রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার কথাটি শুনলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে স্যুটেড-বুটেড, কোট-টাই পরা একজন ভদ্রলোকের অবয়ব। কোন কোন ক্ষেত্রে ভদ্র মহিলাও বটে। উনাদের প্রায় সবাই ইউরোপ আমেরিকার বাসিন্দা (অন্যদের এতো দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ে না) হলেও প্রতিবেশী দেশের হাই কমিশনারের দৌড়ঝাঁপ কোন কোন বিশেষ সময়ে লক্ষনীয়। উনারা আমাদের জ্ঞান দেন, দেশ পরিচালনার নসিহত করেন, গণতন্ত্রের সবক দেন। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নিজেদের ক্ষমতায় ঠিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উনাদের স্বরণাপন্ন হয়, মায়াবী কৃপাদৃষ্টি চায়। দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রানিক্স মিডিয়া এসব স্যারদের সুমধুর বাণী প্রচার করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কখনো লাইভ টিভিতে কভারেজ পর্যন্ত হন!
তাহলে এটাই একজন রাষ্ট্রদূতের বৈশিষ্ট বা কুটনৈতিক দায়িত্ব?
রাষ্ট্রদূত (Ambassador) একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবিশেষ, যিনি কোন নির্দিষ্ট দেশের সরকারের পক্ষ থেকে অন্য কোন স্বাধীন দেশ, সরকার কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কূটনৈতিক কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হন। একজন রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দেশের প্রতিনিধিত্ব করে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সম্পন্ন করেন। সাধারণতঃ তিনি নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষা কিংবা সমস্যা নিয়োগপ্রাপ্ত দেশের কাছে তুলে ধরেন এবং দ্বি-পক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বাস্তবায়নে সদা তৎপর থাকেন।
একজন রাষ্ট্রদূতের একমাত্র কাজ হলো তার নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করা, নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত দেশের সাথে দেন দরবার করা এবং উভয় দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিকিয়ে রাখা। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক বিপরীত চিত্র দেখতে পাই। এজন্য দায়ী মেরুদণ্ডহীন জাতীয় রাজনীতি এবং মিডিয়ার অতি চুলকানি মানসিকতা।
বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশের মোট ৪৯টি আবাসিক কূটনৈতিক মিশন আছে। তদুপরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কনস্যুলেট জেনারেল, ডেপুটি হাইকমিশন, অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশন ও বিভিন্ন ভিসা অফিস ধরনের ১১টি সাব-মিশনও রয়েছে। বাংলাদেশের কয়েকটি অনাবাসিক কূটনৈতিক মিশনও আছে যেগুলো সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস/হাইকমিশন দ্বারা পরিচালিত হয়।
বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত এবং এ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার অথবা মিশন প্রধানদের নিয়োগ প্রদান করেন সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাধারণত রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার পদে যোগ্য ব্যক্তির নাম সুপারিশ করে প্রধানমন্ত্রীর নিকট পাঠায় এবং তার অনুমোদনের পরই এ নিয়োগসমূহ চূড়ান্ত হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মিশন প্রধানের ৭০ ভাগ পেশাজীবী কূটনীতিকদের মধ্য থেকে এবং বাকি ৩০ ভাগ সরকার প্রধানের ইচ্ছানুযায়ী অকূটনীতিক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে নিম্নোক্ত কূটনৈতিক
পদমর্যাদার কর্মকর্তারা থাকেন -
-- রাষ্ট্রদূত (Ambassador), কমনওয়েলথভূক্ত দেশগুলোতে 'হাইকমিশনার' বলা হয়।
-- উপ রাষ্ট্রদূত (Deputy Ambassador), দূতাবাসগুলোতে 'মিনিস্টার' ডাকা হয়।
-- কাউন্সিলর (Counsellor)
-- সচিব (Secretary) [প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়; তিন জন সচিব থাকেন]
-- এ্যাটাশে (Attache)
-- এসিস্ট্যান্ট এ্যাটাশে (Assistant Attache)
কউন্সিলাররা উপসচিব পদমর্যাদার এবং সচিবরা সহকারী সচিব পদমর্যাদার হন।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ শহরে প্রচুর সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশীর বাস সেসব দেশের দূতাবাস/হাইকমিশন ছাড়াও উক্ত শহরগুলোতে, বিশেষত ব্যবসা ও কনস্যুলার সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার কনস্যুলার জেনারেল/ডেপুটি হাইকমিশন স্থাপন করে। সাধারণত এসব মিশনের প্রধান থাকেন সরকারের যুগ্মসচিব।
কোনো বন্ধুরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান এবং স্বাগতিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা স্বীকৃত হন। সেজন্য তিনি ওই দেশের সকল ঊর্ধ্বতন মহলে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ পান এবং উভয় দেশ ও সরকারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী থাকেন। বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান, সরকারি দলিলে স্বাক্ষর দান এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অন্যান্য চুক্তি স্বাক্ষর করার পূর্ণ ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়।
১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী তিনি ও অন্যান্য সকল কূটনীতিক ও অকূটনীতিক কর্মচারী পূর্ণ কূটনৈতিক স্বাধীনতা ও সুযোগ লাভ করেন। এ সুবিধা বাংলাদেশে নিযুক্ত সকল বিদেশি কূটনীতিকও পারস্পরিক ভিত্তিতে ভোগ করে থাকেন।
বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রদূতদের মাঝে প্রতিমন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবসহ সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত। কেউ বা সামরিক বা বেসামরিক চাকরি থেকে প্রেষণে আর সিংহভাগই পেশাদার কূটনীতিক বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের সদস্য। যে স্তরের কর্মকর্তাই হোন আর তার নিয়োগের উৎস যেটাই হোক, তিনি রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার। স্বাগতিক দেশটিতে তারা একই মর্যাদার স্তরে থাকেন। আর অতি উঁচু সেই মর্যাদা।
তাই এটা আশা করা যৌক্তিক, এত উঁচু মর্যাদায় যারা এক রাষ্ট্রে নিজ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তখন তারা নিজ রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বার্থ সদা সমুন্নত রাখবেন। হয়তো বা কেউ কেউ তা করছেনও। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে কেউ কেউ অবস্থান নিয়েছেন এর বিপরীতে। যেমন—আমাদের কয়েকজন রাষ্ট্রদূত তাঁদের কর্মস্থলে যে আচরণ করেছেন, তাতে মনে হয়, তারা তাদের উঁচু মর্যাদার পাশাপাশি নিজ দেশটির মর্যাদার কথা বিস্মৃত হয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই তারা আমাদের দেশ ও জনগণের মর্যাদাকে খাটো করেছেন ভিন দেশের মাটিতে। এমনিতেই আমাদের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি সারা বিশ্বেই বিরাজমান। এ দেশে ভালো কিছু ঘটলেও তার তেমন কোনো প্রচারণা নেই বাইরে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই মন্দ কিছু ঘটিয়ে এর নেতিবাচক ভাবমূর্তিকে জোরদার করি।
ভেবে ব্যথিত হই আর প্রশ্ন জাগে, ক্ষমতাসীন দলটিতে অনেক দক্ষ, যোগ্য ও সৎ লোক থাকা সত্ত্বেও এদের মতো লোককেই রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া কী খুব প্রয়োজনীয় ছিল? যাদের জ্ঞান ও নৈতিকতা এ স্তরের, তাঁদের এ ধরনের পদে নিয়োগ দিলে এসব জাতীয় আচরণকেই স্বাভাবিক বলতে হবে।
রাষ্ট্রদূতদের নিয়োগের উৎস যেটাই হোক, তারা আমাদের সমাজের অংশ। সুতরাং সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ তাদের উপরেও পড়বে, এটা বিস্ময়ের কথা না হলেও কিছু কথা থেকে যায়। প্রথমেই আলোচনা করা হয়েছে তাদের অতি উঁচু মর্যাদার বিষয়টি। পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত থাকাকালে বেতনের বাইরে তাদের যে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা ধনী রাষ্ট্রগুলোর অনুরূপ না হলেও আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের বিবেচনায় প্রভূত। আর তাদেরই যে সহকর্মী অন্য মন্ত্রণালয়ে কেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন, তার সঙ্গে বিবেচনা করলেও ঈর্ষণীয়। বেতনের বাইরে শুধু বিদেশ ভাতা নয়, আকর্ষণীয় হারে ভ্রমণভাতা, মোটা অঙ্কের টাকা ভাড়ায় সজ্জিত বাসভবন, আপ্যায়ন ভাতা, পরিবারের চিকিৎসার সব ব্যয়, চালক ও জ্বালানিসহ গাড়ি, সন্তানের পড়াশোনার খরচের একটি বড় অংশ ছাড়াও দুজন গৃহকর্মীর জন্য আন্তর্জাতিক হারে মজুরি পান।
অভিযোগ আছে, অনেক রাষ্ট্রদূত গৃহকর্মী হিসাবে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনকে দেশ থেকে নিয়ে যান। আবার কেউ কেউ প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে রাষ্ট্রদূতের মুচলেকা নিয়ে অন্য কাজ করেন!!
এক কথায় বলা চলে, নিছক অমিতব্যয়ী না হলে এ আর্থিক প্রণোদনা সচ্ছল জীবনযাপন ও কিছু সাশ্রয়ের জন্য যথেষ্ট। সুতরাং ভাবতে বেদনা হয়, দরিদ্র এ দেশটি এত কিছু যাদের জন্য করছে, তারা কেন দেশের সুনাম এভাবে নষ্ট করছে। তাহলে যথেষ্ট আর্থিক প্রণোদনা নেই বলে দুর্নীতি হয়—এ তত্ত্ব কি ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে? সমাজের মূল্যবোধের যে সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, তার ছাপ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে। অবশ্য এ সমাজেই ব্যতিক্রম আছেন অনেকেই সব ক্ষেত্রে।
এখানে উল্লেখ করা যথার্থ হবে যে শুধু রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা নয়, স্বাগতিক দেশে স্থাপিত আমাদের দূতাবাস ভবন ও আঙিনাও একটি খুদে বাংলাদেশ। শুধু আমাদের নয়, যেকোনো দেশের দূতাবাস যেখানে আছে, সে স্থানটিও একই মর্যাদা পায়। যে দেশে দূতাবাস রয়েছে সে দেশের আইন এর সীমানার মধ্যে কার্যকর নয়। অবশ্য সাম্প্রতিক বিশ্বে গুটিকয় ক্ষেত্রে এ মর্যাদাটি লঙ্ঘিত হয়েছে। যে পর্যায়েরই হোক, বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূতেরা তাদের বাড়ি ও গাড়িতে ওড়ান জাতীয় পতাকা। আর দূতাবাসে তো আছেই। তাহলে তারা এ ধরনের অনিয়ম করতে কি একবারও ভেবে দেখবেন না?
উঁচু পদ ও অতি উঁচু মর্যাদার পাশাপাশি পর্যাপ্ত সুবিধাদি একজন ব্যক্তির মধ্যে সন্তুষ্টি আনার কথা। অবশ্য আমাদের দেশে উঁচু পদে, উঁচু মর্যাদায় আর ব্যাপক সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয়েও অনেক হর্তাকর্তার মধ্যে সে সন্তুষ্টি আসছে না অনেক ক্ষেত্রেই। অনেক অনেক অভিযোগ প্রতি সরকারের সময়ে আছে এ ধরনের পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে। তেমন কোনো বিহিত হয় না পদ হারানোর পর সাময়িক কিছু বিড়ম্বনা ছাড়া। তবে আমাদের কূটনৈতিক সার্ভিসটি তো ঐতিহ্যগতভাবে এরূপ ছিল না। দু-একটি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া রাষ্ট্রদূত বা তার সহকর্মীরা দূতাবাসে কর্মরত থাকাকালে তাদের দ্বারা দেশের সম্মান সাধারণত বিপন্ন হয়নি এভাবে। ইদানীং তো মনে হচ্ছে, এখানেও পচন ধরেছে। অবশ্যই সম্মানজনক জীবনযাপনকারী অনেকে রয়েছেন।
বিদেশে কী আসলেই এসব রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় দেখাশুনা করেন? বাংলাদেশী নাগরিকদের সুরক্ষা দেন? প্রয়োজনীয় সেবা দেন? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জিজ্ঞেস করলে এর উত্তর পাওয়া যাবে। যতটুকু জানি যে সকল দেশে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বেশি সেসব দেশে বাংলাদেশ হাই কমিশনের ডিলেমি ও দুর্নীতি বেশি। শোনা যায় এসব দূতাবাসে আছে বিশাল সিন্ডিকেট ও দালাল চক্র। কোন কাজই ঘুষ ছাড়া সম্পাদন হয় না। এছাড়া সময়মতো সেবা না পাওয়ার হয়রানি তো আছেই।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪৪