"শোন হে মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই"।
পংক্তিটি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাসের লেখা। কবির মর্মস্পর্শী এ বাণীটি আমাদের রক্তে শত শত বছর থেকে প্রবাহিত। আমাদের অতিথি পরায়নতা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহনশীলতার ইতিহাস হাজার বছরের। প্রতিটি ধর্মের মানুষ সম মর্যাদা ও নির্ভরতায় এই বাংলায় যুগের পর যুগ বসবাস করে আসছে। বাংলার প্রতিটি মানুষ অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী। আমরা চিন্তা চেতনায় সব সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি প্রতিনিয়ত। যা আমাদেরকে উত্তম জাতি হিসাবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেছে।
-- আমরা কী এখনো তেমন আছি?
ইদানিং কোথায় যেন ভাঙ্গনের সুর কানে আসে। কোথায় যেন একটা অবিশ্বাস ও অসহনশীলতার ঘোমট বাঁধা গোধুলীর আগমনী ধ্বনি মনটাকে বিষাদে ভরিয়ে দিচ্ছে। পারস্পরিক আস্থা ও নির্ভরতায় ফাটল ধরেছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে দেখা যাচ্ছে বিষাদের সুর। কালবৈশাখীর ঘোমট অন্ধকার আমাদের মনে বাসা বেঁধেছে অজান্তে। বড্ড বেশি স্বার্থপর হয়ে উঠছি আমরা। যা মোটেও কারো কাম্য নয়।
-- কখনো না?
গোঁড়া মুসলিম পরিবারে আমার জন্ম হলে আমাকে বোঝানো হবে একমাত্র আমিই ভাল। বাকিরা সব বিধর্মী, বাতিল, কাফের, দুশমন ও বিপথগামী। এরা কখনো তোমার বন্ধু হতে পারে না, প্রতিবেশী হতে পারেনা, শুভাকঙ্খী হতে পারে না। এদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না, তাদের বাড়িতে যাওয়া যাবেনা, বন্ধুত্ব করা যাবে না। এমনকি তাদের বিপদে আপদে পর্যন্ত খোঁজ নেওয়া যাবে না, সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে না।
-- ভালবাসা যাবে না?
-- ভাল বলা যাবে না?
এদের শুধু দেশছাড়া নয়, পারলে পৃথিবী ছাড়া করলেও খুব একটা অপরাধ নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে পরম কর্তব্যও বটে। এরা দেশত্যাগী হলে পুলকিত হই। কেউ সহায়-সম্পদ দখল করলে, তাদেরকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করলে প্রতিবাদ করি না। বিধর্মী অসহায় মেয়েটি ধর্ষিত হলে নিজের পরিবারের একজন হিসাবে কল্পনা করি না, কষ্ট পাই না। বলা হবে মধ্যপ্রাচ্যের ভাইয়েরাই আমার আত্মার আত্মীয়। এরাই একমাত্র বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী বাকিরা সব পর। পশ্চিমা ইহুদী, নাসারা সব আমাদের জাত দুশমন। এদের পরিত্যাগ করতে হবে। এদের কোন কৃষ্টি-কালচার ফলো করা যাবেনা, সম্পর্ক রাখা যাবেনা।
গোঁড়া হিন্দু/খৃষ্টা/ইহুদী/বৌদ্ধ ধর্ম হলেও ঠিক তাই বোঝানো হবে।
অথচ এই আমরাই ইউরোপ আমেরিকায় গেলে, সে দেশগুলোর নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য কতই না ছল-ছাতুরী করি এবং মিথ্যার আশ্রয় নেই। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে সম অধিকার চাই। তাদের দেওয়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বিনা বাক্যে গ্রহণ করি। যে মানুষদের একটা সময় কোন কারণ ছাড়াই ঘৃণা করতাম তাদের দেশে যাওয়ার পর তাদের বন্ধু হতে চাই! সহানুভতি ও সহযোগিতা চাই। তাদের আবিষ্কৃত বিমানে চড়ে পৃথিবী ঘুরে বেড়াই, সুন্দর এ পৃথিবীর রূপ স্বচক্ষে উপভোগ করি। তাদের আবিষ্কৃত উন্নত ঔষধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় সুস্থতা ফিরে পাই। তাদের আবিষ্কৃত ইন্টারনেট ও কম্পিউটার/মোবাইল ব্যবহারের সুবিধা নেই।
-- কিন্তু তা কী স্বীকার করি?
বিপদে পড়লে উদ্ধার পেতে তাদের আশ্রয় খুঁজি। তাদের ভাষা শিখি। তাদের জাতীয় মূল্যবোধকে সম্মান করি। তাদের কৃষ্টি-কালচার ফলো করি। দেশ থেকে আমরা অনেকেই সেসব দেশে যেতে চাই, তাদের উন্নত জীবন-যাপনে নিজেকেও অংশীদার করতে চাই। তাদের উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা নিতে চাই। অথচ সময় সুযোগ পেলেই তাদেরকে গালি দেই।
-- কঠিনতম গালি?
যতদূর জানি সব ধর্মেরই মূল কথা হলো মানুষকে ভালোবাসা। তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা এবং বিপদ-আপদে সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতা করা। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত ধর্ম এসেছে সবার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ভালবেসে সমাজকে বাসযোগ্য করা। পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা। মানুষে মানুষে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্টা করা। ধর্মের আগমন তো মানুষেরই জন্য।
-- তাই না?
যদি কোন ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, মানুষের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করতে শেখায়, মানুষ হত্যা করতে শেখায় তা কোন অবস্থাতে সৃষ্টিকর্তার ধর্ম হতে পারে না। অথচ আমরা কিছু না বুঝেই অন্য ধর্মকে তিরস্কার করি। পারলে অন্য মতবাদকে গলা টিপে হত্যা করি। ধর্মের নামে মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্যুত করি। জোর করে নিজের বিশ্বাসকে তার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। না পারলে অপমান-অপদস্থ করি। আমরা ভালবাসা ও যুক্তি দিয়ে তা করি না। বাধ্য করার চেষ্টা করি।
-- কাজটি কী ঠিক?
আচ্ছা, আমি বাংলাদেশে জন্মেছি বলেই প্রতিবেশী মায়ানমার-ভারতীয়দের গালি দেব? --- আর ভারত-মায়নমারে জন্মেছি বলে বাংলাদেশীদের ঘৃণা করবো?
অনেকের মতে এই গালি দেওয়া, ঘৃণা করাও নাকি এক প্রকার দেশপ্রেম! জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনাও বটে! আবার এই আমরাই অসুস্থ হলে সেসব দেশের বড় বড় নামকরা ডাক্তারদের স্বরণাপন্ন হই। পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে চিকিৎসা করাতে যাই। তাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করি। পাশাপাশি মুখে মুখে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াই। সমাজে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেই। এটা হিপোক্রেসি নয় কী?
-- কোন দেশটা আমার?
দেশ তো একটা নাম, একটা ভৌগলিক সীমারেখা। সেটাও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত আমরা সবাই বৃটিশ শাসনাধীন ভারতীয় ছিলাম। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছিলাম পাকিস্তানী। আজ বাংলাদেশি। পরশু যে মানুষটা ভারতবাসী হিসাবে ইংরেজকে ঘৃণা করেছিল, কাল সে পাকিস্তানী হিসাবে সেই ভারতকেই ঘৃণা করছে! হায়রে দেশপ্রেম, আজ হয়ত সে-ই আবার বাংলাদেশী হিসাবে ভারত আর পাকিস্তান দুই দেশকেই ঘৃণা করছে!
-- কি করবো আমি?
কিসের ভিত্তিতে নিজেকে আলাদা করবো? বাংলায় কথা বলি এজন্য বাঙালি হিসাবে গর্ববোধ করবো? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নিজের ভাই বলবো, নাকি ধর্মের কারণে পাকিস্তানীদের নিজের ভাই বলবো? কিন্তু আমার দেশের যে মানুষগুলো (উপজাতি) অন্য ভাষায় কথা বলে, যাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আলাদা তারা কি আপনা লোক নয়? দেশটা কী সংখ্যাগুরুদের একমাত্র মালিকানা, সংখ্যালঘুদের কোন অধিকার নেই। এরা আপনা লোক নয়?
-- প্রাণের মানুষ নয়?
তারাও তো এই দেশের সন্তান, এদেশের হাওয়া বাতাসে হাজার বছর থেকে বসবাস করে আসছে। আমি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলে অন্যদের যথাক্রমে উড়ে, নেড়ে, মেড়ো, খোট্টা, বাঙ্গাল, চিনকি, গুজ্জু বলে অপমান করবো? সেক্ষেত্র কেউ যখন আলসি বঙালি বলে আপনাকে গালি দেয় তখন খারাপ লাগে কেন? কেন বলি এটা অপমানজনক কথা, এটা বলতে পার না। আমার আঁতে ঘা লাগে, অপমান লাগে।
-- অপমান কী মেনে নেই?
আমাদের দেশে যে মানুষটাকে সংখ্যালঘু বলে অপমান করি, প্রচার করি। প্রতিবেশী দেশে দেশান্তরিত হলে সে হবে সংখ্যাগুরু। আর যে আমি নিজেকে সংখ্যাগুরু হিসাবে বড়াই করি সেই আমি প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিলে হই সংখ্যালঘু। তখন সম অধিকারের আওয়াজ তুলি। সংখ্যালঘু শব্দটির পোস্টমর্টেম করতে চাই। পৃথিবী ব্যাপী ভিন্ন জাতি ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হলে, যুদ্ধে মারা গেলে তেমন গুরুত্ব দেই না। অথচ নিজ জাতি-ধর্মের কেউ কোথাও সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হলে কষ্ট পাই, প্রতিবাদের ঝড় তুলি। আমরা কী বলতে পারিনা এদেশে কেউ সংখ্যালঘু নয়, আমরা সবাই সংখ্যাগুরু। সবাই সমঅধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে চাই।
-- সংখ্যালঘু শব্দটা কী মর্যাদার?
বাংলায় কথা বলি বলে বাকিদের বাংলা থেকে আলাদা করেছি? তাহলে এই বাংলার মধ্যেই যে লোকগুলো খাসিয়া, মনিপুরী, চাকমা, গারো ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে তারা আলাদা হবে না কেন? কেন তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র মেনে নেই না? আমরা নিজেদের অজান্তেই তাদেরকে উপজাতি হিসাবে আলাদা করছি শুধু জাতি, ধর্ম-বর্ণ আর ভাষা-সংস্কৃিতির ভিত্তিতে।
-- এটা হওয়া উচিৎ?
আমি ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ঘৃণা করবো? --- রঙের ভিত্তিতে মানুষকে ঘৃণা করবো? --- ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে ঘৃণা করবো? --- আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে মানুষকে ঘৃণা করবো? --- জাতের ভিত্তিতে মানুষকে ঘৃণা করবো? --- আমি দেশপ্রেমের নামে অন্য দেশের মানুষকে ঘৃণা করবো?
-- আর কত ঘৃণা চাই?
কতদিন আর সমাজের বলে দেওয়া কথা শুনে মানুষকে ঘৃণা করবো? কবে আমাদের এই বোধ হবে যে আমরা ঘৃণার সংস্কৃতি চাইনা। আমরা চাই মানুষ হিসাবে পারস্পরিক ভালবাসা ও সম্মান। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে আমরা ঘৃণা শব্দটি ভুলে যেতে চাই। মানুষ হতে চাই।
-- শুধুই মানুষ হতে চাই?
সব থেকে বিভ্রান্তীর বিষয় হলো কখন কোনটাকে আঁকড়ে ধরবো? কখন কিসের ভিত্তিতে মানুষকে ঘৃণা করবো? যা আমাদের জানা নেই। কারণ আমরা যে সমাজে জম্ম নিয়েছি, বেড়ে উঠেছি সে সমাজটাই আমাকে বলে দেয় কখন কাকে ঘৃণা করতে হবে। অপমান করতে হবে। একবারও কি নিজেকে প্রশ্ন করেছি প্রচলিত অসুস্থ সামাজিক এ ব্যবস্থা আমাকে কী মানুষ হতে সাহায্য করছে? বড্ড অসহায় লাগে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। পৃথবীর সভ্য দেশগুলো আজ মানুষকে তার মানবিক গুনাবলীর জন্য মূল্যায়ন করলেও আমরা কোন এক অদৃশ্য ইশারায় হাজার বছরের ঐতিহ্য থেকে সরে যাচ্ছি।
-- আমি মুসলিম আমি গর্বিত!
-- আমি হিন্দু আমি গর্বিত!
-- আমি ইহুদী আমি গর্বিত!
-- আমি খ্রিস্টান আমি গর্বিত!
-- আমি ভারতীয় আমি গর্বিত!
-- আমি বাংলাদেশী আমি গর্বিত!
-- আমি বাঙালি আমি গর্বিত!
-- আমি বিহারি আমি গর্বিত!
-- আমি মাড়োয়ারি আমি গর্বিত!
-- আমি মোঘল আমি গর্বিত!
-- আমি রাজপুত আমি গর্বিত!
-- আমি ব্রিটিশ আমি গর্বিত!
-- আমি এশিয়ান আমি গর্বিত!
-- আমি ইউরোপিয়ান আমি গর্বিত!
-- আমি অস্ট্রেলিয়ান আমি গর্বিত!
-- আমি আফ্রিকান আমি গর্বিত!
-- আমি আমেরিকান আমি গর্বিত!
-- আমি চায়নিজ আমি গর্বিত!
-- আমি মঙ্গল আমি গর্বিত!
-- আমি জাপানিজ আমি গর্বিত!
-- আমি অটোম্যান আমি গর্বিত!
-- আমি ডাচ আমি গর্বিত!
-- আমি আরব আমি গর্বিত!
-- আমি পার্সিয়ান আমি গর্বিত!
-- আমি রাশিয়ান আমি গর্বিত!
-- আমি ওলন্দাজ আমি গর্বিত!
-- আমি স্পেনিশ আমি গর্বিত!
-- আমি গ্রিক আমি গর্বিত!
ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এতো যে আমার গর্ব এর কোনটাই নিজের কৃতিত্বে নয়। আসলে সবটাই বাই ডিফল্ট।
সবশেষে নিজের একটা কথা বলি। আমি মানুষ এজন্য আমি লজ্জিত, ভীষণভাবে লজ্জিত। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছি বলেই সমাজ আমাকে মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, গালি দিতে শেখায়, অন্যকে ঠকাতে শেখায়, মিথ্যা বলতে শেখায়, লোভী হতে শেখায়, ঘুষখোর হতে শেখায়, মানুষকে খুন করতে শেখায়। পশুপাখি অথবা কীটপতঙ্গ হয়ে জন্ম নিলে অন্তত এগুলো শিখতে হত না।
-- সময় এসেছে মানুষ হওয়ার?
আসুন নিজের বিবেককে জাগ্রত করি, সমাজে প্রচলিত আবেগকে নয়। সবাই মিলে মস্তিষ্কের চিন্তা-চেতনা ও শুভ বুদ্ধির চর্চা করি। মানুষকে মানুষ হিসাবে ভালবাসতে শিখি। সবাই একদিন নিশ্চিত মারা যাব, আসুন চেষ্টা করি যাতে মানুষ হিসাবে মরতে পারি। এটাই জীবনের স্বার্থকতা। খুব ভাল মানুষ না হতে পারি অন্তত মানুষ হওয়ার চেষ্টা তো করতে পারি, তাই না? আর এটাই এখন বড্ড বেশি প্রয়োজন।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৮ সকাল ৯:০৮