কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে পত্র-পত্রিকা, ব্লগ আর ফেসবুকে নানামুখি কথাবার্তা জেনে আসছি। কিন্তু কোনটা যে সঠিক আর কোনটা যে ভুল তা নিয়ে ক্রমেই সন্দিহান হয়ে উঠছি। আমি বলি, কোটা সংস্কারের নাম তো কোটা বাতিল নয়। যেখানে ১০% তা হয়তো বাড়ানো কমানো যেতে পারে বা ৬%কে আরো বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সংস্কার বলতে তো এমনটাই হয় নাকি?
সংস্কার আর বাতিল যে এক কথা নয় তা বুঝতে হয়তো সবাইকে এম-এ পাশ পণ্ডিত হতে হবে না। তারপরও এ আন্দোলনকে দমানোর ক্ষেত্রে সরকার এবং তাদের পেটোয়া বাহিনী কেন অতটা উঠে পড়ে লেগেছে তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কিছুতেই আসে না।
আন্দোলনকারীদের ঢালাওভাবে রাজাকার সম্বোধনটার পেছনেও কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। কী অপরাধ তাদের? কোটা সংস্কার করতে বলছে তারা, এই তো? কিন্তু কেন সংস্কারের কথা আসছে সরকার মন দিয়ে সেটা শুনতে পারতেন। তারপরও যখন সংসদে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটা প্রথা তুলে দিতে বলেছিলেন সেটা নিয়েও কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি এ নিয়ে আলাপের জন্য বা সরকারী পদক্ষেপের একটি হালকা সম্ভাবনা দেখা গেলেও তা যে কোন বছর চূড়ান্ত হবে সেটা নিয়েই সংশয় দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, বড়দের ভাবনা জটিল বলেই সেদিকে আমি যাবো না।
কেন সরকারী পেটোয়া বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে অমানবিক অত্যাচার করে যাচ্ছে বা পুলিশ কেন সেসব দেখেও দেখছে না বা ছাত্রলীগের কী অধিকার আছে হাতুড়ি দিয়ে আন্দোলনকারীদের পা ভেঙে দেবার মতো নির্মমতার? আপাতত এ ক’টি জিজ্ঞাসাই।
আরও খানিকটা পরিষ্কার করে বলতে চাই যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে কাদের এত গাত্রদাহ? আমার পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন, তাই বলে কি আমার জমিদারীও এখন বলবত থাকবে? আর তা বলবত থাকতে হলে তো আমাকেও সে পর্যায়ের থাকতে হবে নাকি? কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলন বলতে চাচ্ছেন, তাতে তাদের কী এমন স্বার্থ লুকিয়ে আছে যা আমরা কেউ জানি না? এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালান। কোনো এক মুক্তিযোদ্ধা মুচির কাজ করেন। কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করেও জীবন নির্বাহ করেন। তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কারা লাভের গুড় ঘরে তুললেন? এমন তো না যে দেশের সব মুক্তিযোদ্ধা ৬% কোটার সুবিধা পেয়ে গেছেন? তাহলে কেন এ আন্দোলনকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা-বিরোধী আন্দোলন বলে নস্যাৎ করতে চাচ্ছেন? তারা কারা, যারা কোটা প্রথার অন্যান্য দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন না?
যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলন বলে প্রচার চালাচ্ছেন, তারা কি জানেন না আমাদের দেশে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে_ যারা সরকারী সব চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সুবিধাগুলো চেটে-পুটে ভোগ করে চলেছে? আমি তো মনে করি কোটা বিরোধী আন্দোলনে ভয় পাচ্ছে সেই সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, যারা ‘৭১এ ছিল রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় মিছিলে অস্ত্র হাতে শরীক হয়ে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম তুলে ফেলেছে। ঠিক এমনই একটা দৃশ্যে কোনো একটি বাংলা সিনেমায় প্রয়াত হুমায়ুন ফরিদী অভিনয় করেছিলেন।
এমন কি একাত্তরে যাদের যুদ্ধের বয়স ছিল না, তেমন মানুষও মুক্তিযোদ্ধা সনদ কিনে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিচ্ছে। আমার ধারণা তেমন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের সন্তানদেরই গাত্রদাহের কারণ এই কোটা সংস্কার আন্দোলন। এ নিয়ে পাঠক আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা আমার জানা নেই। তবে এ আন্দোলনে সবারই শরীক হওয়া জরুরি। কারণ ‘সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ বয়স-সীমা ৩৫বছর’ প্রজ্ঞাপনটি অনেক আগেই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চয় ৬০/৬৫বৎসর বয়সে সরকারী চাকরীর আশায় আবেদন করবেন না?
একটি কথা আরও শক্ত করে বলতে চাই যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে এবং আরও বেগবান করতে সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। এ আন্দোলনকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলন বলে যারা প্রচার চালাচ্ছেন, তারা যেন এর সপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরেন।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী স্বৈরাচারী সরকারও এনএসএফ কে দিয়ে ছাত্র আন্দোলন থামানোর অপচেষ্টা করেছিল বহুবার। তেমনই ছাত্রলীগের ভূমিকাও তাদের মতোই মনে হচ্ছে। কাজেই এ আন্দোলনকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধী আন্দোলন বলে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে এ আন্দোলনকে সমাজের সর্বস্তরে সহ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
আমি চাই কেবল প্রতিবন্ধী কোটা রেখে বাকি সব কোটা তুলে দেওয়া হোক। এমন কি মুক্তিযোদ্ধা কোটাও।
এই মুক্তিযোদ্ধা কোটার ফলে বেশিরভাগ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের বংশধর সরকারী সব সুবিধা পাচ্ছে। যারা এসব সুবিধার যোগ্য ছিল না মোটেও। যে সুবিধা পেয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদ্দেশে লাথি মারতেও তাদের লজ্জা করে না। আর অন্য দিকে নিদারুণভাবে অবহেলিত হচ্ছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। যারা মুক্তিযোদ্ধা সনদের কাঙাল ছিলেন না। সুতরাং কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে যা যা করতে হয় তাই করুন। এগিয়ে আসুন সরকারী দেশপ্রেমিক আর মুক্তিযোদ্ধা পক্ষের সৎ মানুষেরা।
এই ‘সরকারী চাকরি ক্ষেত্রে কোটা-সংস্কার আন্দোলন’কে ছড়িয়ে দিন সারাদেশে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:২৮