বাংলাদেশে আসার পর থেকে মানুষের মুখে মুখে দেশের বড় বড় সুপারশপের কথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু কেন যেন এসব সুপার শপে যাওয়ার আগ্রহ কখনো হয়নি। যদিও রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়ার পথে কয়েকটি সুসজ্জিত শপ চোখে পড়ে, তারপরেও কেনাকাটার উদ্দেশ্যে শপগুলো ভিজিট করিনি। গত কিছুদিন আগে অনেকটা কৌতুহলবশতঃ একটি নামকরা সুপারশপে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য যতটুক না শপিং করা তার চেয়ে বেশী শপ দর্শন। শপটিকে বাইরে থেকে যেমন দৃষ্টিনন্দন ও সজ্জিত মনে হয়েছিল, ভেতরে ঢোকার পর তেমনটা মনে হয়নি। নামে সুপারশপ হলেও দোকানের সাইজ মোটেও "সুপার শপ" সুলভ নয়। অনেকটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মতো। শপটিতে নেই কোন ট্রলি ও পার্কিং সুবিধা।
একটি বিদেশী অলিভ অয়েলের টিনের কৌঠা হাতে নিয়ে দেখি সুপার শপের লোগোতে দাম ১৮০ টাকা। একটু নাড়াচড়া করতেই কৌটার নীচে বাংলাদেশেী আমদানীকারকের লোগোতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য দেওয়া আছে ১৫৫ টাকা। হায় হায় তাহলে এরা ২৫ টাকা বেশি নিচ্ছে! সুপারশপে ঘুরতে ঘুরতে আর কিছু পণ্যের দামেও গড়মিল চোখে পড়ল। একটি বিদেশী বডি স্প্রের মূল্য দেওয়া আছে ৩৪০ টাকা, অথচ বাইরের দোকানগুলোতে এর দাম ২৬০-২৮০ টাকার মধ্যে। কাঁচা শাক-সব্জি, মাছ-মাংসের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি মনে হল।
প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট ঘোরাঘুরি করে কেনাকাটা না করেই বাইরে চলে আসি। বাসায় আসার পথে অনেকটা কৌতুহল বশতঃ গলির মুখের পরিচিত এক মোদি দোকানে সুপার শপে দেখা একই অলিভ অয়েলের একটি কৌটার দাম জানতে চাইলে দোকানী ১৫০ টাকা চাইলেন। কিন্তু উনার সাথে দরদাম করতেই দাম নেমে আসল ১৩০ টাকায়! দোকানি বল্লেন, আপনি পরিচিত মানুষ তাই স্পেশাল ডিসকাউন্ট! অবাক হলাম সুপারশপটি একটি অলিভ ওয়েলের কৌটা থেকে ক্রেতাদের পকেট কেটে ৫০ টাকা বেশি নিচ্ছে? বাড়তি হিসাবে আছে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট!) ঝামেলা। যদিও সাইনবোর্ডে সুপার শপটির স্লোগান লেখা ছিল "ন্যায্য মূল্যে শ্রেষ্ট পণ্য"। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম ঠিক উল্টো!
বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে সুপার শপের যাত্রা শুরু হলেও উন্নত বিশ্বে এর শুরু অনেক অনেক বছর আগে। ১৯১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভিনসেন্ট এস্টোর "এস্টোর মার্কেট" নামে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে একটি সুপারশপ খোলেন। তবে মূলতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী সুপার মার্কেটের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে শিল্পোন্নত ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিভিন্ন দোকান থেকে ঘুরে ঘুরে যাচাই করে কেনা কঠিন হয়ে পড়ে। এটা অনেক সময় সাপেক্ষ এবং বিরক্তিকরও বটে। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু'জনই কর্মজীবী তাদের জন্য বাজারে ঘুরে ঘুরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা বেশ কষ্টকর।
আসলে একই ছাদের নীচে মানুষের প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্য সামগ্রী, বিশেষ করে গ্রোসারী পণ্য পাওয়ার প্রয়েজনীয়তা থেকেই সুপারশপের যাত্রা শুরু হয়। উন্নত দেশগুলোতে গত প্রায় পঞ্চাশ বছর থেকে সুপার মার্কেটগুলো সুনামের সাথে ব্যবসা করলেও আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অল্প কয়েক বছর থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রতি বছর এসব দোকানের চাহিদা প্রায় ৮%-১০% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বিশ বছরে দেশের অন্তত ২০% মানুষের কেনাকাটার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্লেস হবে সুপার শপগুলো।
মনে আছে লন্ডনে যাওয়ার দুই-তিনদিন পর আমার এক আত্মীয়ের সাথে টেস্কো (tesco) সুপারস্টোরে গিয়েছিলাম। দেখে তো চোখ ছানাবড়া। --বি--শা--ল-- বড় শপ। একটি শপ এতো বড় হতে পারে! ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্যাস্য মনে হল। না দেখলে হয়ত কখনো কল্পনায় আসত না। সুপারস্টোরের সামনে বিশাল বড় কার পার্ক, এক সাথে এক-দেড় হাজার গাড়ি অনায়াসে পার্কিং করা যায়। শপের ভেতরে মানুষের প্রয়োজনীয় এমন কোন আইটেম নেই যা তাদের সংগ্রহে থাকে না। শুধু মানুষ কেন? পশু পাখির খাদ্য থেকে শুরু করে বাড়ি গাড়ি, গাছপালার প্রয়োজনীয় সব উপাদান, কিছুই বাদ যায় না এসব সুপারশপে।
শেলফে থরে থরে হাজার হাজার আইটেম সুশৃংখলভাবে সাজানো আছে। শপটির একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত দেখা যায় না। ক্রেতারা যাতে প্রয়োজনীয় সব আইটেম সহজে পেতে পারে সেজন্য আছে সদাহাস্যজ্বল সেলসম্যান। এক সাথে শত শত মানুষ এসব সুপারস্টোরে অনায়াসে শপিং করতে পারে। পেমেন্টের সময় ক্রেতাদের যাতে অপেক্ষা করতে না হয় সেজন্য আছে অন্তত ত্রিশ-পয়ত্রিশটি পেমেন্ট পয়েন্ট। ক্যাশ কাউন্টারে কাজ করা কর্মীরা খুবই দক্ষ, স্মার্ট, হেল্পফুল এবং ভদ্র। তবে বাংলাদেশী প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য, মশলাপাতি, দেশী মাছ ইত্যাদির জন্য আছে আলাদা বড় বড় ক্যাশ এন্ড ক্যরি। ইংল্যান্ডের সব শহরেও এখন বাংলাদেশি ক্যাশ এন্ড ক্যারি আছে। শুধু লন্ডনেই আছে কয়েক'শো।
টেস্কোর (Tesco) পাশাপাশি ইউ কে-তে আছে সেইন্সবারি (Sainsbury's), আজদা (ASDA), ওয়েইটরোজ (Waitrose), মরিসন (Morrison) ও আলডি'র (Aldi) মত বড় বড় সুপারস্টোর। ASDA হল আমেরিকার বিখ্যাত চেইন সুপার মার্কেট Walmart এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এসব সুপারস্টোরের বেশিরভাগই ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। আমি সব সময় ASDA থেকে শপিং করতাম, বিশেষ করে ইস্ট লন্ডনের ভেকটন আজদায়। মাঝারি মাপের স্টোরগুলোর মধ্যে আছে "মার্কস এন্ড স্পেনসার'' (Marks & Spencer), লিডল (Lidl), কো-অপারেটিভ (Co-operative), আইসল্যন্ড (Iceland), নাইনটি নাইন পি (99p), পাউন্ডল্যান্ড (Poundland) ইত্যাদি। এসব সুপারস্টোরগুলো এত কম্পিটেটিভ্ হয় যে, তারা সর্বনিম্ন দামে সবচেয়ে ভালো পণ্যটি ক্রেতাদের কাছে সবার আগে পৌছে দিতে চায়। ফলে সাধারন ক্রেতারা লাভবান হয়।
আমার কাছে সবচেয় অবাক লেগেছে এসব সুপারস্টোরগুলোর পণ্যের দাম দেখে। সুপারশপ থেকে ক্রেতারা ছোট ছোট দোকানগুলোর চেয়ে অন্তত ১৫-২০% কম দামে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারে। উইকএন্ডে (শনি ও রবিবার) এসব সুপারস্টোরে প্রচন্ড ভীড় থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে সপ্তাহের বাজার গাড়ি ভরে নিয়ে যায়। যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই তাদের জন্য থাকে পাবলিক বাসের সুবিধা। আরেরকটি তথ্য দিয়ে রাখি, ইংল্যান্ডে কিছু কিছু কোম্পানি বেতন প্রতি সপ্তাহান্তে পরিশোধ করলেও বৃহৎ কোম্পানিগুলো মাস শেষে বেতন পে করে। অনেকে ফ্যামেলি নিয়ে বাজার করতে আসেন তাই এসব সুপারস্টোরকে কেন্দ্র করে চা কফি এমনকি অনেক খাবারের রেস্টুরেন্ট থাকে। স্টোরগুলোতে পণ্যের গুণগত মানে কোন ছাড় নাই। ভেজাল ও মেয়াদউত্তীর্ণ পণ্য এসব সুপারস্টোরে পাওয়া কল্পনাতীত। আর সব সময় কোন না কোন পণ্যের মূল্য ছাড় থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সম্পূর্ণ বিপরীত। বাংলাদেশে যত বড় শপ তত বেশী দাম! একতো বাড়তি দাম তার উপর দেশের অনেক সুপারশপে ভেজাল, মেয়াদত্তীর্ণ ও নিম্মমানের পণ্য রাখা হয় বলে অভিযোগ আছে।
!!!------------বাংলাদেশের ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, "কোন ব্যক্তি কোন আইন বা বিধির নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন"।--------------!!!
অতএব আইনগত ভাবে বেশী দাম নেওয়া এসব সুপারশপের মালিকরা দন্ডিত হওয়ার কথা। অনেক সময় ভ্রাম্যমান আদালত শুধু অর্থদন্ড করেই দায়িত্ব শেষ করে। পণ্যের গায়ে যে দাম থাকে তাই একটি পণ্যের সর্বোচ্ছ খুচরা মূল্য। তাই ভ্যাট হিসেবে আমাদের দেশে সুপার শপগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত যে টাকা নেয় তা আইন বহির্ভূত ও অনৈতিক। কারণ প্রত্যক্ষ কর ক্রেতা দেয় না, বিক্রেতাকেই দিতে হয়। যা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত। ইদানিং দামী খাবারের দোকানগুলোও ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করছে। যা অবিশ্যাস্য, অকল্পনীয়।
দেশটা যেন মগের মুল্লুক!!
.........দেখার কেউ নেই।
কিছুদিন আগে মাছের বাজারে দুইটি মাঝারি আকারের রুই মাছের দাম চেয়েছে ১৮০০ টাকা। যদিও মাছগুলোর বাজারমূল্য ৮০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এরা ক্রেতাদের চেহারা বুঝে দাম বলে। অপরিচিত ও ভাল পোষাকের কাস্টমার হলে দামটা বাড়িয়ে বলে। এদের সাথে বেশী দামাদামি করলে অনেক সময় অপমাণিত হতে হয়। মহিলা ক্রেতাদের জন্য মাছ-তরকারী ক্রয় করা আরো বেশি দুঃসাধ্য কাজ। অনেক সময় তাদের বিব্রতকর পরিস্তিতির মুখোমুখি হতে হয়। মাছ বাজারের অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, চিল্লাচিল্লি, ঠেলাঠেলি ও প্রচন্ড দুর্গন্ধে বাজারটিকে নরক মনে হয়। বাজারে নেই মনিটরিংয়ের কোন ব্যবস্থা। বিক্রেতারা ইচ্ছা মাফিক দাম নির্ধারন করে। এক দিনের ব্যবধানে কখনো দ্বিগুন দাম বৃদ্ধি পায়! এজন্য সুপারশপে ন্যায্য মূল্যে মাছ-মাংস থাকলে ক্রেতারা অযথা দামাদামি করা থেকে মুক্তি পেতেন। বিশেষ করে মহিলা ক্রেতাদের হয়রানি কিছুটা কমতো।
সময়ের পরিক্রমায় সুপারশপের প্রয়োজনীয়তা আমাদের দেশেে এখন অপরিহার্য। যে কোন নতুন ব্যবসা/সেবার শুরুতে একটু বিশৃঙ্খল পরিবেশ থাকে। এজন্য বাংলাদেশে শুরু হওয়া সুপারশপের ক্ষেত্রেও তা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস অল্প কয়েক বছরের মধ্য সুপারশপগুলো আরো পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাস্টমার সার্ভিস দেবে। অনিয়মগুলো দূর হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সঠিক নীতিমালা ও যথাযত নজরদারি। সুপার শপগুলোর মালিকদের আরো বেশি ক্রেতাবান্ধব মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। আইন করে মানুষকে ভাল করা যায় না। দরকার ব্যবসায়িক সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। সুপারশপের পরিধি যত বড় হবে মানুষের কর্মসংস্থানও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। এতে বেকারত্ব কমবে। দেশেের অর্থনীতিতে গতি আসবে।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:২৪