২০১৩ সালের ১৪ই আগস্ট পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান এবং স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে খুণ করে তাদের একমাত্র মেয়ে ঐশী। ইয়াবা আসক্ত ঐশীর বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর! শোনা যায় তার ইয়াবা আসক্তি ১৪ বছর বয়স থেকেই। বাবা মায়ের উদাসীনতা, উশৃঙ্খল জীবন যাপন, মাদকসেবী বন্ধু-বান্ধব, ডিজে পার্টি আর অর্থের সহজলভ্যতা তাকে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। পরিণামে হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর খুণি। সময় সুযোগ বুঝে বাবা-মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। জানা যায় ঐদিন রাতে কফির সাথে ৬০টি ঘুমের বড়ি মিশিয়ে প্রথমে তাদেরকে অজ্ঞান করে, পরে গলায় ও বুকে ছুরি চালিয়ে খুণ করে।
সম্প্রতি দেশে মাদকের ব্যবহার বেড়েছে আশংকাজনক হারে। শুধু শহরের উচ্চবিত্ত নয়, গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেডিন সহ নানা নেশা জাতীয় দ্রব্য। মাদকের বিষাক্ত শক্তি শেষ করে দিচ্ছে শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের কারণে পরিবার ও সমাজে বিপর্যয় নেমে আসছে। বেড়েছে খুণ, ধর্ষণ, ছিনতাই সহ নানা অপরাধ। ধনী-দরিদ্র উভয় পরিবারের কিশোর-কিশোরী, বিশেষ করে তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যথাযত উদ্যোগের অভাবে মাদকসেবীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
ভৌগলিকভাবে আমরা ভারত ও মায়ানমারের প্রতিবেশী হওয়ায় এবং দেশ দু'টিতে মাদক উৎপাদন হওয়ায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ইয়াবা মায়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসে। ফেন্সিডল আসে ভারত থেকে। একটা সময় হেরোইন ও ফেন্সিডিলে দেশ সয়লাব হলেও এখন ইয়াবার দাপট সর্বত্র। চাহিদাও ব্যাপক।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মাদকের নাটের গুরু ধুমপান। মাদক সেবীদের ৯৮% জনই ধুমপায়ী। এদের মধ্যে প্রায় ৪৪% সন্ত্রাসী। একটা উল্লেখযোগ্য সংখক শিক্ষিত বেকার, হতাশাগ্রস্ত তরুণ ও যুবক। উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক মেয়ে এখন মাদকাসক্ত, বিশেষ করে ইয়াবায়। একজন ইয়াবাসেবী নিজের পরিবার, অফিস ও সমাজের সবাইকে অস্বস্তিতে রাখে। তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, ফলে সবার সাথে রূঢ় আচরণ করে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনা-বেচা হয়। যার উল্লেখযোগ্য অংশই ইয়াবা। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বর্তমানে দেশে প্রায় ৮০ লাখ মাদক সেবী এবং কয়েক লাখ মাদক বিক্রেতা আছে। মাদক সেবীদের গড় বয়স ১৫-২৯ বছর। অভিযোগ আছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনও মাদক পরিবহণে জড়িত। পত্রিকায় দেখলাম কিছুদিন আগে একজন পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িতে ৩০ লাখ টাকার ইয়াবা টেবলেট পাওয়া গেছে!
আমরা একটি পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। জিরো ফিগারের জন্য অনেক নারী মাদক বেছে নেন। এজন্য অনেক মেয়ে মাদকের টাকা জোগাড় করতে পতিতাবৃত্তি করেন। পরিবারকে জিম্মি করে টাকা নেন। ছেলেরা চুরি, ছিনতাই সহ মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ে। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশ ও প্রশাসনের একটি অংশের যোগসাজশে চলে অবৈধ মাদকের কারবার।
টেকনাফকে এখন বলা হয় ইয়াবা গেট বা ইয়াবা নগরী। টেকনাফের ১৩৩টি গ্রামের মধ্যে প্রায় ১০০টি গ্রামের লোকজন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। সেখানের অর্থনীতির ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে ইয়াবা। প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি পিস ইয়াবা টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। টেকনাফের যুব সমাজের অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসায়ী। টেকনাফের স্থানীয় ৯০ জন জনপ্রতিনিধি (মেম্বার/চেয়ারম্যান) নিয়ে যে ইয়াবা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয় তার ৮০ জনই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত!
আমাদের মস্তিষ্কে একটি জায়গা আছে যেখানে ভাল লাগা, খারাপ লাগার তীব্র অনুভূতির সাড়া দেয়। যদি কোনভাবে মস্তিষ্কের বিশেষ এ জায়গাটি উদ্দীপ্ত করতে পারি তাহলে আমরা আনন্দিত হই। মাদকের ভয়াবহ সেই ক্ষমতা আছে। প্রথম প্রথম মানুষ সখ করে মাদক নেয়, পরে যখন আসক্তি আসে তখন মাদক নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। ভীষণ যন্ত্রণায় ভোগে। সেই যন্ত্রণা থামাতেই আবার মাদক নিতে হয়। মাদক মানুষের মেধা, মনন ও শারীরিক শক্তি উজাড় করে নেয়।
মাদকসক্তরা তাদের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি ও মানবিক মূল্যবোধকে হারিয়ে হয়ে উঠে বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল এক অস্বাভাবিক ব্যক্তি। এতে শুধু তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন হয় না, গোটা পরিবার ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণের কারণে দেশে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
মাদকাশক্তি ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ৬০০ বিলিওন ডলারের মাদক ব্যবসা হয়। এই ব্যবসার ফলে বিশ্বে প্রতিবছর বৈধ অর্থনীতির ক্ষতি প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার! পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যাদের অর্থনীতির সিংহভাগই ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত করণ ও পাচারের উপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর বাংলাদেশে অবৈধ ও নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্যের পেছনে খরছ হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে সংঘটিত অপরাধের ৭০% কোন না কোন ভাবে মাদকের সাথে জড়িত।
আফগানিস্তান হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী অবৈধ মাদক উৎপাদনকারী দেশ। তারপর যথাক্রমে আসে কলম্বিয়া, পেরু, মেক্সিকো, বলিভিয়া, মায়ানমার, মরোক্ক ও লাওসের নাম। অফিম ও ক্যানাবিজ উৎপাদনে আফগানিস্তান পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে মূলত কোকেইন উৎপাদন করা হয়। মায়ানমার বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অফিম উৎপাদনকারী দেশ। অফিম থেকে তৈরী হয় হেরোইন। মায়ামারে বর্তমানে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে অফিম উৎপাদিত হয়। ইরানের মানুষ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মাদকাসক্ত (১৫%)। মূলত এরা হেরোইনসেবী।
আমেরিকার টেক্সাস, এরিজোনা ও ক্যালিফোরনিয়া সীমান্ত দিয়ে প্রতিবছর শত শত টন অবৈধ মাদক মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। এটি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম মাদক চোরাচালান রুট। যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো সীমান্তে ওয়াল নির্মাণ করতে চায় মূলত মাদক ও অবৈধ প্রবেশাধিকার ঠেকানোর জন্য। তবে চোরাচালানীরা ওয়াল ডিঙিয়ে, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যবসা অব্যাহত রাখছে।
লন্ডনে দেখেছি আইনের এতো কড়াকড়ির পরও অবৈধ মাদক পেতে মাদকসেবীদের তেমন বেগ পেতে হয় না। সর্বত্রই মাদক কেনা বেচা হয়। অবৈধ মাদক দ্রব্য বিক্রি ও পরিবহণে সরকারের অবস্থান কঠোর হলেও আইন সে অনুপাতে কঠোর নয়। অপরাধীরা সহজেই জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন লন্ডন ওয়েস্ট এন্ডে হাজার হাজার পাউন্ডের মাদক কেনাবেচা হয়। এসব মাদকের ক্রেতা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ও টুরিস্ট। পাকিস্তানীরা মূলত এ ব্যবসার মূল হোতা।
পশ্চিমা দেশগুলোতে বিয়ার, মদ, স্পিরিট ইত্যাদি বিক্রি ও বিপনন বৈধ। এজন্য পানির দামে সেখানে বিয়ার পাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষজন পানির পরিবর্তে বিয়ার পান করে। এগুলো মানুষকে চাঙা রাখে, শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচায়। তবে অতিরিক্ত মধ্যপানের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আছে শত শত মাদক নিরাময় কেন্দ্র। তারপরও অসংখ্য মাদকসেবী মারা যায়।
ইসলামী দেশ এবং মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে মদ, বিয়ার বিক্রয় ও বিতরণ আইনত দন্ডনীয়। এজন্য এসব দেশে কয়েকগুণ বেশী দামে চোরাই পথে এগুলো বিক্রি হয়। বিশ্বায়নের এ যুগে ইসলামী দেশগুলোর মানুষের চিন্তা চেতনা ও অভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে মানুষ মদের নেশায় বুদ হচ্ছে।
প্যারিস, লন্ডন ও আমস্টারডামে দেখছি গালফ কান্ট্রির অধিকাংশ দেশের পুরুষরা বারে বসে মদ/বিয়ার পান করে। এক্ষেত্রে সৌদি, আমিরাত, কুয়েত ও কাতার সবচেয়ে এগিয়ে। একদিন সৌদি রাজপরিবারের একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- তোমাদের দেশে মদ পান করা তো আইনত দন্ডনীয়। জবাবে বল্ল, আইনগুলো সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য। রাজপরিবার, শেখ পরিবার ও ধনী পরিবারগুলোতে দেদারসে মদ চলে। বেশিরভাগ পরিবারেই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ব্রান্ডের মদ থাকে!
নাইট ক্লাব, পাব ও স্ট্রিপ ক্লাবে (উলঙ্গ সুন্দরী মেয়েদর ডান্স ক্লাব) সবচেয়ে বড় কাস্টমার আরব ধনীর দুলালরা। এখানে সারা রাত চলে মদ আর ন্যাংটা ডান্সের নৃত্য। আরবরা সেখানে টাকা উড়ায় দেদারসে। আরব অনেক মেয়েরাও নিয়মিত এসব ক্লাবে যায়।
মূলত ইসলামী দেশগুলোতে আইনের কড়াকড়ি থাকায় নিজ দেশে তারা এগুলো করতে পারে না। মানুষ যখন ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে চলে যায়, মন মানসিকতায় পশ্চিমা দেশগুলোর মত আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়। ধর্মীয় অনুশাসন ঠিকমতো মানে না তখন বেপরোয়া হয়ে উঠে। আরবদের বেলায়ও তাই হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম প্রদান দেশের ধনী ও আধুনিক নাগরিকরা পশ্চিমা দেশগুলোতে গিয়ে এভাবে এনজয় করে।
মাদকের অপব্যাবহার থেকে হয় অভ্যাস, আর অভ্যাস থেকে হয় আসক্তি। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪% পুরুষ এবং ১৬% নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররা মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িত। এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানা ভাবে মাদক ব্যবসায় জড়িত। এদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫%। প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশী টাকা মাদকের নামে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়।
আমাদের দেশে মাদক একটি দুষ্ট চক্রে আবর্তিত। চক্রটি এরকম "রাজনীতি-বেকারত্ব-সহজলভ্যতা-প্রশাসন-বিচার ব্যবস্থা"। মাদকের ব্যাপক আগ্রাসনে এই টোটাল চক্রটি দায়ী। আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মাদকের রমরমা ব্যবসা হয়, টাকা দিয়ে প্রশাসন ম্যানেজ করে চলে মাদকের অবাধ প্রবেশ। এছাড়া সীমাহীন বেকারত্ব, হতাশা, পারিবারিক অবহেলা ও সামাজিক অবক্ষয় মাদকের সহজলভ্যতার জন্য দায়ী। মাদকের ব্যবহার এক্কের বন্ধ করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে সীমান্তে কড়া নজরদারী, মাদকের উৎস নির্মূল, মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরী এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সচেতনতা মাদক নির্মুলে সবচেয়ে দরকারী পদক্ষেপ।।
তথ্য সূত্র-
প্রথম আলো- ১৮ আগস্ট, ২০১৩।
insidermonkey.com - ২৬ এপ্রিল, ২০১৬।
ekushey-tv.com - ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮।
bd-pratidin.com - ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
blvdcenters.org - ৩ মে, ২০১৬।
edition.cnn.com - ২১ মার্চ, ২০১৮।
bbc.com - ২১ এপ্রিল, ২০১৬।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:০০