সাউদার্ণ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি কড়া নিয়ম চায়নিজ পরীক্ষা পাস না করে মেডিকেল ইন্টার্ণশীপ করা যাবে না। মনটায় বেশি ভয় ছিল না, অল্প অল্প সাহস ছিল। কারন আল্লাহর রহমতে চায়নিজ ভাষাটা নিজে নিজে অনেকটা আয়ত্ত করেছিলাম। ৫০০ এর উপর চায়নিজ ক্যারক্টার জানি তাছাড়া আরো ক্যারক্টার জানি কিন্তু মনে রাখতে পারি না। প্রথমে মনে করেছিলাম মৌখিক পরীক্ষা কিন্তু পরে শুনলাম লিখিত পরীক্ষা। তাও আবার এইচএসকে লেভেল ৪, এটা শুনার পরে মনের মধ্যে কিছুটা ভয় ঢুকে গেল। তারপরও সাহস নিয়ে পরীক্ষা দিলাম, পরীক্ষা দেওয়ার পরে আল্লাহর রহমতে পাস করিলাম এবং মৌখিকে আশানুরূপভাবেই পাস করিলাম, যদিও আমার পাস হওয়ার মার্কটা খুব বেশি না তবে অনেকেই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার তুলনায় মোটামুটি ভালো নম্বর নিয়া পাস করিলাম। তারপর পাসের পর আমার ইচ্ছা ছিল যে গোয়াংজো আমি ইন্টার্ণশীপ করব না। যেই চিন্তা সেই কাজ, হাসপাতাল সিলেকশনের দিন ক্লাসরুমে হাতটা তুললাম ফোশান এবং শিনহুই এর জন্য। তারপর শিনহুইতে আমরা চারজন, চারজনের মধ্যে দুইজন বাংলাদেশী একজন ইন্ডিয়ান এবং একজন কুয়েতী। পরে হাসপাতালে আসার পর কুয়েতী আমার রুমমেট হয়েছিল। শুরু করিলাম ইন্টার্ণশীপ, প্রথমে আমার ডিপার্টমেন্ট পড়িল ইনফেকশাস ডিসিস ডিপার্টমেন্ট। মহা টেনশনে ছিলাম যে ডাক্তাররা আমাকে কিভাবে গ্রহণ করে, তারপর আমার চায়নিজ এর একসেন্ট ভালো করে বুঝে নাকি, কারন উনারা ত আবার গোয়াংডং এর মানুষ, উনাদের ভাষা হচ্ছে ক্যান্টনিজ। কিন্তু যাওয়ার পরে দেখলাম ডিপার্টমেন্ট এর ডিরেক্টর সুন্দর করে কথা বললেন এবং আমাকে আমার যে ডাক্তারের সাথে ইন্টার্ণ করব সেই ডাক্তারের সাথে পরিচয় করিয় দিলেন। আমি যেই ডাক্তার এর তত্তাবধানে ছিলাম তিনি একটু ইয়ং তাই উনি আমার সাথে অনেকটা বন্ধুসূলভ আচরন করতেন। এবং উনি আমাকে অনেক প্র্যাকটিক্যাল এবং ক্লিনিক্যাল জিনিস শিখিয়েছেন। আমি যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আমাদেরকে পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানালেন । অসাধারণ একটি সুন্দর পাহাড়ের পাদদেশে মোটামুটি বিশাল একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন । খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফটোসেশন শেষ করে আমার ডাক্তারের মোটরবাইকে করে ফিরতে পথে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি আমাদেরকে একটা সাহায্য করিতে পারিবে আমি বললাম স্যার বলেন আমি চেষ্টা করব। তারপর হাসপাতালে পৌঁছাবার পর তিনি হাসাপতালের একটি অডিটরিয়ামে নিয়ে গেলেন। সেখানে উনারা দেখলাম কোনো নাটকের রিহার্সাল করছেন। বুঝলাম উনাদের কোনো উৎসব আছে । হঠাৎ করে স্যার আমাকে বললেন তুমি চায়নিজ ত পড়তে পারো, আমি বললাম জ্বী স্যার আমি পড়তে পারি। তারপর আমাকে একটা কাগজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন এই লাইনটা পড়তে পারো? আমি উনাকে কিছু না বলে পড়ে শুনিয়ে দিলাম, লাইনটি ছিলো - হুশি হুশি ওয়া শিয়াং অও অর্থাৎ নার্স নার্স আমার বমি আসছে। উনি খুব খুশি হয়ে বললেন তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না শুধু এই লাইনগুলো অর্থাৎ এই ডায়ালগগুলো মনে রাখতে হবে। আমি বুঝলাম ধরা খেয়েছি, নাটক বোধহয় করতেই হবে। কিছু করার নেই, আমি ত আগে কথা দিয়েছি। জীবনে কোনোদিন নাটক করার সুযোগ হয় নাই এবং আমার কোনো ইচ্ছাও ছিল না। যাই হোক শেষমেষ সাতদিন ধরে রিহার্সাল করে নাটকটি করেছিলাম সেই হাসপাতালের সব ডাক্তার এবং নার্সরা উপস্থিত ছিলেন, এবং শিনহুই শহরের প্রধান অর্থাৎ মেয়র এবং হাসপাতালের প্রধান সবাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন। নাটকটি ভালোই হয়েছিল এবং যেহেতু কমেডিয়ান নাটক ছিল দর্শকরা সবাই উপভোগ করেছিলেন। নাটকের পর সেইরকম ফটোসেশন করলাম। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে সব ডাক্তার আমাদেরকে প্রতিটি জিনিস শেখানোর চেষ্টা করেছেন। দেখা গেছে অন্য ডাক্তার আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন কোনো বিশেষ কেস দেখানোর জন্য। এই হলো শুরুর দিকে এবং হাসপাতালের বর্ণনা।
এবার যেই শহরে আসলাম সেই শহরের কথাটা বলি। আমার দেখা খুব সুন্দর একটি শহর যা কিনা গাছগাছালি, পাহাড় এবং লেক দিয়ে সাজানো। আসলে এই জায়গাটা এক রকম টুরিস্ট স্পট। আবহাওয়াটা অনেকটাই বাংলাদেশের মত। গাছগাছালি এবং পাখি এমনকি তেলাপোকা আমাদের দেশের মত। তেলাপোকার কথাটা কেন বললাম জানেন? কারন সারা চায়নাতে আমি যত জায়গা ঘুরেছি আমি দেখেছি তেলাপোকার আকৃতি আমাদের দেশের তেলাপোকার থেকে অনেক ছোট কিন্তু মাসাল্লাহ এখানকার তেলাপোকা ঠিক আমাদের দেশের মত। আবহাওয়ার জটিলতম অবস্থা হচ্ছে প্রায় সময়ই বৃষ্টি এমনকি শীতের দিনেও বৃষ্টি। তবে শীতের দিনে এই বছর খুবই শীত পড়েছিল।
আমাদের রুমে একজন আয়ি অর্থাৎ কাজের মহিলা আসেন ঘর পরিষ্কার করার জন্য। তাকে দেখলেই সবসময় নিহাও দিই, পরিচত। একদিন কি হলো দেখলাম দোকানে সেই আয়ি আপেল কিনছে, তার দিকে তাকিয় নিহাও দিলাম, এখন সে আমাকে আপেল খাওয়ার জন্য বলল আমি মনে করলাম আচ্ছা ঠিক আছে আপেল নিই, আবার খুব ক্ষিদাও লেগেছিল। কিন্তু যখন আপেল নিতে কাছে গেলাম আমি ত আয়িকে দেখে থ, এই জন আমাদের আয়ি না, আমি চিনতে ভুল করেছিলাম কারন তাদের পোশাক অভিন্ন থাকে তাই। এখন আমি বললাম যে আমি মজা করে বলেছি আপেল আসলে খাবো না, তখন ত সে খুব জোর করে বলল না তোমাকে নিতেই হবে। তারপর আমি বললাম যে দেখ টাকাটা আমি দেই, তৎক্ষণাত তিনি ক্যান্টনিজ ভাষায় দোকানিকে কে জেন বলল, ওমা একি দোকানদার আমার থেকে ত টাকা নিবেই না, নিবে না সে ত নি্বেই না। খুব জোর করে আপেলটি ধরিয়ে দিল। তারপর আমাদের হাসপাতালের ডাক্তাররা এসে জিজ্ঞেস করছিল কি হয়েছে তারা তারা তাদের ক্যান্টনিজ ভাষায় কথা বলল। তারা বলল খাও, আমাদের এখানে তুমি মেহমান। আর কি করা খেতে বাধ্য হলাম। আরেকদিন আরেকজন বয়স্ক মহিলা আমাকে দেখে জিজ্ঞস করল তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ আমি বললাম বাংলাদেশ (মংঝালা) থেকে এসেছি। জিজ্ঞেস করল তুমি এখানে কি কর বললাম আমি এই হাসপাতালে ইন্টার্ণশীপ করি। তখন খাবারের সময় অর্থাৎ দিনের বারোটা বেজেছে তাই জিজ্ঞস করল খাবার খেয়েছ বললাম খেতে যাচ্ছি। হঠাৎ করে আঙ্গুর বাহির করে আমাকে বলল এই আঙ্গুর খাও, আমি বুঝতে পারলাম যে ঐদিনের মত কিছু একটা হতে পারে তাই বললাম যে না না আমি ত এখন খেতে যাচ্ছি। উনি ত এখন আমার হাতে পারলে ধরিয়ে দেয়, পরে বুঝলাম আজকে ছাড়বে না, তাই একটা আঙ্গুর নিলাম। উনি অনেক খুশি হলেন।
খাবারটা একটু কষ্টের ছিল কারন খাবারের জন্য মুসলিম হোটেলে যেতে হতো আর মুসলিম হোটেল অনেক দূরে ছিল। তারপরও ঔখানে গিয়ে খাবার খেতাম। তাছাড়া আমাদের জন্য হাসপাতাল থেকে প্রতি মাসে ৫০ আরএমবি করে ফুড কার্ডে দিয়ে দিত। কিন্তু প্রত্যেকদিন চায়নিজ খাবার খাওয়ার ইচ্ছা হতো না। হাসপাতালের আবার দুটো শাখা একটি হচ্ছে মুসলিম হোটেলের কাছে যখন মুসলিম হোটেলের পাশের শাখার ডিপার্টমেন্ট পড়েছিল তখন ঐ মুসলিম হোটেলে যাতায়াত বেশি হয়েছিল। মুসলিম হোটেলের যে মালিক অর্থাৎ শুশু (আংকেল) সে ত বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কথা বলত তাছাড়া আমেরিকা ভালো না, ইরান, ইরাক, ইসরায়েল এসব নিয় ত মোটামুটি কথা হতো। যাইহোক ইন্টার্ণশীপ এই মাসের জুনের দুই তারিখ শেষ হলো। আজকে সেই মুসলিম হোটেলে গিয়ে বললাম শুষু আমি ত কালকে চলে যাবো। উনার প্রশ্ন তুমি কি আর এখানে আসবে না আমি বললাম হয়তোবা না। তিনি আমাকে একটি মুসলিম টুপি দিল, আমি বললাম দরকার নেই আমার ঘরে দুইটা আছে। তারপর বলল আসো আমাদের সাথে কিছু ছবি তোলো আমি খুব খুশি হয়ে তাদের সাথে ছবি তুললাম। ছবি তোলার পরে জোর করে টুপিটি ধরিয়ে দিল এবং বলল তুমি তোমার দেশে গিয়ে বলো যে এক মুসলমান চাচা তোমাকে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম টুপিটি চায়নার কোন জায়গার, উত্তরে বললেন এটা শিনজিহানের টুপি। কি আর করব টুপিটি পড়ে নিলাম। টুপিটি পড়ে নেওয়ার সাথে সাথে তারা ত বিশাল খুশি। মনে মনে ঠিক করলাম আল্লাহ যেহেতু এদের উছিলায় টুপিটি পড়িয়ে দিলেন তাহলে রাস্তায় গিয়েও টুপি খুলব না, যদিও জানি টুপি পড়া অবস্থায় অন্যান্য চায়নিজরা আমাকে আর বিদেশী মনে করবে ভাববে যে আমি শিনজিহান থেকে এসেছি তারপর পড়লাম। অনেক ভালো অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু করেছিলাম এবং আল্লাহর রহমত নিয়ে এই শহর থেকে কালকে বিদায় নিব। যদিও মাঝে আমার একটি সাইকেল চুরি হয়েছে কিন্তু ক্ষণিকের জন্য খারাপ অভিজ্ঞতাগুলোকে একদম ভুলে গিয়েছিলাম্। তবে এই শহরকে আমি ভুলতে পারব না, অসাধারণ একটি শহর এবং আবহাওয়া এবং এই শহরের মানুষ খুবই হাসি খুশি। এদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গেলাম।
[email protected], web: xueonline.info
চায়নাতে মেডিকেল ইন্টার্ণশীপ এবং আমার অভিজ্ঞতা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৩টি মন্তব্য ১০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ধর্ম ও বিজ্ঞান
করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন
মা
মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।
অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।
একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে
ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন