মাইয়া পটানো একটা আর্ট বুঝলা!!
আমি কিছু না বুঝেই মাথা ঝাঁকালাম।
২০০৫ সাল। শরৎ কালের রাত। ঝিরিঝিরি বাতাস আসছে। মহাখালি ডিওএইচএস এ বন্ধুর বাসার ছাদে আড্ডা হচ্ছিল। অন্ধকারে ক্ষনে ক্ষনে সিগারেটের লালচে আগুন জ্বলে উঠছে। মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে আবার জ্ঞান বিতরন করা শুরু করলো পল্টু।
- যত চাপা মারতে পারবা ততোই মাইয়া পটবো।
- এহ্!
- অবশ্যই! মিথ্যা না বললে মাইয়া পটানো যায় না। তারপর মনে করো বাংলা সিনামার ক্ষ্যাত ডায়লগ খুব কনফিডেন্সের সাথে ছাইড়া দিবা, দেখবা মাইয়া পুরা পাংখা হয়া যাইব।
- যেমন?
- যেমন মনে করো, ফোনে প্রথম পরিচয়ে মাইয়া যদি তোমরে জিজ্ঞেস করে আপনি কি চান, ফোন দিসেন কেন ইত্যাদি ইত্যাদি তখন মনে করো কইলা 'আমি আপনাকে গ্রেফতার করতে চাই।'
- কি!
- হাঁ। কারন তারপর সে জিগাইব 'মানে?' তখন মনে করো কইলা, 'আমার হৃদয় চুরি করার জন্য।' এইটা শুইনা সে পুরা ফিদা হয়া যাইব তোমার উপর।
আমি হা হয়ে তাকায় থাকলাম। হালায় কয় কি!! আমরে কি ছাগল মনে করসে নাকি যা খাওয়াবে তাই খাবো! আবার পুরাপুরি অবিশ্বাসও করি কি করে! সে শার্ট, গেঞ্জি, প্যান্টের মত দুইদিন পরপর গার্লফ্রেন্ড চেঞ্জ করে।
পল্টু তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। এইরকম অন্ধকারের মধ্যেও ক্যামনে জানি মনের কথা টের পেয়ে ক্ষ্যাপা গলায় বলে উঠলো-
- কি! হা কইরা কি দেখ? তোমার কি মনে হয় আমি চাপা মারসি?
- আরে ছি ছি! কি যে বল না। চাপা মারসো বলসি নাকি! আসলে তোমারে দেইখা আমার জেলাস লাগে রে ভাই। কি মজায় আছ। আর আমারে দেখ! জীবনে কোন মাইয়া ফিরাও চাইল না। (দীর্ঘশ্বাস)
প্রশংসা শুনে পল্টুর মুখে হাসি ফেরত আসল। সে আনন্দিত গলায় বলে 'আরে চিন্তা কর কেন? আমি আছি না। তোমার ব্যাবস্থা করে দিমুনে।'
আমি (কিছুটা আশাবাদী) কি?
- একটা মেয়ের সাথে প্রেম করতেসি। নাম শ্রাবন্তী। ওর ছোট বোন আছে, নাম নায়লা। তোমার সাথে সিস্টেম করায় দিবানে।
- কেমনে?
- আমার কাছে নাম্বার আছে। তোমারে দিতেসি কিন্তু ভুলেও আমার নাম কইতে পারবানা। কইলে কিন্তু মার্ডার সিন!
- (উদাস হয়ে গেলাম। চোখ ছলছল) কি যে কও। মেয়েদের সাথে কিভাবে কথা বলে জানলে আইজকা আমার এই অবস্থা হইত?
- (উদার আশ্বাস পল্টুর গলায়) আরে কোন অসুবিধা নাই। স্টার্টিং আমি করায় দিব। ম্যাসেজ চালাচালি দিয়া শুরু করবা। আমি তোমার হয়ে ম্যাসেজ দিয়া দিব। ঠিকাসে?
- ওক্কে।
ঘরে ফেরত আসলাম। পল্টু আকাশ পাতাল চিন্তাভাবনা করে নায়লাকে একটা ম্যাসেজ দিল যেটা বাংলায় অনেকটা এরকম –
'নায়লা! আশা করি ভাল আছ। আমি একজন খুবই সাধারন মানুষ। (নি:সঙ্গ লিখসিলো, বাদ দিতে বললাম কারন শুনতে বুড়া বুড়া লাগে।) তোমাকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি শুধু তোমার বন্ধু হতে চাই যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে। বন্ধু হিসেবে যদি আমাকে গ্রহণ কর তবে কৃতজ্ঞ থাকবো। আশা করি এত রাত্রে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বিরক্ত করছিনা। প্রতিউত্তরের প্রত্যাশায় ____'
ম্যাসেজ পড়ে মুগ্ধ হয়ে পল্টুর পিঠ চাপড়ে বললাম, ভাই! তুমি একখান জিনিয়াস! পল্টুর কিছুটা গর্ব আর তাচ্ছিল্যের জবাব, হুহ!
পাঠিয়ে দিল এসএমএস। প্রেমের তীরে তখন আমার দিল প্রায় ঘায়েল। মনে স্বপ্নের রঙধনু। প্রেমের নদীতে প্রচন্ড স্রোত। মন শুধু চায়- ভালবাসা! ভালবাসা! ভালবাসা!
পল্টু আড়চোখে আমার অবস্থা দেখছিলো। আচমকা বেরসিকের মত বলে উঠলো 'মাইয়াটা কিন্তু একটু ত্যাড়া কিসিমের।'
বিরক্তির সীমাপরিসীমা থাকলো না। মনে হলো পল্টুরে ধরে একটা থাবড়া লাগাই। হবু ভাবীরে মাইয়া ডাকতেসে এটা কি ধরনের অসভ্যতা!
- ত্যাড়া মানে কি?
- না মানে দেখতে সুন্দর তো এই একটু জিদ্দী কিসিমের আরকি!
আমি ওর কথায় খুব একটা পাত্তা দিলাম না। সে যদি জিদ্দী হয় আমি তবে জিদ্দা। হাহাহাহা!
পনের বিশ মিনিট হয়ে গেল এখনও কোন রিপ্লাই নাই। অপেক্ষার প্রহর কত দীর্ঘ হয় হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কি ভয়ানক টেনশন টাইম অথচ পল্টুর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। আমতা আমতা করে একসময় বলেই ফেললাম 'রিপ্লাই দেয় না কেন?'
- আরে দিব মিয়া! এত টেনশন কর কিল্লাইগ্যা?
- না মানে অনেক্ষন তো হয়ে গেল।
- আরে যাইতে দাও! মেয়ে পটানো ধৈর্যের খেলা। যত বেশী ধৈর্য দেখাইবা মাইয়া ততো বেশী পটবো।
আমি ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যেতে থাকলাম। আরও প্রায় আধাঘন্টা কেটে গেল। আচমকা মুঠোফোনের টুংটাং শব্দ কানে মধু বর্ষন করলো। ম্যাসেজের রিপ্লাই দিসে। আগ্রহ নিয়ে ম্যাসেজ পড়া শুরু করলাম-
'ফাক ইউ এ্যাসহোল! ডোন্ট বদার মি এগেইন!'
তব্দা লেগে গেলাম। এ কোন ধরনের ব্যবহার! এত ভদ্র ম্যাসেজের এই রিপ্লাই!! কি ভয়ানক অপমান!!
জগৎ সংসার তিতা হয়ে গেল। প্রেমের স্রোতস্বিনী নদী শুকায় একদম খটখটা। হেঁটে পার হওয়া যাবে। আমি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে পল্টুর দিকে তাকালাম।
- হু!
- হু মানে?
- (খুব ফুর্তি) জানতাম এমনই হইবে।
- ফাইজলামি কর তুমি আমার লগে?
- আরে চ্যাতো কেন? মাইয়া মানুষ এমুনই। শুরুতে চ্যাত দেখাইবো। একবার খালি পইটা গেলে হইলো। এরপর তুমি চ্যাত দেখাইবা হেয় দেখবো।
- পরেরটা পরে। এখন কি হবে?
- এখন কিছু হবে না। রাতটা পার হোক। সকালে আরেকটা ম্যাসেজ দিব। দেখবা মাইয়া বেচেইন হয়া যাইবো। সময় যাইতে দাও। ধৈর্য বুঝলা! সবই ধৈর্য! আর মুখটা এমন কালা বানায় রাখসো ক্যান? লাফ ম্যান লাফ!!
রাগ দমন করতে রিতিমত বেগ পেত হলো। অনেক চেষ্টায় কাষ্ঠ হাসি হাসলাম।
সকালবেলা নাশতা করতে করতে পল্টু আরেকটা ম্যাসেজ লিখলো-
'আমি তোমাকে এমন কোন ম্যাসেজ পাঠাইনি যে তোমার রিপ্লাই দিতে স্ল্যাং ইউজ করতে হবে। আই জাস্ট ওয়ানটেড টু বি ইয়োর ফ্রেন্ড। তোমার ইচ্ছা নাই সোজাসুজি না করে দিলেই হয়। গালি দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। যাইহোক, তোমাকে বিরক্ত করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দু:খিত। তোমার সর্বদা মঙ্গল কামনা করছি। বিদায়।'
- ইমোশনালি হিট কইরা দিসি। মাইয়া এইবার অনুশোচনায় ভুগবো। গালিও দিতে পারবোনা আবার সরি কওয়ারও রাস্তা বন্ধ কইরা দিসি। এইটারে কয় মধুর প্রতিশোধ।
এবার আর আগের মত পিঠ চাপড়ায় প্রশংসা করতে পারলাম না। মধুর প্রতিশোধ নিয়ে হবেটা কি? হারানো প্রেম কি আর ফেরত আসে? আমার কি অবস্থা কেও কি কোন খবর রাখে!
পল্টু সিগারেট ধরায় আয়েশ করে টান দিয়ে বললো 'বাথরুমে যাচ্ছি। ম্যাসেজ পাঠাইতে পারে। আমারে না জানায় রিপ্লাই দিওনা কইলাম আবার।' সিগারেট টানতে টানতে পল্টুর বাথরুমে প্রস্থান।
ঠিক দুই মিনিটের মাথায় বোমাটা ফাটলো। নো মোর ম্যাসেজ চালাচালি। মেয়ে এইবার সরাসরি ফোন দিসে। আমি উত্তেজনায় লাফ মেরে উঠলাম। এ কি মহাবিপদ! এখন কি করি!
- পল্টু! মাইয়া ফোন দিসে!
- খুক! খুক! (কাশির শব্দ)
- আরে মাইয়া ফোন দিসে। কি করমু?
- (অস্বস্তি মেশানো) খুক! খুক!
মনে হলো বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে শালারে কষে দুইটা লাথি মারি। খুকখুক দিয়ে আমি কি বুঝবো! হ্যা না কিছু বলতে পারসনা? তুই কি শালা বোবা? নিরুপায় হয়ে ফোন রিসিভ করলাম।
- (অত্যন্ত কোমল স্বরে) হ্যালো?
ধারালো কন্ঠস্বর কোমলতাকে চিরে দিলো। 'কে আপনি?'
শব্দ করে ঢোক গিললাম।
- কি চান?
গতরাতে পল্টুর শেখানো ডায়লগ ঝাড়তে চাইলাম 'আপনাকে গ্রেফতার করতে চাই' কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। আওয়াজ বের হবার সুযোগ না দিয়ে আবার প্রশ্ন-
- আমার নাম্বার কে দিসে আপনাকে?
- ইয়ে মানে..
- (ধমকের স্বরে) মিনমিন করেন কেন? খুব তো চ্যাটাং চ্যাটাং ম্যাসেজ দিতে পারেন এখন কথা বের হয় না?
এবার আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। এত খোঁচা মেরে কথা বলবে কেন? রুক্ষ স্বরে বললাম 'কি হইসে?'
- আমার নাম্বার কে দিসে আপনাকে?
- সেইটা কি তোমারে বলতে হবে?
- অবশ্যই বলতে হবে।
- কমু না!!
আমার ত্যাড়া জবাব শুনে এক মূহুর্ত থমকে গেল। এরপর ভয়ানক ক্ষ্যাপা গলায় 'আপনি নেক্সট টাইম আমাকে আর ডির্স্টার্ব করবেন না।'
- এহ! তোমারে ডিস্টার্ব করার ঠেকা পরসেনা আমার!!
- ওই! ভদ্রভাবে কথা বলো। আর তুমি তুমি করো কেন? আমি তোমার কোন ইয়ারি দোস্ত লাগি?
আমার মেজাজের সূচক তখন ভয়ানক দ্রুততার সাথে উর্দ্ধগতিতে ছুটছে। এই চেংড়ী পাইসে কি! এর অভদ্রতা বরদাশতের বাইরে চলে গেছে। নগদে পুইতা ফেলাবো। আমি দাঁতে দাঁত পিষে বললাম 'তুমি কোনহাঙ্কার রানি ভিক্টোরিয়া যে তুমারে আপনি আপনি পুছাইতে হইবো?'
- (চিৎকার দিয়ে) থাপড়ায়া চাপাটা ফাটায়া ফালামু খচ্চর কোথাকার!!
আর সহ্য করা গেল না। এনাফ ইজ এনাফ! ভদ্রতার গুল্লি মারি!!হুংকার দিয়ে উঠলাম 'একটা উষ্ঠা মারুম, হারামজাদী!!'
ব্যস্, শুরু হয়ে গেল মুষলধারে গালির বৃষ্টি। আশ্চর্য হয়ে গেলাম একটা মেয়ের মুখ দিয়ে কিভাবে এত অশ্রাব্য গালিগালাজ বের হতে পারে! বস্তির পোলাপাইন এর সামনে লজ্জা পেয়ে যাবে।
আমার আফসোসের কোন সীমাপরিসীমা থাকলো না। কি হওয়ার ছিল কি হচ্ছে। আমার কত স্বপ্ন ছিল। গভীর রাতে গুটুর গুটুর করে দুজনে ফোনে কথা বলবো। অলস দুপুর নির্জনে হাতে হাত রেখে সুখ দু:খ ভাগ করে নিব। অথবা ঝুম বৃষ্টিতে হুড তোলা রিকশায় দুজন পাশাপাশি। বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়বে তার মুখে। আমি অবাক বিষ্ময়ে দেখবো সেই মায়াভরা মুখ। হায়রে ভালবাসা!!
(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) অসহ্য আক্রোশে হেঁচকি তুলে হাহাকার মেশানো কন্ঠে হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম 'ক্ষিয়ায়াআআআআ!!!'
গায়ের জোরে সুইচ টিপে লাইন কাটলাম। সমস্ত রাগ যেয়ে পড়লো ফোনটার উপর। বোবা আক্রোশে ফোনটাকে তুলে আছাড় মারলাম বিছানায়।
পল্টু তখনও বাথরুমে!
_________________________
সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:১৭