somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

কাওসার চৌধুরী
জন্মসূত্রে মানব গোত্রভূক্ত; এজন্য প্রতিনিয়ত 'মানুষ' হওয়ার প্রচেষ্টা। 'কাকতাড়ুয়ার ভাস্কর্য', 'বায়স্কোপ', 'পুতুলনাচ' এবং অনুবাদ গল্পের 'নেকলেস' বইয়ের কারিগর।

তেলাপোকার বৃষ্টিবিলাস (গল্প)

০২ রা জুন, ২০১৮ দুপুর ২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
"মানুষের অভ্যাস-রূচি, শিল্প-সংস্কৃতি, জানা-শুনা আর অনুকরণের বাতিক থেকেই সামাজিক পরিবর্তনটা তরান্বিত হয়। এক্ষেত্র নির্দিষ্ট কোন ভাষার প্রভাব অন্যতম নিয়ামক হয়। মানুষের সামাজিক-সংস্কৃতিক পরিবর্তনে অনেক সময় অতিরিক্ত বিদেশি ভাষা প্রীতির ফলে তাদের কালচার আমদানি/অনুকরণ করা হয় বাছ-বিচার না করেই। অনেক সময় তা স্থানীয় সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।"

ফেইসবুকের একটা স্টেটাসে কথাগুলো পড়ে ভাবনায় পড়লেন শরৎ বাবু। কিন্তু এত কঠিন বিষয় ভাবনার সময় কই? বাসায় ফিরেই তাড়াহুড়ো করে সারাদিনের ধুলো-বালির সাথে ক্লান্তি আর পার্টিতে যাওয়ার শিডিউল মেলাতে সোজা শাওয়ার করতে ছুট।

এই.... শুনছো.....
কি হলো? কথা বলছো না কেন? শুনছো?
পুরুষ মানুষের শাওয়ার করতে এতো সময় লাগে? তাড়াতাড়ি বের হও। মানুষটার সব কিছুতেই ডিলামি। এতবার বল্লাম রাতে ঋতুর পার্টিতে যাব একটু আরলি অফিস থেকে আসবে। না, কে শুনে কার কথা। আজো দেরী; মানুষটারে নিয়ে আর পারি না। কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে আর পায়চারি করছে বৈশাখী।
-- আসছি, আসছি। এত অধৈর্য হচ্ছ কেন? এখনো ঘন্টাখানেক বাকি আছে।
বাথরুমে শাওয়ার করতে করতে উত্তর দিল শরৎ।
-- ঘন্টা? রেডি হতেই তো তোমার দু'ঘন্টা চলে যাবে।
-- আরে না জাস্ট পাঁচ মিনিট।
-- পাঁচ মিনিট!
শাওয়ারের ঝমঝম শব্দ আর সিলিং ফ্যানের খট খট আওয়াজে শরৎ শেখরের বাকি কথাগুলো ঠিকমত শুনতে পেলনা বৈশাখী।

শরৎ গোসল পর্ব শেষ করে শরীর ভালভাবে মূছে একটি বড় সাদা তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে বের হতেই সাদা সার্ট, স্যুট, প্যান্ট ও টাই এগিয়ে দিয়ে বৈশাখি তাড়া দিল, তাড়াতাড়ি পরে নাও। সময় বেশী বাকি নেই। কে জানে রাস্তায় যানজট কেমন?
-- শৌমিক শাওয়ার করেছে?
চার বছরের একমাত্র ছেলে শৌমিককে লক্ষ্য করে শরৎ জানতে চাইল।
-- তোমার ছেলে শাওয়ার করবে? সেই বিকাল থেকে স্যুট-টাই পরে বসে আছে আর একটু পরপর আমাকে তাড়া দিচ্ছে। তার এক কথা-
"মা, বাবুই আচ্ছে না কেন? কখন যাব বেড়াতে? বাবুইকে একটা ফোন দাও।"

কোন কথা না বাড়িয়ে ঝটপট রেডি হতে লাগল শরৎ। শৌমিক চুলের জেলের ডিব্বাটি বাবাকে এগিয়ে দিয়ে বললো- বাবুই আমাকে মাখিয়ে দাও। বাবার দেখাদেখি ছেলেটাও চুল স্পাইক করা শিখেছে। মাঝে মাঝে চুলের পাশাপাশি সারা শরীরও জেলময় করে তোলে শৌমিক। তার কাছে ক্রিম/লোশন মাখা আর জেল মাখা একই।
-- ছেলেটা একদম তোমার মত হয়েছে। সারা সন্ধ্যা থেকে এত করে বুঝালাম কিন্তু না গোসল করবে না। তার এক কথা, মা আমার শীত লাগছে। পেটে হাত দিয়ে দেখো, জ্বর উঠছে আম্মু!! এই কাঠফাটা রোদেও তার নাকি ঠান্ড লাগে! অন্যদিন তো বাথটাব থেকে নামিয়ে আনাই মুশকিল হয়।
-- তাই বলে পেটে জ্বর!! ছেলেটা আমার ভীষণ পাজি!!!
খিল খিল করে হাসতে হাসতে বললো, শরৎ।
-- বাদ দাও। ছেলে মানুষ।

বৈশাখী আজ মনের মত করে সেজেছে। বিকালে পার্লার থেকে চুল স্ট্রেইট করে এসেছে। মুখে দামী মেকাপ দিয়েছে। সাথে মেনি কিউর, পেডি কিউর, আরো কত কী........। ভ্রু-টাও প্লাক করেছে আজ। বরাবরই শাড়িতে খুব সুন্দর দেখায় বৈশাখীকে, তবে আজকের কড়া সাজটা সেই রকম স্পেশাল হয়েছে, একদম ফাটাফাটি রকমের সুন্দরী। বৈশাখী ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মত মেকআপটা চেক করছে আর চুলের খোঁপায় ও শাড়িতে ক্লীপ/পিন লাগাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হলো বডি স্প্রে-টা দেওয়া হয়নি। সেল্ফ থেকে এম্পোরিও আরমানির সেন্টের বোতলটি বের করে গলায় ও হাতে স্প্রে করলো, পাশাপাশি হাজবেন্ড ও ছেলেকে দিল।

-- তোমার সাজুগুজু এখনো চলছে?
নিজে ঝটপট রেডি হয়ে এবার বউকে তাড়া দিল শরৎ। সাথে যোগ করলো সেই বিকাল থেকে শুরু করেছ ঘসামাঝা যা এখনো চলছে! আর সুযোগ পেলেই দোষ খোঁজ আমার, তাই না? সব দোষ নন্দ ঘোষ।
-- শেষ। তুমি ছেলেকে নিয়ে নীচে গাড়িতে উঠ। এক্ষুনি আসছি......


২.
বনানীর পাঁচ তারকা ওয়েস্টিন হোটেলে বিশাল পার্টি, রাজকীয় আয়োজন। দেশের নামকরা চলচ্চিত্র-টেলিভিশন শিল্পী, পরিচালক-প্রযোজক, মডেল-নৃত্য শিল্পী, ফ্যাশন ডিজাইনার, নামকরা ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ কে নেই তাতে? একে একে সবাই আসছেন, কুশল বিনিময় করছেন। কেমন যেন বিদেশ বিদেশ ভাব। লাউড স্পিকারে মারিয়া ক্যারির "অলোয়েজ বি মাই বেবি" গানটি বাজছে-

উই ওয়ার এজ ওয়ান, বেবি ফর এ
মোমেন্ট ইন টাইম এন্ড ইট, সিমড্
এভার লাস্টিং দ্যাট ইউ উড অলোয়েজ
বি মাইন, নাও ইউ ওয়ান্ট টু বি ফ্রি।
সো আই উইল লেট ইউ ফ্লাই
কজ আই নো ইন মাই হার্ট
বেবি আওয়ার লাভ উইল নেভার এন্ড।

গানের তালে তালে কয়েকজন সুন্দরী ললনা নাচছে। লিপসিং করছে। সামনে দর্শক সারিতে বসা কিছু ইয়াং ছেলেমেয়েও গানের সাথে দোল খাচ্ছে। ঢলাঢলি করছে।

এত বিশাল আয়োজন দেখে বৈশাখী খুব অবাক হলো। পাঁচতারকা মানের হোটেলের এমন আয়োজনে আগে কোনদিন আসেনি সে। একদম সিড়ি থেকে হরেক রকম কাঁচা ফুল আর বিভিন্ন রঙের বেলুন দিয়ে সাজানো প্রবেশদ্বারটি। এছাড়া পুরো সিঁড়িটাই লাল কার্পেটে মোড়া, পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত। ভেতরে তো আরো রাজকীয় কারবার। বিশাল বড় হলরুম, দেখতে অনেকটা বলিউডের সিনেমায় দেখা বিয়েবাড়ির মতো সাজানো, পরিপাটি। স্টেজের পেছনে বড় বড় অক্ষর দিয়ে ডিজিটাল ব্যানারে লেখা

"আজ ঋতুর বেবি শাওয়ার"

সামনে সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো একটি টেবিলে হরেক রকম বিদেশী চকলেট সাজিয়ে রাখা। পুরো টেবিলটি ফুল দিয়ে সাজানো। আছে একটি বিশাল সাইজের কেক। কেকটি একটি সুদৃশ্য পুতুলের আকারে ডিজাইন করা।

আজ বৈশাখীর স্কুল জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বান্ধবী ঋতুর বেবি শাওয়ারের অনুষ্ঠান। দেড় বছর হলো বিয়ে হয়েছে তার। ঋতু বর্তমানে দেশের সবচেয়ে নামকরা মডেল, পাশাপাশি হার্টথ্রুব নায়িকা। ইদানিং কলকাতার ছবিতেও তার বেশ নামডাক আছে।
-- ওয়েলকাম, মাই ডিয়ারেস্ট ওয়াইফি।
বৈশাখিকে দেখে জড়িয়ে ধরে দুই গালে উ.... আ... করে গাল মেশাতে মেশাতে বল্ল ঋতু। বৈশাখীকে আদর করে ঋতু তাকে 'ওয়াইফি' বলে ডাকে।
-- হুম। নাইস টু সি ইউ, দোস্ত। অনেক দিন পর দেখলাম তোকে।
পেটের দিকে ইশারা করে একটু মুচকি হাসি দিয়ে আবারো জানতে চাইলো, বেবিটা কেমন আছে?
-- আর বলিস না, মনে হয় খুব দুষ্ট হবে। এখন থেকেই খুব জালাচ্ছে সোনাটা, খু-উ-ব!!
কথাটি বলেই ফিক করে একটি রহস্যময় হাঁসি দিল ঋতু।
-- হুম। কয় সপ্তাহ হলো?
জানতে চাইল, বৈশাখী।
-- থারটি ফোর।

ঋতু আজ কালো টাইট লেগিন্সের সাথে পাঞ্জাবীর মতো হাঁতকাটা ঢিলেঢালা লাল রঙের একটি ফতুয়া পরেছে। গোল্ডেন কালারের হাই হিল জুতাটাও বেশ মানানসই। পেটের ঠিক উপরে জামাটি ইলাস্টিক দিয়ে আটকানো, তবে নীচের দিকে তা হাঁটু পর্যন্ত ছড়ানো। টাইট লেগিন্সের সাথে টাইট ফতুয়া তার ভারী নিতম্বকে আগুনের তৈরী ডিম্বাকৃতির বম্ব বানিয়ে দিয়েছে। বৈশাখী লক্ষ করলো, বেবি বাম্পটা বাস্তবের তুলনায় একটু বেশিই বড়; পেটের ঠিক উপরে ইলাস্টিক দিয়ে আটকানো বলে হয়তো এমনটা মনে হচ্ছে। প্রেগনেন্ট হলে কী হবে? শারিরিক সৌন্দর্য একটুও ভাটা পড়েনি ঋতুর। পেটের উপর ফতুয়ার মাঝে একটি নাদুস-নুদুস বেবি বাচ্চার ছবি আঁকা। ব্যাপারটি বৈশাখীর কাছে দৃষ্টিকটু লাগলো, তবে ঋতুকে বুঝতে দিল না। দেখে মনে হচ্ছে বেবিটা সবাইকে বলছে -

"ওয়েলকাম টু বেবি শাওয়ার"।

শরৎ শেখর মিসেস ঋতু ও তার স্বামী নামকরা শিল্পপতি মামুন ইশফাকের সাথে সৌজন্যতা বিনিময় করে ছেলেকে নিয়ে কোনার দিকে একটি চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো। স্ত্রী তখনো ঋতুর সাথে খোশগল্পে মত্ত।
বৈশাখী এদিক ওদিক চাওয়া-চাওয়ি করে স্বামী-সন্তানকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বল্ল-
-- ড্রাইভারকে বল গিফটি উপরে নিয়ে আসতে।
-- আসার সময় তো বলে এসেছি। হয়তো পার্কিং পেতে সময় লাগছে।
উত্তর দিল শরৎ। এখনই আসবে।

বান্ধবীর প্রথম বেবি শাওয়ারের গিফট কিনতে গত কয়েকদিন বৈশাখী ঢাকার নামকরা সব শপিং মল ঘুরেছে। শেষমেষে একটি বেবি ওয়াকার, এক বক্স ডায়াপার, কয়েকটি বিদেশী চকলেট প্যাক আর বান্ধবী ও তার স্বামীর জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনেছে।

গিফটগুলো হস্তান্তর করতে গিয়ে বৈশাখী লক্ষ্য করলো গিফটের তালিকা তো বিশাল। কি নেই তাতে? বিভিন্ন রঙের টেডি বিয়ার, হরেক রকম পুতুল, বেবি ক্লথ, ডায়াপার ব্যাগ, বেবি ক্যারিয়ার, এক্টিবিটি ম্যাট, বিদেশি শিশু খাদ্য, বাচ্চাদের কমিক্স বই, মাউস বাস্কেট................. ইত্যাদিতে হলরুমের একটি কর্ণার ঠাসা। বাহ! সেলেব্রেটি বলে কথা!!

একটু পরে শুরু হলো হিন্দি পপ গানের তালে তরুনীদের নাচা-গানার পালা। গানের তালে দশ-বারোজন স্বল্প বসনা তরুনী শুরু করলো উদ্দাম নৃত্য। উপস্থিত অনেকেই এতে বিনোদিত হলেও যারা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন তারা একটু বিব্রতকর পরিস্থতিতে পড়লেন। বিশেষ করে মায়েরা।

-- মাম্মী, বেবি শাওয়ার কখন হবে?
মায়ের কোলে বসা শৌমিক চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলো।
-- এই তো চলছে বাবা।
-- না না মাম্মী, বে-বি শা-ও-য়া-র। এখন বুঝতে পেরেছ?
সাথে যোগ করলো-
-- আমি সারাদিন শাওয়ার করিনি এখানে অনেক বাচ্চার সাথে শাওয়ার করবো বলে। বলো না মাম্মী কখন শুরু হবে? আমার ঘুম পাচ্ছে।

ছেলের কথা শুনে থো বনে গেল বৈশাখী। কি বলছে ছেলে? মনে পড়লো সকালে শরৎ অফিসে যাওয়ার সময় বারবার তাড়া দিয়েছিল, আজ সন্ধ্যায় ঋতুর বেবি শাওয়ার তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসবে। এছাড়া দিনের বেলা দুইবার ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছে সে। ছেলেটি তার কথাটি হয়তো মনযোগ দিয়ে শুনেছে। এজন্য অনেক চেষ্টা করেও গোসল করাতে পারিনি। এখানে আসার জন্য বিকাল থেকে রেডি হয়ে বসেছিল। তাহলে ঘটনা এই!!


৩.
খাওয়া-দাওয়া, আচার-অনুষ্টান শেষ হতে হতেই রাত সাড়ে বারোটা বেঁজে গেল। বেচারা শৌমিক ততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আকাশে মেঘের গর্জনও শুনা যাচ্ছে। শরৎ শেখর বউকে তাড়া দিল-
-- জলদি বের হও, আকাশের অবস্থা ভালো না।

গাড়িতে বসে বৈশাখী জানতে চাইলো-
-- এবার এত আরলি বৈশাখী আবহটা চলে এসেছে। মনে হচ্ছে কালবৈশাখী আসন্ন।
-- আসন্ন মানে? আজ চৈত্র মাসের কয় তারিখ মনে আছে?
বউয়ের কাছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো শরৎ।
-- কি যে বলো না তুমি, এত তাড়াতাড়ি চৈত্র মাস এস গেল?
-- জি, ম্যাডাম। আজ চৈত্র মাসের একুশ তারিখ। আর দশদিন পর পহেলা বৈশাখ। নিজের জন্মদিনটি ভুলে গেলে?

পহেলা বৈশাখে জন্মেছিল বলে বাবা আদর করে তার নামটি রেখেছিলেন বৈশাখী। ঘটা করে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় বলে জন্মদিনটি তার মনে থাকে। তবে বাকি সারা বছর বাংলা মাস/ঋতুর আর কোন খবর থাকে না। এমনকি বৈশাখী বাংলা মাসের নামগুলোও ঠিকমতো বলতে পারবে কিনা সন্দেহ।

তবে শরৎ শেখরের জন্ম কিন্তু শরৎকালে হয়নি। হয়তো নামটি বাবা মায়ের পছন্দ ছিল। অথবা শরৎচন্দ্র তাদের প্রিয় লেখক ছিলেন বলে ছেলের নামটি শরৎ রেখেছিলেন। আবার অন্য কোন কারণও হতে পারে। জানা নেই শরৎ বাবুর।

মধ্যরাতের যানজটমুক্ত ফাঁকা রাস্তা খুব প্রিয় ঋতুর। শৌমিকের জন্মের পর রাতের ঢাকা ভ্রমণ কিছুটা কমে গেলেও মাঝে মাঝে ছেলেকে কোলে নিয়ে তিনজন বের হয়। ঢাকা শহরের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বাঁচতে এই নিশি ভ্রমণ তাদের কিছুটা হলেও মুক্তি দেয়। কখনো ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে লং ড্রাইভ। কখনো বা ঢাকার অলিগলি, অভিজাত এলাকায়।
-- এ্যাই শুনছো, তাড়াতাড়ি চালাও। মেঘের কি গর্জনরে বাবা। শৌমিক জেগে উঠলে ভীষণ ভয় পাবে। ঝড়তুফান যেকোন সময় চলে আসবে।
লোডশেডিংয়ে অন্ধকার রাস্তায় ভড়কে গিয়ে ঋতু শরৎকে তাড়া দিল।
-- আজ আয়োজনটা কিন্তু জব্বর ছিল; কি বলো, ঋতু? আমি তো মাত্র দুই পেগ গিলেছি চুপিচুপি। এতো ভীড়ে তৃপ্তিমতো গিলার সুযোগ পেলাম কই? এত্তো পাবলিক কোথা থেকে আসে? সেলিব্রিটিদের নাম কামানোর এই পার্টি-টার্টি আমার ভালো লাগে না।
-- বললম, এই ছাইপাশ গিলো না। কে শুনে কার কথা? ওসব গিলে রাতের বেলা গাড়ি চালানো নিরাপদ নয়, মোটেও। বাচ্চা ছেলেটির কথা একবারও মনে হলো না?
-- আরে কিযে ভাবো তুমি? মাত্র দুই পেগ-ই তো। আমি তো দশ পেগ গিলেও ঠিক থাকতে পারি। নো টেনশন গিন্নি। একটা রুমান্টিক গান ধরো। আমিও ঠোঁট মেলাবো তোমার সাথে। শুরু করো...........
-- এ্যাই, তুমি টলতেছো কেন? গাড়ি এতো ঝাঁকুনি দিচ্ছে কেন? আস্তে চালাও প্লীজ, আ-স্তে।
-- তুমি সাথে থাকলে নিজেকে ফর্মূলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন মাইকেল শুমেখার মনে হয়। এ্যাই, আ-সো-না এই নিশি রাতে একা পথে একটু আদর করি। আসো না, সুইটহার্ট। আসো প্লীজ।

সোনারগাঁ হোটেল পেরিয়ে ইস্কাটনের দিকে বামে টার্নিং নিতেই ল্যাম্পপোস্টে টাস করে ধাক্কা মেরে থেমে গেল গাড়িটি। ভাগ্যিস গাড়ির গতি কম ছিল। শৌমিক ঋতুর কোল থেকে ফসকে যেতে যেতে রক্ষা পেল কোনমতে। শরৎ আর বৈশাখীর শরীরে চোট লাগলেও তা গুরুতর কিছু নয়। দু'জনই শৌমিককে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে; ঋতু আতঙ্কে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ শরতের খেয়াল হলো একটু তফাতে ফুটপাতে পুরোনো বস্তার স্তুপের মতো একজন মানুষ ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে তাদের এই দূর্ঘটনাটা ঘুমে কাতর মানুষটার গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। মোবাইলের টর্চ লাইট অন করতেই শরৎ আৎকে উঠলো, বছর কুড়ির একজন মা গভীর মমতায় দেড়-দুই বছরের একটি শিশুকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছেন। ঘুমের ঘোরে ছেড়া, পুরোনো শাড়িটি হাঁটুর উপরে উঠি উঠি করছে। বুকের আব্রু মোটামোটি ঠিকঠাক থাকলেও শ্বাস-প্রশ্বাসের জোয়ার ভাটায় অভূক্ত পেটের জেগে থাকা ঢেউ অন্ধকারে আছড়ে পড়ছে।

-- হ্যা, বৈশাখী-শরৎ দু'জনের বজ্রদৃষ্টিকে ঢেউগুলো দৃষ্টিহীন করে দিচ্ছে।

বৈশাখের সাথে কালবৈশাখী, শরতের সাথে কাশফুল এবং বজ্রপাতের সাথে বজ্রদৃষ্টি একাকার করে প্রকৃতির বৈচিত্র্য আর আগমনী সূরকে একসূতোয় বাঁধা না গেলেও পেট আর চক্ষুদৃষ্টির ভাষা খুব একটা বদলায় না; প্রকৃতির খিদে নেই, লোকচক্ষুর ভয় নেই, হিংসা কিংবা লোভ নেই। আছে সৃষ্টি আর ধ্বংসের নেশা।

মানুষের আছে পেটের চেয়ে সহস্রাধিক বড় খাবারের খিদে, যোগ্যতার চেয়ে লক্ষাধিক বেশি অর্জনের বাসনা। আছে জীবনকে জয় করে চিরজীবী হওয়ার নেশা। পেটের খিদের চেয়ে মন আর মস্তিষ্কের খিদে যখন অধিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তখন বুকের পাজরে বজ্রপাতের গরম সেঁক বিবেকের মিটমিট করা বাঁতিটাকে গলা টিপে হত্যা করে; চিরতরে।



তৃতীয়বিশ্ব

বিলাসবহুল প্রমোদতরীটি যখন ডাঙায় ভিড়লো তখন সূর্য ডুবুডুবু। লোকালয় থেকে একটু দূরে ছোট্ট একটি দ্বীপে একজন সেলিব্রিটির জন্মদিনের পার্টি ছিলো দিনব্যাপী। ঝিরঝির বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া বইছে। ঘাট থেকে উপরে উঠার সরু পাথর বিছানো রাস্তাটি ততক্ষণে কাদায় লেপটে আছে। দুপুর থেকে প্রায় শ'খানেক সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা আর দূর দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ এসে জড়ো হয়েছে প্রমোদতরী সচক্ষে দেখতে সাথে সেলিব্রিটি পরিবার।

তরীটি ডাঙায় ভিড়লো। সুঠাম দেহের সাতজন কালো কোট পরা সিকিউরিটির সাথে সেলিব্রিটি পরিবার তিন সদস্য। সামনে মা-মেয়ে আর পেছনে সেলিব্রিটি। অধীর আগ্রহে ডাঙায় অপেক্ষা করতে থাকা উৎসক চোখগুলো ততক্ষণে প্রমোদতরীকে ডিঙিয়ে মা-মেয়ের হাইহিল, সাদা হট প্যান্ট, ফর্সা উম্মুক্ত উরু, প্রায় উম্মুক্ত উন্নত বক্ষ এবং টাইট আউটফিটে আবদ্ধ। পেছনে, ক্লান্ত বদনে পা টেনে টেনে স্যুট-টাই পরে বার্থডে জেন্টেলম্যান হাঁটছেন।

সাংবাদিকরা পনেরো বছরের জাইকার ছবি তুলছে নানান ভঙ্গিতে, এঙ্গেলে আর ক্লোজ একশনে। যাদের ক্যামেরা-মোবাইল নেই তারা যতটুকু সম্ভব চোখের লেন্স ছোট্ট করে ফোকাস করছে আর মস্তিষ্কের ম্যামোরিতে তা জমা করছে।

"জাইকা ম্যাডাম একটা সর্ট প্লীজ, একটা সেলফি প্লীজ।"

কাদায় লেপটে যাওয়া হাই-হিলকে সামনে রেখে একটু দূরে রেঞ্জ রোভার

উৎসর্গ: গল্পটি আমার অত্যন্ত প্রিয়, সামুর অন্যতম জনপ্রিয় ব্লগার 'সোহানী' আপুকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০২০ দুপুর ১:০৬
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×