somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাজিদ রাজার বাড়ি (ইতিহাস/ঐতিহ্য)

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৬:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বৃহত্তর আটগ্রামের চারিগ্রামে ঐতিহাসিক সাজিদ রাজার বাড়িটি অবস্থিত। আটগ্রাম বাজারের সন্নিকটে সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত বিখ্যাত এ জমিদার বাড়িটি জকিগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঐতিহাসিক এ বাড়িটির নাম শুনেনি এমন মানুষ জকিগঞ্জ তথা পূর্ব সিলেটে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্থানীয় মানুষদের পাশাপাশি প্রতিদিন প্রচুর পর্যটক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাড়িটি দেখতে আসেন। ঘুরে ঘুরে বিলুপ্তপ্রায় বিশাল এ ঐতিহ্য দেখে মুগ্ধ হন।

প্রায় ১৫ একর জমির উপর নির্মীত ঐতিহাসিক এ বাড়িটি তখনকার জমিদার সাজিদ রাজা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মাণ করেন। তিনি খুব সৌখিন ও রুচিশীল ছিলেন। এজন্য দৃষ্টিনন্দন এ বাড়িটি নির্মাণ করতে সুদূর কলকাতা থেকে কারিগর নিয়ে আসেন। সে সময় কলকাতার প্রকৌশলী ও কারিগরদের সুনাম সারা ভারতবর্ষে ছিল। বৃটিশদের অনেক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরী করে সুনাম অর্জন করেছিলেন কলকাতার প্রকৌশলীরা।

বাড়িটিতে বিলুপ্তপ্রায় একটি বসত ঘর আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে মূল এ প্রাসাদটি ভেঙ্গে পড়েছে। কালের সাক্ষী হয়ে শুধু দেয়ালের কিছু অংশ বাকী আছে। আছে একটি সুদৃশ্য ১৩ চালের ঘর। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এ ঘরটি রাজার বৈঠকখানা হিসাবে ব্যবহৃত হত। এছাড়া একটি বিচারালয়, সুদৃশ্য একটি মসজিদ এবং বিশাল বড় একটি দীঘি আছে।

১৩ চালের টিনের তৈরী বৈঠকখানাটি আধুনিক স্থাপত্যকেও যেন হার মানায়। ঘরটির নির্মাণ শৈলী অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও মজবুত। নির্মাণের এত বছর পরও এটি ঠিকে আছে। এর নির্মাণ শৈলী ও স্বতন্ত্র্য গঠন বৈচিত্র দেখলে অনুমান করা যায় একদল প্রশিক্ষিত ও পেশাদার নির্মাণ শিল্পীর দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার সংমিশ্রণে এটি তৈরী। শোনা যায়, ঘরটি তৈরী করতে তৎকালীন সময়ে প্রায় ১৩ হাজার টাকা খরছ হয়েছিল। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে ঘরটি নির্মীত।


বৈঠকখানার টিনের চাল, দরজা, জানালা এমনকি ঘরের বেড়ায় শিল্পের ছোয়া পাওয়া যায়। ঘরের খুঁটি ও ছাদ কাঠের তৈরী, তবে মেঝে পাকা করা। এক কক্ষ বিশিষ্ট এ ঘরটি রাজার বৈঠকখানা হিসাবে ব্যবহৃত হত। সামনের সুদৃশ্য বারান্দা, সিঁড়ি ও কাঠের তৈরী দৃষ্টি নন্দন পিলার ঘরটির সৌন্দর্য্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার মেঝ মামা দীর্ঘদিন ঐতিহাসিক এ বাড়িতে বসবাস করায় ছোটবেলা অনেকবার এ বৈঠকখানায় থেকেছি। এজন্য এখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়।

ধর্মপ্রাণ সাজিদ রাজা নিজের ও প্রজাদের নামাজ পড়ার সুবিধার্তে বাড়ির সামনে নির্মাণ করেন সুদৃশ্য মসজিদ। বড় বড় পিলার ও গম্ভুজের তৈরী মসজিদটি ১৭৪০ খৃষ্টাব্দে তৈরী করা হয়। মসজিদের মূল স্থাপনাটি একটি উঁচু ভিত্তির উপর প্রতিষ্টিত হওয়ায় মুসল্লীদের উঠানামার জন্য তেরী করা হয় সুদৃশ্য ও মজবুত সিঁড়ি। মসজিদটি এখনও ব্যবহার উপযোগী। এলাকার মানুষ প্রতিদিন এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন।

সাজিদ রাজার জন্ম জৈন্তীয়া রাজবাড়িতে। তিনি ছিলেন জৈন্তার ইছন রাজার পুত্র। সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ছিলেন তার ভায়রা। শুনা যায় হাছন রাজার সাথে সাজিদ রাজার খুব ঘনিষ্টতা ছিল। এজন্য বেশ কয়েকবার তিনি সাজিদ রাজার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। বৈঠকখানায় নিয়মিত গানের আসর জমাতেন।

উল্লেখ্য, জৈন্তীয়া রাজ্যের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের। এটি একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল। উত্তর-পূর্ব সিলেটের জৈন্তা, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট উপজেলা এবং কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার একটা অংশ নিয়ে রাজ্যটির বিস্তৃতি ছিল। এছাড়া জৈন্তীয়া পাহাড় ও ভারতের আসাম রাজ্যের নওগা জেলার একটা অংশও এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রাচীন জৈন্তীয়া রাজ্যের রাজধানী ছিল খাসিয়া জৈন্তীয়া পাহাড়ের নরতিয়াং নামক স্থানে। তবে ১৬৮০ সালে রাজধানী বর্তমান জৈন্তা উপজেলা সদরের নিজপাট নামক স্থানে স্থানান্তরিত হয়।


সাজিদ রাজার জমিদারী ছিল চারপাশে ১৫ বর্গ কি:মি: পর্যন্ত বিস্তৃত। জকিগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা তাঁর শাসনাধীন ছিল। এছাড়া কানাইঘাটের একটি অংশও অন্তর্ভূক্ত ছিল। তবে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় জমিদারীর একটি বড় অংশ ভারতের অভ্যন্তরে চলে যায়। তিনি খুব প্রজাবান্ধব ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন। অন্যান্য অনেক জমিদারদের মত তিনি অত্যাচারি ও নির্দয় ছিলেন না। তিনি খুবই ভদ্র ও আদর্শবান ছিলেন বলে প্রজাদের কাছে তার সুনাম ছিল।

এছাড়া ন্যায়পরায়ন শাসক হিসাবে তার জনপ্রিয়তা ছিল সর্বত্র। প্রজাদের দেখভাল করার জন্য কাঠের তৈরী গাড়ি ও হাতির পীঠে চড়ে তিনি সারা রাজ্য ঘুরে বেড়াতেন। তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনতেন এবং সমাধানের চেষ্টা করতেন। তার প্রচুর হাতি ছিল। প্রজাদের পানির অভাব পূরণের জন্য তিনি বাড়ির সামনে প্রায় ৮ একর জমির উপর বিশাল দীঘি খনন করেন। দীঘিটি আজো এলাকার মানুষ ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছেন।

অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এ বাড়িটি প্রয়োজনীয় সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মূল বসত ঘরটি ভেঙ্গে পড়েছে। ১৩ চালের ঐতিহাসিক বৈঠকখানাটি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ। যেকোন সময় এটি পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। এছাড়া মসজিদ ও পুকুরঘাট ধূকে ধূকে কোন মতে টিকে আছে। সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে ঐতিহাসিক এ বাড়িটির অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা এখনো সম্ভব। এজন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছা ও সুষ্ট পরিকল্পনা। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করলে বাড়িটি হয়ে উঠতে পারে একটি ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। পাশাপাশি টিকিয়ে রাখা যাবে দেশের ঐতিহ্য।

ঐতিহাসিকভাবে সিলেট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। শুধু সংরক্ষণের অভাবে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। বাকি যা টিকে আছে তাও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আশা করি সরকার দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বার্থে এসব স্থাপনা সংস্কারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন। একটি জাতির জন্য তার ইতিহাস জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করাও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।।



তথ্য সূত্র-
দৈনিক যুগান্তর, কানাইঘাট বার্তা, সিলেটের ডাক ও
banglapage24.com

ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:০৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×