(ছবি- গুগুল মিয়া)
এবার কার্তিক মাসের সকালগুলো বেশ বিরক্তিকর আর সেই সঙ্গে আনন্দের বলেও মনে হচ্ছিল সবুরের কাছে। যেদিন তার মায়ের মুখে শুনতে পেয়েছিল কথাটা, সেদিন থেকেই কেমন যেন একটি বাড়তি আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল রহিমাকে নিয়ে। যদিও তার মনের ভেতর একটি ভাবনা আছে যে, তার ভাবী স্ত্রী দেখতে কেমন হবে। নিজে নিজেই নানা পছন্দ আর গুণের সমৃদ্ধি ঘটিয়ে এঁকে নিয়েছে একটি ছবি। তার মনের দেয়ালে বাঁধানো ছবিটির সঙ্গে কারো মিল হয়ে গেলেই সে বিয়েতে মত দেবে তার আগে নয়। কিন্তু রহিমাকে বাড়ির বাইরে খুব একটা দেখা যেতো না। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে ফিরে আসবার পর থেকেই গ্রামের লোকজনের মুখে ধ্বনিত হওয়া নানা অলক্ষুণে বাক্যাবলীতে যার পর নাই আহত হয়ে জড়িয়ে পড়তো নানা রকম বিতর্কে। তারপর আস্তে আস্তে কেমন যেন গুটিয়ে গেল মেয়েটা। বিতর্ক এড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দিনদিন ঘরকুনো হয়ে উঠেছিল যেন। বাইরে দু-চার ছ দিনের মাথায়ও একবার দেখা যেতো না তাকে। তারপর একসময় আর দেখাই যায় না। নিজে ব্যস্ত থাকে বলে, তার ওপর রহিমার ভাই শফিউদ্দিনকে মোটেও পছন্দ করে না বলে, সে বাড়ির ত্রই-সীমানায় যেতেও তার ইচ্ছে করতো না। কিন্তু মনের ভেতর কেমন একটা অদৃশ্য টানও অনুভব করছিল রহিমার প্রতি।
সকালের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা জাতের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে হামলে পড়ে ধান ক্ষেতে। ধানগুলো সব পুরোপুরি না পাকলেও এরই মাঝে সোনালী হয়ে উঠেছে মাঠের অনেকটাই। কুয়াশা ভেজা ক্ষেতের আলপথ ধরে হেঁটে আসতে আসতে দুটো পায়ের গোড়ালি অবধি ভিজে যায় সবুরের। এ সময় বেশ খানিকটা শীত শীত বোধ হয় বলে, পরনের লুঙ্গীটার গিঁঠ খুলে গায়ে জড়িয়ে রাখে। সে সময় হালকা পাতলা বাতাসে লুঙ্গীর নিচের অংশ দোল খাওয়ার ফাঁকে খানিকটা শীতল বাতাস দেহের নিম্নাংশে হালকা সুড়সুড়ির মতো ঠাণ্ডা পরশ দিয়ে যায়।
পুরো মাঠ জুড়েই নানা জাতের ধান অনুসন্ধানী পাখির ওড়াউড়ি চোখে পড়ে। ঘুঘু, কবুতর, চড়ুই, বাবুই আর টিয়া। এমন কি দাঁড়কাক, পাতিকাকও আছে কোনো ক্ষেতের আশপাশে বা কাকতাড়ুয়ার গায়ে, মাথায়। হঠাৎ এক ঝাঁক টিয়া টিটি শব্দে উড়ে এলে ক্ষেতে নামবার আগেই হাতের দীর্ঘ লাঠিটা উঁচিয়ে ছুটে যায় সবুর। ক্ষেতের ওপর আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি টানানো সরু দড়িতে ঝাঁকি দিয়ে ঝোলানো টিনের ঘণ্টা ঘটর ঘটর শব্দে বাজাতে আরম্ভ করলে উড়ন্ত টিয়ার ঝাঁক দিক বদলায়। মাঝের কয়েকটা ক্ষেত ছাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত কম অরক্ষিত ক্ষেতে নেমে পড়ে পুরোটা দল। আস্তে ধীরে আরো পাহারাদার এসে জমতে থাকবে সূর্যের আলো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। সেই সঙ্গে পাখিদের উৎপাতও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। ছড়া বা থোড় এলে ধানগাছগুলো অন্তঃসত্ত্বা নারীর মতো দুর্বল হয়ে পড়ে যেন। বাড়তি ভার সামলাতে না পেরে একটু জোর হাওয়া বয়ে গেলে বা ধানের ছড়ার ওপর চড়ুই বা বাবুই পাখির চেয়ে কিঞ্চিৎ বড় আকৃতির পাখি বসলেও শুয়ে পড়ে। সেই ধানগাছের উত্থান ঘটে না আর। তার ওপর পাখিরা এসে হামলে পড়ে খুঁটে খুঁটে ধান খেতে আরম্ভ করে। কোনো কোনো পাখি, বিশেষ করে টিয়া, কবুতর আর ঘুঘুর পেটে আস্ত একটি ছড়াই এঁটে যায়।
এই একটিমাত্র ক্ষেতের ফসল ভালো হয় বলে তার ওপর এ জমির ফসল দিয়েই তাদের বছরের ভাতের জোগান হয়ে যায় বলে তার বাবা রহম আলি এখানেই শ্রম দিতে বলে বেশি। বাড়ির লাগোয়া সাতান্ন শতাংশের জমিটাতে ধইঞ্চা ছাড়া তেমন কোনো ফসল ভালো হয় না বলে গফুর মৃধা অনেকদিন ধরেই বলছে তার কাছে বেচে দিতে। কিন্তু রহম আলি গফুর মৃধার কথায় তেমন একটা গা করে না তা বুঝতে পারে সবুর।
পাশের শফিউদ্দিনের ক্ষেতে এক ঝাঁক জালালি কবুতর উড়ে এসে বসে। কম করে হলেও পঞ্চাশ থেকে ষাটটি হবে। এলাকায় কারো জালালি কবুতর নেই। তা ছাড়া জালালি কবুতর কেউ পোষে বলেও শোনা যায় না। অথচ ধান পাকার সময় হলে কোথা থেকে ওরা উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অনুমান করে বলাও শক্ত। বছর কয়েক আগে তার বাবা মারা যাওয়াতে দু ভাই বোন সম্পদের মালিক হয়ে গেছে অল্প বয়সেই। সম্প্রতি তার বোন রহিমা বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে। শোনা যায় স্বামীর কোনো ভাই বোন না থাকাতে শরীকরা যাতে পুরোটা সম্পদ হাতিয়ে নিতে পারে সে উদ্দেশ্যেই নানা রকম ভয় ভীতি দেখিয়ে বাড়ি ছাড়া করেছে তাকে।
কবুতরগুলো খুব দ্রুত খুঁটে খুঁটে ধান খাচ্ছিল দেখে ভাল লাগছিল না সবুরের। একবার বর্ষার দিনে জমির আইল কেটে পানি ছাড়া নিয়ে বেশ ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল দুজনের মাঝে। সে সময় তাকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দিয়েছিল বলে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে সে। আর সে সূত্র ধরেই রহিমার সঙ্গে সহজ হতে পারেনি কখনো। শফিউদ্দিনের ক্ষেতের সব ধান পাখিদের পেটে চলে গেলে সবুরের খুশি হবার কথা থাকলেও সে খুশি হতে পারে না। অন্যের ক্ষতি দেখবার মতো নিচু মানসিকতার পরিচয় দিতে পারে না বলেই হয়তো হাতের দীর্ঘ লাঠিটা বাগিয়ে ধরে হুসহাস শব্দে তাড়িয়ে দেয় কবুতরের ঝাঁক। বাতাসে বিচিত্র ধরনের পতপত শব্দে তারা উড়ে যেতে থাকে দূরে কোথাও।
ঠিক তখনই পেছন থেকে কুয়াশা স্নিগ্ধ নারী কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, তুই না দেখলে তো সব ধান কইতরের পেটেই যাইত!
সবুর ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে রহিমাকে। মাথায় ঘোমটা টানা, পুরো দেহে শাড়ি জড়ানো। কেমন মুরুব্বী মুরুব্বী ভাব ফুটে উঠেছে। কাছাকাছি হতেই রিনিঝিনি বেজে উঠে রহিমা বলল, আইতে দিরং অইয়া গেল! শফি বাজারে গেছে সুতলির লাইগা। বলতে বলতে সে হাতের কালো রঙের ছোট আকৃতির ফোনটা দু আঙুলের ডগায় ধরে ঘুরাতে থাকে।
গ্রামের অনেকের হাতেই আজকাল ফোন দেখা যায়। নানা রঙের, নানা আকৃতির। কিন্তু সবুরের কেন যেন মোটেও আগ্রহ বা কৌতূহল হয় না যন্ত্রটির প্রতি। এমন কি প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে না কখনো।
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরই রহিমার হাতের ফোন বেজে ওঠে কয়েকবার। ফোনটা কানে লাগিয়ে নিচু স্বরে কথা বলে সে। কার সঙ্গে তার কী কথা হয় কিছুই বুঝতে পারে না সবুর। ক্ষেতের ওপর একঝাঁক চড়ুই ওড়াউড়ি করতে থাকলে দড়ি টানাটানি করে টিনের ঘণ্টা বাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবুর। এরই মাঝে শফিউদ্দিনের ক্ষেতটা চারপাশে একবার ঘুরে এসে পাশে দাঁড়িয়ে রহিমা বলল, তুই কতক্ষণে আইলি?
রহিমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তার। তবু সংক্ষেপে জানায়, সুরুজ উডনের সময়।
-এত বিয়ান বিয়ান পইখ-পাখরা আইয়ে?
-আইয়ে না আবার!
বলে, সে ফিরে তাকায় রহিমার দিকে। আগের চেয়ে তাকে দেখতে ভালোই লাগছে অনেকটা। বিয়ের সময় তার শরীর ছিল ছিপছিপে হালকা-পাতলা। কিন্তু এখন বেশ খানিকটা ভার-ভারতি। আগের মতো বুকের দিকটাও প্রায় সমান নয়। তা ছাড়া তার বুকের স্ফীতিই যেন সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলেছে অনেকটা।
এমন সময় আরো একঝাঁক টিয়া টিটি করে এসে নেমে পড়েছে তাদের ক্ষেতে। নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে বলতে দ্রুত ধান খুঁটে খেতে থাকে। আর তা দেখেই হয়তো রহিমা হাতের লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে ছুটে যায় নিজেদের ক্ষেতের দিকে। সে সময় বিপরীত দিকের বাতাসের ছোঁয়ায় তার ঘোমটা লুটিয়ে পড়ে পিঠের ওপর। ঢিলে হয়ে খুলে যায় চুলের বাঁধন। বুকের স্ফীতি কাঁপে ছলাত ছলাত।
সবুরের চোখে লোভ না মুগ্ধতা তা নিয়ে হয়তো সে নিজেই মাথা ঘামায় না। ছুটন্ত নারী দেহের নানা প্রান্তে বিচিত্র কম্পন তাকে যেন রুদ্ধ বাক করে দেয়। ওদিকে রহিমার তাড়া খাওয়া টিয়ার ঝাঁক উড়ে আসে তার নিজের ক্ষেতে সেদিকে চোখ পড়ে না তার।
নিজের ক্ষেতের আপদ দূর করে ঘাড় ফেরায় রহিমা। হয়তো সবুরের অস্বাভাবিক দৃষ্টি তার চোখে পড়ে। আর তাই হয়তো আঁচল টেনেটুনে শরীর ঢেকে বলে, তর ক্ষেতের টিয়া দেখ!
প্রকৃতিস্থ হয়ে হাতের লাঠি নাচিয়ে দড়ি ধরে টানাটানি করে সবুর। টিয়ার ঝাঁক উড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসে।
অবস্থা দেখে রহিমা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসে। কিন্তু সে হাসির কারণ অনুধাবন করতে না পেরে সবুর বলে, হাসনের মতন কী করলাম?
-তর চোখ দুইডা কেমন ব্যাডা ব্যাডা লাগতাছিল!
বলে, ফের ফিক ফিক করে হাসে রহিমা। তারপরই হঠাৎ খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলে, বিয়া করবি কবে?
বিয়ের কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করলেও রহিমার কথায় কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না সবুর। এমন কি এ প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে হয় না তার। কিছুক্ষণ আগে দৃশ্যমান রহিমার ছুটন্ত দেহের ছলকানি যেন তখনও মোহগ্রস্ত করে রেখেছে তাকে।
সবুরের নীরবতা নিয়ে মাথা ঘামায় না রহিমা। বলে, শফিউদ্দিনরে বিয়া করামু। মাইয়া দেখতাছি। তুই কইলে তর লাইগাও দেখমু।
হঠাৎ সবুরের কী হয়, মুখ ফসকে বলে ফেলে, দেখতে হইবো না। মনে মনে ঠিক কইরা রাখছি।
রহিমার আগ্রহ বেড়ে যায় যেন। দু পা সামনে এগিয়ে এসে বলে, কারে? কার মাইয়া? দেখতে কেরুম?
-দেখতে তর মতন।
কিন্তু তার মতো দেখতে এমন মেয়েটা কে? মনে মনে অনুসন্ধান করলেও সে ধরতে পারে না। অন্তত তাদের সিদ্ধেশ্বরীতে এমন কোনো মেয়ে নেই এমনটা ভেবেচিন্তে সে নিশ্চিত হয়েই বলে, কোন গ্যারাম?
-তর জামাইর দ্যাশে।
-কথা অইছে?
-হ।
-তর লাইগা রাজি অইব? কী নাম?
রহিমাকে জবাবটা না দিতেই হয়তো সে ক্ষেতের দড়ি ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করে। পাহারা দিতে অন্যান্য ক্ষেতের লোকজনের এগিয়ে আসা দেখতে দেখতে বলে, আইচ্ছা, মাইয়ার বয়েস যদি আমার থাইক্যা দুই এক বছর বেশি অয়, বিয়া দিবো তো?
-বয়সে কী আইবো যাইবো? কত বেডি নিজের থাইক্যা কম বয়সের পোলাগো কাছে বিয়া বয় না!
-তাও মিছা না। রজব আলির মাইয়া তসলিমা নিজের পোলার বয়সের এক ব্যাডার কথা কইছে বইলা হুনছি।
-বিয়ার বয়স কিছু না। ব্যাডাগো ক্ষ্যামতাডাই আসল।
বলেই, কেমন করে হেসে ওঠে রহিমা। তার হাসির মাঝে খানিকটা লজ্জাও মিশে আছে বলে মনে হয় সবুরের। তবে কথাটা বেশ পছন্দ হয় তার। ক্ষ্যামতা। পুরুষের ক্ষ্যমতা হইল আসল। এ সামান্য কথা কটির মাঝেই যেন লুকিয়ে আছে একজন পুরুষের যাবতীয়।
এমনিতে রহিমা মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। কপাল দোষে অল্প বয়সে বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে। তবে, তার মায়ের খুব পছন্দ রহিমাকে। সেদিন কোনো এক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তার মা বলে উঠেছিল, শফির বইন রহিমা মাইয়াডাও খারাপ না। সংসারী। মাইয়া রাজি অইলে তরে বিয়া করাইতাম।
তখন ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি সবুর। মাকে সরাসরি মানা করে দিলেও এখন বেশ বুঝতে পারছে যে, মনেমনে ঠিক করে রাখা মেয়েটি হুবহু রহিমার মতো। কিছুক্ষণ আগে ঘোমটা সরে গিয়ে মাথার চুলগুলো যখন পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল, তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, তার মনের মানুষটি আসলে রহিমাই। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে যে, কখন আর কবেই বা তার মনের ভেতর ঠাঁই করে নিয়েছিল মেয়েটা, সে দিনক্ষণের হদিস তার জানা নেই।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:৫১