ছোট বেলা একটি গল্পে পড়েছিলাম রসুলগঞ্জ নামক একটি বাজারে বিবিসি সামছু নামে এক ছেলে থাকতো। উল্লেখ্য যে, বাজারটি ছিল অত্র অঞ্চলের দশ-বারটি গ্রামের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাজার-সদাইয়ের একমাত্র হাট। সপ্তাহে শুক্র ও মঙ্গলবারে বড় হাট বসলেও বাকি দিনগুলোতেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের বাজার বসতো। এলাকাটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ ছিল, তবে বাজারের সাথে গ্রামগুলোর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা। অবশ্য শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে মানুষ চলাচল করতো। জেলা শহর থেকে এলাকাটি বেশি দূরে না হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় সাধারন মানুষকে সদরে যেতে আসতে অনেক কষ্ট পোহাতে হতো। বর্ষার দিনে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার নৌকা/স্টিমারে এবং শুকনো মওসুমে অনেকে পায়ে হেঁটি চলাচল করতেন। পাশাপাশি বাহন হিসাবে গরুর গাড়িও ছিল।। ভাটি অঞ্চল হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় এলাকাটিতে বন্যা থাকতো। বাইরের পৃথিবীর সাথে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল রেডিও। তবে মাঝে মাঝে রসুলগঞ্জে পত্রিকাও আসতো; তবে ছাপা হওয়ার এক-দুইদিন পর! বলা যায় রিমোট একটি এলাকা; যার সাথে বাইরের পৃথিবীর তেমন কোন যোগাযোগ নেই।
সামছু প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাজারের মধ্যখানে ছোট্ট একটি টুলের উপর দাঁড়িয়ে পত্রিকা ও রেডিওর খবরগুলো বক্তৃতার মতো করে প্রচার করতো। মানুষ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতো। এছাড়া এলাকার কোন হারানো সংবাদ, মিটিং-মিছিলের আপডেট প্রচার করতেও সামছুর ডাক পড়তো। এজন্য এলাকার লোকজন এক নামে তাকে 'বিবিস সামছু' বলে চিনতো। তবে বিবিসি কী? কেনই বা তার নামের সাথে বিশেষণটি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল তা অনেকের জানা ছিল না। আর জানবেই বা কেমন করে এলাকার শিক্ষার যে হাল তাতে না জানাটাই স্বাভাবিক। তখন গোটা এলাকায় মেট্রিক পাশ একজন মানুষও ছিল কি না বলা মুশকিল।
বাস্তবে হয়তো গল্পের বিবিসি সামছু বলে কেউ ছিল না। তবে লন্ডনের হাইড পার্কের মার্বেল আর্চ এলাকায় প্রতি রবিবার বিকালে এরকম বক্তৃতার আসর বসে। অনেক দর্শক সমাগম হয়। একটা সময় ছিল যখন আমাদের গ্রামে-গঞ্জে বিবিসি বাংলা সংবাদ বেশ জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য ছিল। পাশাপাশি ভয়েস অফ আমেরিকার সংবাদও মানুষ বেশ গুরুত্ব দিয়ে শুনতো। তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আগের সে দিন আর নেই। এখন দূরের অজো-পাড়াগায়েও ডিশ এন্টিনার ফলে মানুষ দেশি বিদেশি শত শত টিভি চ্যানেল দেখে অভ্যস্থ। এতো এতো চ্যানেলের মাঝে এখনো কিছু নিউজ চ্যানেল আছে যা সমান তালে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে বিশ্বব্যাপী টিকে আছে। বিবিসি নিউজ (ইংরেজি) নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা সংবাদ মাধ্যম।
বিবিসি- (Broadcasting House) নতুন হেড কোয়ার্টার
ছোটবেলা থেকেই বিবিসির প্রতি একটি প্রচন্ড টান অনুভব করতাম। বিদেশি সংবাদ মানেই মনে ভাসতো একমাত্র বিবিসির নাম। এজন্য বড় হওয়ার পর দিনে অন্তত একবার হলেও বিবিসি নিউজ টিভিতে দেখতাম।
লন্ডনে যাওয়ার পর অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার পাশাপাশি বিবিসি স্টুডিও দেখার জন্য খুব উদগ্রীব ছিলাম। তখন বিবিসি স্টুডিও ছিল ওয়েস্ট লন্ডনের হোয়াইট সিটিতে। আমি থাকতাম ইস্ট লন্ডনের ব্রমলি-বাই-বো-তে। ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখলাম হোয়াইট সিটি যেতে দু'টি বাস বদলাতে হবে। প্রথমে টুয়েন্টি ফাইভ বাসে (bus route 25) অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশনে নেমে নাইনটি ফোর (bus route 94) বাসে বিবিসি স্টুডিওতে পৌছিলাম। ভেতরে যাওয়ার কোন অনুমোদন না থাকায় বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বর্তমানে হোয়াইট সিটির স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এটি সেন্ট্রাল লন্ডনের বিখ্যাত অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশন ও রিজেন্ট স্ট্রিটের উত্তর পাশে নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। যা ব্রডকাস্টিং হাউজ নামে পরিচিত। প্রায় চার বছর এই এলাকায় কাজ করার সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই বিবিসি স্টুডিও বাইরে থেকে দেখতাম।
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (British Broadcasting Corporation) সংক্ষেপে বিবিসি; ১৯২২ সালের ১৮ই অক্টোবর জন হৃত বিবিসি প্রতিষ্টা করেন। এটি একটি পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টার। যার মালিক ব্রিটিশ জনগণ। এখানে সরকারের কোন অংশিদারিত্ব বা খবরদারী নেই। প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ব্রিটিশ মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। বিবিসি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন প্রচার মাধ্যম। এছাড়া কর্মী সংখ্যার দিক দিয়েও এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া কর্পোরেশন। রয়েল চার্টারের প্রতিষ্ঠিত বিবিসি ব্রিটিশ সরকাকারের তথ্য, সংস্কৃতি ও ক্রিড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। তবে তা সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত। একজন স্বাধীন চেয়ারম্যান, একজন ডিরেক্টর জেনারেল ও একজন ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল বিবিসির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন। সারা দেশের বার্ষিক টেলিভিন লাইসেন্স ফি দিয়ে বিবিসি চলে। সরকার থেকে কোন অনুদানের প্রয়োজন পড়ে না। লাইসেন্স ফি ব্রিটিশ সরকার নির্ধারণ করলেও পার্লামেন্টে আলোচনার মাধ্যমে লাইসেন্স ফি-র হার নির্ধারণ করা হয়। বিবিসি নিউজ, বিবিসি রেডিও, টিভি ও অনলাইন সার্ভিসও (আই প্লেয়ার) এর অন্তর্ভূক্ত। বর্তমানে পৃথিবী ব্যাপী ২৮টি ভাষায় বিবিসির কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
১৯৬০ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বিবিসি টেলিভিশন সেন্টার লন্ডনের হোয়াইট সিটিতে ছিল। পরবর্তীতে বিবিসি ব্রডকাস্টিং হাউজে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৩২ সালে ১৫ মার্চ বিবিসি রেডিও দিয়ে ব্রডকাস্টিং হাউজের যাত্রা শুরু হলেও ২০১২ সালে এটি সম্প্রসারণ করে বিবিসি হেড কোয়ার্টারে রুপান্তর করা হয়। সম্পূর্ণ গ্লাস ও স্টিলের তৈরী ইউ-শেপের (U) নতুন ভবনটি দেখতে খুব চমৎকার। এজন্য অনেকে এটিকে এখন নিউ ব্রডকাস্টিং হাউজও বলে থাকেন। লন্ডনের বাইরে যেমন- ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, কার্ডিফ ইত্যাদি বড় শহরগুলোতেও বিবিসির সম্প্রচার স্টেশন ও স্টুডিও আছে।
লন্ডনের হোয়াইট সিটির পুরাতন বিবিসি হেড কোয়ার্টার
পৃথিবী বিখ্যাত লন্ডনের বিবিসি হেড কোয়ার্টারে গেলে অবাক হতে হয়। এতো বিশাল মিডিয়া কর্পোরেশন কিন্তু নেই কোন বাড়াবাড়ি। নেই আলাদা দেয়াল ঘেরা নিরাপত্তা বলয় ও গেইট। শুধুমাত্র বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢোকার সময় আছে তল্লাসি চৌকি। তবে তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। যে কেউ চাইলে ভবনটি চারিপাশে অনায়াসে ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে। তবে ভেতরে প্রবেশের জন্য আলাদা পাস সংগ্রহ করতে হয়। সাইনবোর্ডে আমাদের মত বিশাল আকারে বিবিসির নাম ফলক নেই। প্রতিদিন শত শত মানুষ ভবনটিতে আসা যাওয়া করলেও নেই কোন জটলা, ঠেলাঠেলি ও শব্দ দূষণ। সবাই চুপিচুপি যার যার দায়িত্ব পালন করে। অন্যের জন্য কখনো নিজেরা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। অনেক মানুষ অসংখ্যবার বিবিসির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করেও জানে না এটা বিবিসি স্টুডিও। অথচ সারা পৃথিবীর মানুষ বিবিসির নাম শুনলে এক নামে চেনে।
ব্রিটিশরা আমাদের মতো প্রচার সর্বস্ব নয়। আমাদের মতো সরকারী নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে নেই বিশাল নেইম ফলক, উঁচু প্রাচীর ও গেইট। কোন কোন ক্ষেত্রে নাম থাকলেও তা বেশিরভাগ সময় চোখে পড়ে না। যেমন আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল হেড কোয়ার্টের সামনে বিশাল সাইনবোর্ড ও নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি দেখলে সহজে পাবলিক বুঝতে পারে এটা বাংলাদেশ ব্যাংক। অবাকের বিষয় ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবনের চতুর্দিক ঘুরলেও আপনি কোন সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন না। নেই কোন সীমানা প্রাচীর ও বাড়তি নিরাপত্তা। ভবনটিতে ঢোকার জন্য আছে ছোট একটি দরজা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রেনিং সেন্টার, আমেরিকান এম্বেসি, রাশিয়ান এম্বেসি, চায়নিজ এম্বেসি, সৌদি এম্বেসি ও ইরান এম্বেসি ছাড়া কোথাও অস্ত্রধারী সিকিউরিটি আমার চোখে পড়েনি। তবে রাস্তায় টহল পুলিশ প্রয়োজনে হেভি গান ব্যবহার করে। আরেকটি কথা ইংল্যান্ডে ব্যক্তিগত অস্ত্র ব্যবহারের লাইসেন্স দেওয়া হয় না। এজন্য পালিকের কাছে কোন আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না।
বিবিসির নিউজ টিম পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ সংবাদ কর্মী হিসাবে পরিচিত। এসব কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে বিবিসি প্রতি বছর প্রশিক্ষণ খাতে প্রচুর টাকা খরছ করে। পাশাপাশি বিশ্বের অনেক নামকরা নিউজ চ্যানেলের কর্মীদেরও তারা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। বিবিসির ডকুমেন্টারিগুলো বিশ্বব্যাপী খুব জনপ্রিয়।
আমাদের বিটিভির কথা মনে হলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরছ করলেও চ্যানেলটির উন্নতির দৃশ্যমান কোন লক্ষণ নেই। গ্রামের মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বিটিভি হলেও সম্প্রচার মান অত্যন্ত খারাপ। বাড়তি এন্টেনা লাগিয়েও চ্যানেলের খোঁজ মেলে না। তার উপর নিম্মমানের সংবাদ ও অনুষ্ঠান পরিবেশনা। নেই দক্ষ লোকবল ও পেশাদারিত্ব। বিটিভি দেখলে মনে হয় এখনো পঞ্চাশ বছর আগের প্রযুক্তি ও নির্মাণ শৈলির অনুষ্ঠান দেখছি। অথচ গরীব মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় চলা বিটিভির সবচেয়ে ফোকাসের জায়গা হওয়ার কথা ছিল গ্রামীণ জনগোষ্টি। শহরের মানুষ ভূলেও বিটিভি দেখে না। একমাত্র ইত্যাদি সম্প্রচারের সময় বিটিভির পর্দা অনেকে ওপেন করে থাকেন। বিটিভি চট্টগ্রাম ও সংসদ টিভি তো বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। চ্যানেল দু'টি যখন বন্ধ থাকে তখন এমন ঝাঁঝালো শব্দ হয় যে, কান দু'টি বন্ধ করেও রেহাই মিলে না।।
বিবিসি হেড কোয়ার্টার (ছবিটা আমার তোলা)
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৮ দুপুর ২:৪৬