প্রতিদিন একবার হলেও দেশের প্রধান দৈনিক গুলোর শিরোনামে চোখ বুলানো পুরোন অভ্যাস। ১৫ মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে বিবদমান সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সম্মানিত ভাইস চ্যান্সেলরকে লাঞ্চিত ও তার গাড়ি ভাংচুর করা হয়। ১৬ মে দেশের প্রধান দৈনিক হিসেবে পরিচিত প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত সংঘর্ষের বিস্তারিত বিবরন পড়ে ঘটনাটি জানার চেষ্টা করি। পত্রিকাটির মতে ভিসি লাঞ্চিত করন ও তার গাড়ি ভাংচুরের জন্য মৌলবাদী ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা দায়ী। ঐদিনের প্রকাশিত অন্যান্য সব দৈনিকের বিবরন পড়ে যা পেলাম, তাতে আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনি। তাই তা পাঠকের জন্য উপস্থাপন করছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষে একজন সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছে। ১৪ মে বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে ১৫ মে বিকাল ৩টা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। উদ্ভুত পরিস্হিতিতে আগামী ২১ মে পর্যন্ত সব ক্লাস-পরীক্ষা স্হগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আলম লাঞ্ছিত হন এবং তার গাড়ি গাংচুর করা হয়। এই হ্ল বিভিন্ন পত্রিকায় পরিবেশিত ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরন।
“চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের হামলায় ২৫ কক্ষ তছনছ, উপাচার্যের গাড়ি ভাঙচুর” শীর্ষক প্রথম আলোর ১৬ মে রিপোর্টে বলা হয়, “রাতে উপাচার্য পরিস্থিতি শান্ত করতে শাহ আমানত হলে গেলে সেখানে শিবিরের কর্মীরা উপাচার্যের গাড়ি ভাঙচুর করে এবং তাকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা চালায়। .........গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনরত আমার দেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাশেদ খান লাঞ্ছিত হন।“ এছাড়াও ১৭ মে “ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের ন্যক্কারজনক হামলা” শিরোনামে সম্পাদকীয়তে প্রথম আলো লিখেছে, “তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা উপাচার্যের গাড়ি ভেঙে দিয়েছে, তাঁকে সশরীরে লাঞ্ছিত করারও চেষ্টা করেছে। শিবিরকর্মীদের এ তৎপরতা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয়।“
অর্থাৎ প্রথম আলোর রিপোর্ট মতে উপাচার্যের গাড়ি ভাঙচুরের জন্য ছাত্র শিবির দায়ী। অবশ্য ইত্তেফাক, সমকাল, যুগান্তর, আমার দেশ, ইনকিলাব, আমাদের সময়, মানব জমিন, নয়া দিগন্ত, যায়যায় দিন সহ প্রায় সব পত্রিকার মতে, উপাচার্যকে লাঞ্চিত করন, তার গাড়ি ভাঙচুর ও আমার দেশের প্রতিনিধি রাশেদ খানকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ।
ইত্তেফাক লিখেছে, “সংঘর্ষ চলাকালে বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে ভিসি প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আমানত হলে পৌঁছলে সেখানে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে নাজেহাল করে ও তার গাড়ি ভাংচুর করে। পরে সাংবাদিকরা তাঁকে হলের ভেতরে নিয়ে যায়।“
ইত্তেফাক আরও লিখেছে, “এদিকে গতকাল শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশনে ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন দৈনিক আমার দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রাশেদ খান মেনন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিকাল সাড়ে তিনটায় শাটল ট্রেনে নিজ কর্মস্থলে আসার পথে ছাত্রলীগ কর্মী রাকিবুল হক (প্রাণীবিদ্যা), সাকিব (প্রাণীবিদ্যা) ও শহীদুল ইসলাম (গণিত) রেলস্টেশন এলাকায় তার উপর হামলা চালায়। ইট ও লোহার রডের আঘাতে তার মাথা থেতলে গেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে।“
রাজিব নন্দি পরিবেশিত খবরে সমকাল লিখেছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আবু ইউসুফ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে সরাসরি ক্যাম্পাসে আসেন। তিনি শাহ আমানত আবাসিক ছাত্রহলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কক্ষে গিয়ে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। এ সময় পুলিশকে তল্লাশি অভিযানে নামার দাবি জানায় ছাত্রলীগ কর্মীরা। উপাচার্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের ব্যাপারে মৌখিক আশ্বাস দিলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ কর্মীরা। রাত ১টার দিকে তারা উপাচার্যের গাড়ি ভাংচুর করে।“
সমকালের মতে, “ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।“
যুগান্তর লিখেছে, “এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের ছাত্রশিবির সভাপতিকে হামলার কবল থেকে রক্ষা করতে গিয়ে উপাচার্য প্রফেসর• ড. আবু ইউসুফ আলম লাঞ্ছিত হন বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে। এ সময় তারা উপাচার্যের গাড়ি ভাংচুর করেছে।“
তপন চক্রবর্তী লিখিত আমাদের সময়ের বিবরনিতে বলা হয়, রাত একটায় ভিসি আবু ইউসুফ আলম এসে পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা চালান। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা তার গাড়ি ভাঙচুর করে।“
আমার দেশ লিখেছে, “সংঘর্ষ থামাতে ঘটনাস্হলে রাত ১১টায় ভিসি ড. আবু ইউসুফ আলম এলে ছাত্রলীগ কর্মীরা তার প্রাইভেট কার ভাংচুর করে।“
পত্রিকাটি তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি আহত হওয়া নিযে লিখেছে, “ বিকাল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয় রেলস্টেশন এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন দৈনিক আমার দেশ-এর চবি প্রতিনিধি দর্শন বিভাগের ছাত্র রাশেদ খান মেনন। এ সময় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র রাকিব, সাকিব ও তাদের সহযোগী শহীদের নেতৃত্বে একদল ছাত্রলীগ কর্মী তার ওপর হামলা চালায়। ছাত্রলীগ কর্মীরা ইট ও লাঠি দিয়ে তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্হানে আঘাত করে। ইটের আঘাতে থেঁতলে যায় মেননের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ।
নয়া দিগন্ত লিখেছে, “এ দিকে রব হলে সংঘর্ষের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রশিবির কর্মীরা হলে এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা রাস্তায় অবস্থান নেয়। এ পরিস্থিতিতে ভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আলম আমানত হলের সম্মুখে উভয় ছাত্র সংগঠনের উত্তেজিত, কর্মীদের মাঝখানে অবস্থান নেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা ভিসি’র উপস্থিতিতে আমানত হল শিবির সভাপতির ওপর হামলে পড়লে ভিসি তাকে জড়িয়ে ধরেন। তখনই ছাত্রলীগ কর্মীরা ভিসিকে লাঞ্ছিত করে এবং তার গাড়ি ভাঙচুর করে।“
নয়া দিগন্ত আরও লিখেছে, “ এ দিকে গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ভার্সিটি রেলস্টেশনে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা রাশেদ খান মেননের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা। এ সময় তাকে মাথায় রক্তাক্ত জখম করা হয়। মেনন বর্তমানে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন।“
যায় যায় দিনের রিপোর্টে বলা হয়, “শিবির-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছাত্র হলে ১৫টি কক্ষে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। একই ঘটনায় উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রলীগ কর্মীরা উপাচার্যের ব্যবহৃত গাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর করেছে।“
ইনকিলাব লিখেছে, “ভিসি প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ আলম শাহ আমানত হলে প্রবেশ করলে সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা হলের বাইরে ও শিবির হলের ভেতরে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা শাহ আমানত হলে ঢুকতে চাইলে ভিসি, প্রক্টর ও পুলিশ তাদের শান্ত হতে বলে। এসময় উত্তেজিত ছাত্রলীগ কর্মীরা ভিসি, প্রক্টরকে মারার জন্য লোহার রড নিয়ে তেড়ে আসে। এসময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব, যায়যায়দিন, ভোরের কাগজ, মানবজমিন ও বাংলাবাজার পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা মানব প্রাচীর তৈরী করে ভিসিকে রক্ষা করেন। হলে ঢুকতে না পেরে উত্তেজিত ছাত্রলীগ কর্মীরা হলের বাইরে পার্কিং করা ভিসির গাড়িটি ভাংচুর করে।এতে গাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। “
যতদুর মনে পড়ে, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ভোরের কাগজ থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়। পদত্যাগের কারন হিসেবে তখন তিনি বিবিসি কে বলেছিলেন,পত্রিকাটি যেহেতু সরকারী দলের একজন গুরুত্বপূর্ন মন্ত্রীর (ভোরের কাগজের মালিক সাবের হোসেন চৌধুরী ৯৬ আলীগ সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী ছিলেন) সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত, তাই নিরপেক্ষ ভাবে পত্রিকা চালানো সম্ভব নয় বলে তিনি পদত্যাগ করছেন। এরপর প্রথম আলো প্রকাশের আগে বিজ্ঞাপন হিসেবে তাদের পত্রিকা প্রকাশনা টিমের পক্ষ থেকে কার্টুনিষ্ট শিশির ভট্টাচার্যের একটি কার্টুন প্রকাশ করা হত বিভিন্ন দৈনিকে। এতে দেখা যায়, একজন পাঠক কোন ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে দুইটি পত্রিকা পাশাপাশি রেখে প্রকৃত সত্য উদ্ধারে গলদঘর্ম। এই পেরেশানী থেকে পাঠককে উদ্ধারের স্বার্থেই নাকি মতি-মাহফুজ জুটি প্রকাশ করেছেন নিরপেক্ষ দৈনিক প্রথম আলো। দূর্ভাগ্য বশত শিশিরের সেই কার্টুনের মতো এখনও আমাদের প্রকৃত সত্যের জন্য দেখতে হয় অনেক পত্রিকা আর তার মধ্যেই বেরিয়ে আসে প্রথম আলোর নিরপেক্ষতার নামে হলুদ সাংবাদিকতার আসল রূপ।
লেখকঃ গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, ই-মেইল, [email protected]
সুত্র, Click This Link