরো নাই।
আইন মোতাবেক কন্যারাও বাপের সম্পদের অধিকারী। কিন্তু সেই অধিকারে সে যখন বাপের ভিটায় আশ্রয় নেয় তখন তার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক একটা পাপের বীজও রোপণ করা হয়। যে বৃক্ষের বিষাক্ত ছায়ায় শান্তি নামের প্রশান্তির ছায়াটিও এক সময় হারাইয়া যায়। সেইটা তোমার চোখে পড়ে নাই। আর তাই খুব সহজেই আমাকে বঞ্চিত করতে পারলা পিতার আশ্রয় থেকে। যেহেতু আমাকে পেটে ধর নাই, তাই আমার পরাজয় তোমার গর্ভজাতদের জন্যে বিজয় মুকুটের সমান ভেবে নিশ্চুপ থাকলা। তবে এই কথাও হয়তো তোমার অজানা নাই যে, রোম শহরও একদিন আগুনে ছাই হইছিল। বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারকেও শূন্য হাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হইছিল। তুমি আমি সবাই একদিন বিদায় নিতে হবে। কিন্তু সেই বিদায় মুহূর্তটা যেন অনুতাপের না হয়। বিবেক দংশনের যাতনা না হয়।
অথচ এক সময় তুমিই বলছিলা যে, তোমার মৃত্যুর পর আমি যেন তোমার জানাযা পড়াই। কিন্তু হায়, প্রকৃতি যেমন তার ভাষা আর রঙ বদলায়, কিছুদিন পর তোমার ভাষাও বদল হইল। সুর পালটাইলা। বললা, আমি তোমারে মাটি না দিলেও চলবে। সুজা আছে। সুজা তোমারে মাটি দিবে। বেশ ভালো কথা। সুজা তোমার পেটের সন্তানের সন্তান। তার মাঝে তোমার পেটের ছেলে দর্শন কর।
আসলে সত্যি কখনো কি কেউ চেপে রাখতে পারছে? পারে নাই। তুমিও পারলা না। কথায় আছে না, পেটের সন্তান আর পিঠের সন্তান কখনো এক হইতে পারে না। সতিনের ছেলেকে আপন ভাবতে পারে এমন মায়ের সংখ্যা পৃথিবীতে হাতে গোনা। কাজেই তুমি যে সেই মায়েদের মত মহৎ হইতে পার নাই, তা তোমার আচরণই আমার কাছে স্পষ্ট করে দিছে। যেমন আমি কখনোই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারতাম না যে, তোমার অন্যান্য সন্তান আমার সহোদর। তাদের আচরণ সেই শৈশব থেকেই আমার কাছে তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছিল। সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলী আমার সেই বিশ্বাসটাকে আরো মজবুত করে দিয়ে গেল। আর তাই হয়তো অতীতে তোমার দুই সন্তানের মৃত্যু দেখলেও আমার চোখে কখনো পানি আসে নাই। দীর্ঘদিনের অদর্শনে আমার কথিত ভাই বোনগুলার জন্য কখনো মন খারাপ হয় না। এমন কি তাদের অসুখ বিসুখের ব্যাপারে আমার কখনো কোনো বোধ ছিল না। এখনও নাই।
একটা সময় ছিল, যখন দূরদেশে যাইতাম তোমার পায়ে চুমু খাইতাম। ফিরা আইসাও কদমবুসি করতাম। সেই ছেলেটা কেমনে তোমার বিমাতা সুলভ আচরণে দিন দিন তোমার কোলছাড়া হইয়া উঠলো তাও খেয়াল কর নাই। আসলে তোমার মাতৃত্বের অহংকার আরেক মাতৃহীন সন্তানকে বুঝতে পারে নাই। আদর স্নেহের বদলে আসলে করুণাই করতা। একটা বিলাইর বাচ্চা পুষলেও সেটার জন্য মায়া জন্মায়। অনেক গেরস্ত তার পোষা প্রাণী কোরবানি দিতে যাইয়া অঝোর নয়নে কান্নার কাহিনীও আমাদের দেশে কম নাই। শিশু কাল থাইকা আমারে আদর যত্ন দিয়া বড় করছিলা তা কখনো মন থাইকা কর নাই। তা ছিল মাতৃত্বের অভ্যাসের ফল। প্রতিটা মায়ের মনেই শিশুদের জন্য একটা কোমল জায়গা থাইকা যায়। তোমার মনেও ছিল। তাই বেশ কিছুকাল তা পাইছিলাম। যেমন, নিজের কোরবানির পশুর জন্য গেরস্থের থাকে, তেমন মায়া।
কিন্তু যেই পাপের বীজ তুমি রোপণ করে গেলা, সেই বৃক্ষের ছায়ায় তোমার বাকি সন্তানদের জীবনের ভারসাম্যও বিলুপ্ত হবে খুব শীঘ্রই। হয়তো সব ঘটনা তোমার চোখের সামনেই ঘটবে। তোমার আমলনামা তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাইবা। তখনও আমি তোমার সামনে থাকবো না। এই যে চলতশক্তিহীন অবস্থায় তুমি কন্যার আশ্রয়ে আছ, আমি তোমার সামনে আসি নাই। তোমার যে পায়ে আমি চুমু খাইতাম, সেই পায়ের ওপর ভর কইরাই তুমি আমারে লাঠি দেখাইছিলা, যেই মুখে আমারে আশীর্বাদ করছিলা, সেই মুখেই আমার জন্মদাতার গাছের দিকে দৃষ্টি দিতে নিষেধ করলা। সেই গাছের ছায়ায় কি তুমি সুখে আছ? ভাল আছ? একবার কি বুকে হাত দিয়া এই সত্যিটা উচ্চারণ করতে পারবা?
আমি জানি যেমন, তুমিও জানো যে, অনেক দেরি হইয়া গেছে। সূতার শেষাংশটা তোমার হাত ছাড়া হইয়া গেছে অনেক আগেই। পাপের ছায়া থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততটাই মঙ্গল। কিন্তু তুমি পাপের ছায়াটাকেই তোমার শেষ ছাউনি বানাইলা। হইলা পাপগ্রস্ত। কিন্তু কতদিন সেই বিষাক্ত ছায়ায় বাস করতে পারবা সেইটা তোমার ভবিতব্যই জানে। অথচ এই সন্তানেরাই তোমার স্বামীর মৃত্যু শয্যায় কেউ ছিল না। তার রোগশয্যায় কেউ উঁকিও মারে নাই যাতে বেচারা সুচিকিৎসা পায়। এমন কি কবরস্থ করবার সময়টুকুও তাদের হয় নাই। এখন তারা তোমাকে ঘিরে আছে বলে ভেবো না যে, তোমার এখন সুসময়। তোমার আড়ালে আড়ালে অনেক রাস্নার শিকড় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। সত্যিকারের রাস্নায় কাঁটা হয় কিনা আমার জানা নাই। কিন্তু এই রাস্নার কাঁটায় সৃষ্ট তোমার দেহ-মনের ক্ষতগুলো কারো চোখে পড়ছে না। আর পড়বেও না। সময় মতো তুমিও তা প্রকাশ করতে পারবা না। এক নির্বাক জীবনে তুমি দগ্ধ হচ্ছ প্রতিদিন যা কেবল আমিই দেখতে পাই। কিন্তু আমি যে বলবো সে পথও তুমি রাখ নাই। তিনদিক থেকে আমাকে বেড়া দিয়ে রেখেছ। যা তুমি নিজে না দিলেও কোনো প্রতিবাদ কর নাই। যার অর্থ নীরব সম্মতি তোমারও ছিল। এই যে বঞ্চনা, তা যেন ঈশ্বর তোমার বাকি সন্তানদের জন্যও খানিকটা তোলা রাখেন। তাদের বঞ্চনা কেউ দেখবে না। কিন্তু তারা সেইটা প্রকাশও করতে পারবে না।
আমার এই ছোট্ট জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি, কেবল স্বার্থ উদ্ধারের আশায় যারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে তাদের সংগে আমার সম্পর্ক বেশিদিন ভালো থাকে না। অনেক মুরুব্বির মুখে শুনেছি যে, কারবালা যতবার আক্রান্ত হয় ইসলাম ততটা শক্তিশালী হয়। তেমনই আমি যতবার আক্রান্ত হই মাটির ওপর আমার পায়ের ছাপ ততটা গাঢ় হয়। কৈকেয়ী রাজমাতা হইতে পারলেও সেই সুখ তার মনে ছিল না। তুমি কতটা সুখী হইলা তা তুমি আর তোমার ঈশ্বরই জানেন।
এখন তুমি নিজের পায়ে ভর কইরা আর আমারে শাসাইতে আসতে পারবা না। তোমার কঠিন দৃষ্টির আগুনে আমারে আর পোড়াইতে পারবা না। ঈশ্বর তোমার আমার মাঝে নিজেই বেড়া দিয়া দিলেন, তা তোমার পোলাদের তৈরি ইটের কঠিন দেওয়ালের চাইতেও আরো কঠিন। যা তুমি, আমি, কেউ ইচ্ছা করলেই ভাইঙা ফেলতে পারবো না। হয়তো এইটাই আরো ভালো হইল, তোমার পেটের সন্তানদের ভিড়ে নির্বাক নিশ্চল হয়ে আরো অযুত নিযুত দিন কাটিয়ে দিতে পারবে। তোমার স্বামীর স্বত্বে অন্তত তোমার পিঠের সন্তানটি পুরোপুরি ভাগ না বসাইলো, সেইটাই তোমার বাকি জীবনের সান্ত্বনা হইয়া থাকুক।
১৪/৮/২০১৭খ্রিস্টাব্দ
গৌরীপুর, কুমিল্লা।
(খসড়া)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:৪০