গল্পটা সোহানের। সোহান আমার ক্লাসমেট। বাড়ি মাধুকুন্ড জলপ্রভাতের পাশে- কাঠালতলী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সবুজ পাহাড়ি ছোট্ট একটি গ্রামে। তখন আমরা মাত্র মাধ্যমিক শেষ করেছি। আমাদের এলাকার সোহানের মামার বাড়ি। স্কুল লাইফ মামার বাড়িতেই পার করেছে সোহান। আপাতত সোহানের মামা মুতব্বির আলীকে নিয়ে প্যাঁচাল করে গল্পের পরিধি না বাড়িয়ে সরাসরি মেইন থিমে চলে যাচ্ছি।
সোহান দুই ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। ফ্যামিলির ছোট সদস্য একটু এক্সট্রা ভালোবাসা, স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। সোহানও সেটা পেয়েছে। বাড়ির সবাই নিজেদের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও সে অবসর। মন চাইলে মাঝেমধ্যে বিকেলে বাবা-ভাইয়ের ব্যবসার হিসেব নিকেশের কাজে সহায়তা করে। সোহানের বাবা নূর ইসলাম পাথারিয়া পাহাড়ের বেশ কয়েকটা পানপুঞ্জির মালিক। সাপ্তাহবারে (বৃহস্পতিবার) স্থানীয় খাসিয়া দিনমজুরদের নিয়ে পানপাতা সংগ্রহ করে পরদিন ভোরে বাজারে পাইকারি দরে বিক্রি করাই উনার একমাত্র বিজনেস।
১.
কোনোএক শরতের সকালে সোহান একাগ্রচিত্তে মাধবকুণ্ডের চূঁড়ায় বসে ঝর্নার অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে। সাঁ সাঁ স্বরে বিরামহীন জল গড়িয়ে পড়ছে নিচে, কয়েকজন তরুণ তরুণীর একটি দল পাশের পাকাকরা একটা স্থানে ফটোসেশন করছে। দূরে কয়েকজ ছ্যাকড়া ছেলেপিলে হাটুসমান ঠাণ্ডা জলে বল খেলছে.... এমন সময়, নিচ থেকে মেয়ে কণ্ঠে...
- এই যে... শুনছেন? এই। এই ভাই...য়া.. আ
- (সোহান সামনে পেছনে তাকিয়ে) জ্বী। আমাকে বলছেন?
- জ্বী আপনাকে'ই...
- বলুন। কি করতে পারি?
- আমি আপনার কাছে অর্থাৎ চূঁড়ায় আসতে চাই, হ্যাল্প লাগবে।
-শিওর। নেমে, ডান হাত'টা বাড়িয়ে দিল সোহান। মেয়েটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলো।
- ধন্যবাদ। আমি ইতি। বাসা মতিঝিল। কলেজ থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছি।
- আমি সোহান। বাড়ি পাশেই।
- তাই। তাহলে তো এটা আপনার এলাকা। আমাদের একটু ঘুরে দেখাবেন।
- অবশ্যই। চলুন....
এভাবেই কমন কিছু কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার প্রাথমিক পরিচয় পর্বটা শেষ হলো। মেয়েটি তার দলের সদস্যদের সাথে সোহানকে পরিচয় করিয়ে দিলো। অতঃপর, সোহান তাদের মাধবকুণ্ড, চা বাগান, খাসিয়াপুঞ্জি ঘুরেঘুরে দেখালো। মেয়েটি খুব মিষ্টি করে কথা বলে। দেখতেও বেশ সুন্দর এবং স্মার্ট। পরীর মতো। প্রথম দেখাতেই যেকেউ প্রেমে পড়ে যাবে। সোহানও প্রেমে পড়ে গেলো। এবং ইশারা ইঙ্গিতে একটাসময় প্রপোজ করে বসলো। মেয়েটি সাড়া দিলো। তারপর আরো আরো বিভিন্ন রোমান্টিসিজম আলাপসালাপ, ইশারা ইংগিত ইত্যাদির মাধ্যমে সেদিনের পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামলো।
মেয়েটিসহ মতিঝিল থেকে ভ্রমণে আসা তাদের পুরু দলের বিদায়কাল ঘনিয়ে এলো। সন্ধ্যার পূর্বে কাঠালতলী বাজারে পৌছুতে হবে। মেয়েটির দলের দায়িত্বশীল ছেলেটা বেশ অস্থির। কারণ, মাধবকুণ্ড থেকে কাঁঠালতলী বাজারের দুরত্ব প্রায় ৭ কি.মি। এখনি লেগুনা বা অটোরিকশা না পেলে সন্ধ্যার পূর্বে সেখানে পৌঁছানো পসিবল না। সোহান এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে একটা লেগুনা ঠিক করে দিলো। বিদায়বেলা মেয়েটা ব্যাগ থেকে ছোট কাগজে ফোন নাম্বারসহ একটা চিরকুট দিলো। সোহান কাজগটা বুকপকেটে রাখতে রাখতে লেগুনার প্রস্থান দেখলো। সূর্যের একরাশ লালচে আভা তখন পশ্চিমের টিলার গাছপাতা গলে গাঙ্গের জলে টলমল করছে। সাথে টলমল করছে সোহানের দুচোখ....
রাতে চিরকুট পড়ে, মন্ত্রমুগ্ধ সোহান পরের দিন বিকেল থেকে নিয়মিত ট্রাই করে যাচ্ছে ইতি নামক সেই মেয়েটিকে। কিন্তু, কল ঢুকছে না। আআজ প্রায় তিনদিন। অথচ, মেয়েটির কথানুযায়ী পরের দিন বিকেলে থেকেই মোবাইলে পাওয়ার কথা।
পরিত্যক্ত রেল লাইনের স্লিপ গুনে গুনে হাটতে হাটতে সোহানের এই সিনেমাট্যিক ঝুলে থাকা প্রেম কাহিনী শুনে আমি রীতিমতো নির্বাক। সুলতান ততোক্ষণে বললো, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা-টটনা ঘটলো না তো?! আর কারো নাম্বার রাখিস নাই? ইতির কয়েকজন সহপাঠীর সাথেও বেশ সখ্যতা হয়েছিলো। নাম্বার রাখিনি। জানালো, সোহান। দু'একজনের নাম্বার রাখলে তো এখন খবর-টবর নেওয়া যেতো। তুই আসলেই একটা আস্ত বেকুব। সুযোগে শব্দটা প্রয়োগ করে সোহানকে জ্ঞান দিতে দিতে নিজের গল্প জুড়ে দিলো সুলতান। সুলতানের এই গল্পগুলো বারবার শুনতে শুনতে আমাদের প্রায় মুখস্থ। হঠাৎ আমার মনে পড়লো, দুর্ঘটনা ঘটলে নিউজ নিশ্চয়ই পত্রিকাতে আসবে। বললাম, চলো স্টেশন মার্কেটের পাশের পত্রিকা স্টলে ঘুরে আসি। সুলতান ছেলেটা যেমন বেশি কথা বললেও ব্রিলিয়ান্ট, ইঁচড়েপাকা টাইপ। সুতরাং পত্রিকা অফিসে যাওয়ার কারণ আমাকে আর ব্যাখ্যা করতে হলো না।
তিনজন মিলে দুই তিনদিনের প্রায় সবকটা দৈনিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও 'সম্ভব্য রুটে' বড়সড় বাস দুর্ঘটনার কোনো নিউজ পেলাম না। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এলো। ডাকবাংলার অপজিটের পুরানো বিরানি হাউজ থেকে পিয়াজু,চপ, জিলাপি খেয়ে সেদিনের মতো যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।
২.
অচেনা কিংবা কয়েকঘন্টার চেনা সেই ইতি নামক মেয়েটাকে নিয়ে ইদানীং বেশ বিভোর থাকে সোহান। বেলা অবেলায় কল্পনার রাজ্যে গাঙচিলের মতো ভাসে, স্বপ্ন আঁকে.... নীলচে শাড়ির সাথে মেচিং চুড়ি আর টিপে নাকি অপরূপা লাগে মেয়েটাকে।
অথচ মেয়েটি যাওয়ার প্রায় দুমাস পেরিয়ে গেছে। দুমাসে অন্তত লক্ষবার মোবাইলে ট্রাই করেছে & কয়েকশো মেসেজ সেন্ড করেছে। সুতরাং, তার এইসব প্রেমিকগিরি ততদিনে আমাদের কাছে স্রেফ পাগলামি বা বিনোদনের খোরাক ছাড়া আর কিছুই না। পরিচিত সবাই তাকে ইচ্ছেমত খ্যাপায়, জ্বালায়, জ্ঞান দেয়... তার ফিলিং বুঝতে সবাই অক্ষম। ফলাফল সরূপ, দুতিনমাস তাকে আর কলেজ, স্টেশন মার্কেট, ডাকবাংলা কোথাও দেখা গেলো না। অনেকদিন আমি মুতব্বির মামাসহ তার আত্মীয়স্বজনদের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে ভালোমন্দ ছাড়া তেমন কোনো তথ্য পেলাম না। ফোনেও সে তেমন কিছু বলতো না। ততদিনে কলেজে সাময়িক পরিক্ষার দিনতারিখ ঠিক হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন রত দেখে কলা কিনার প্ল্যান নিয়ে একদিন মাধবের উদ্দেশ্য যাত্রা করলাম। এবং দুপুরের শুরুতে সোহানদের বাড়িতে পৌঁছলাম। সমির ভাই আমাদেরকে (সোহানের বড় ভাই) দেখে বেশ খুশি হয়ে সোহানের রুমে নিয়ে গেলেন।
কয়েকমাসে সোহান বেশ বদলে গেছে। চোখের নিচে কালি জমেছে, মাথাভর্তি উষ্কখুষ্ক চুল, ঠোট দুটো গাঁজাখোরদের মতো কালো... আমাদের দেখেও তার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সুলতানের মজা করাতে উল্টো খ্যাপে বেশ বাজে রিয়েক্ট করলো। দেখে মনে হচ্ছিলো, তার মন মেজাজ বেশ রুক্ষ...
আমরা চা নাস্তা সেরে দুঃখ,ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাধবের পথে যাত্রা শুরু করলাম। আড্ডাবাজী করে ফিরলাম বিকেলে। মনেমনে সোহানের অপেক্ষা করলেও সোহান আর আমাদের সাথে জয়েন করলো না।
৩.
প্রায় ৩-৪ মাস পর, একদিন কলেজ ক্যাম্পাসে তাড়াহুড়ো করে সোহানকে ঢুকতে দেখে দূর থেকে ফলো করলাম। কেরানীর রুমে তখন ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। সোহান টাকা পরিশোধ করে রিসিট নিয়ে বেরিয়ে আসলে, সামনে গেলাম। লজ্জানত মুখে হাসতে হাসতে ঐদিনের ব্যবহারের জন্য সরি বললো। তারপর যতক্ষণ ছিলো স্রেফ সুলতানের প্রশংসা করলো। সুলতান নাকি তার চোখ খুলে দিয়েছে, নতুন জীবন দিয়েছে, নতুন স্বপ্ন দিয়েছে। সুলতানের জন্যই আজ সে কলেজে.... ইত্যাদি, ইত্যাদি....
পরদিন সুলতানের কাছ থেকে বিস্তারিত জানলাম। সুলতান নাকি আমাদের ইয়ার ম্যাট ফাহমিকে ইতি সাজিয়ে ফোনকলে নতুন নাটক ক্রেট করেছে। তারপর, দেখা হলে শুরুতে রিয়েক্ট করলেও পরে নাটক'টা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ সোহান আর ফাহমি এখন প্রেমিক প্রেমিকা। শুনে মনটা খচখচ করে মুচড়ে উঠলো। কেননা, গোপনে গোপনে ফাহমিকে নিয়ে আমিও যে ভালোবাসার আকাশে উড়বার স্বপ্ন দেখতাম। রাতজাগা ঝিঝিদের ডাক শুনতে শুনতে ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। কবিতা লিখতাম.... ছবি আঁকতাম.....
হা... হা... থাক। স্মৃতির ডায়েরীতেই থাক ঐসব পুরানো সব কাহিনী। আপাতত মাধবকুণ্ড নিয়ে একটা চতুষ্পদী কবিতা বা সনেট পড়ে নিন। সনেট'টি কয়েকবছর পূর্বে লিখা। একবার স্থানীয় একবড় ভাইকে (কবি ও সাংবাদিক) একটা গদ্যছন্দের কবিতা দিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বললেন, ভালো হয়েছে। তবে সত্যি বললে এইসব গদ্যছন্দের কবিতাকে আমার কবিতা মনে হয় না। কবিতা হলো সনেট, অমিত্রাক্ষর..... মাত্রার হিসেব বুঝো? ব্লা... ব্লা...
তারপর এই সনেট'টি লিখা। এটাই আমার প্রথম এবং একমাত্র সনেট। কবিতা বোদ্ধাদের গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায়-
* মাধবকুণ্ড *
রূপসী! চাকা-অশ্মরী, সুশ্রী জলকুণ্ড
ঝিরঝির প্রস্রবণ ঝরে অবিরত
নিহারনে দেহমন হয় উলসিত
অপরূপা রূপে রাঙ্গা ক্ষুদ্র পরিকুণ্ড।
অত্যুত্তম দর্শনীয় মুক্ত গিরিমুণ্ড
ঝরঝর প্রস্রবণ ঝরে অবিরত
শিলাময় আবরণ বিস্তর উন্নত
প্রসাধিত জলধারা সুশ্রী জলকুণ্ড।
মাধব! জলপ্রপাত মূর্তিপরিগ্রহ
অপরূপ, অকৃত্রিম, কম্র অহরহ।
কুসুমিত শিলারূপী, যেনো মহারাণী
সাঁ-সাঁ রাগিণী রমণী, চিত্তগ্রাহী গান
চমকপ্রদ সৌষ্ঠব স্রবণ মোহিনী
নিহারনে প্রফুল্লিত হয় মনঃ প্রাণ।
________________________
সনেট- ফরাসি রীতি
পর্ব ও মাত্রাঃ ৮+৬=১৪
(Note: পরিকুণ্ড: মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের পাশে খুঁজে পাওয়া নতুন আরেক'টি ঝর্নাকুণ্ড।)
ছবি- কালেক্টেড
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:০০