এরিকার সাথে ঝগড়াটা ঠিক জমে না সুমনের। এজন্য মেজাজ যখন খুব বিগড়ে যায় তখন বিড়বিড় করে মনে মনে এরিকার চৌদ্দগোষ্টী উদ্ধার করে; রাগে-অভিমানে কথা-টথা ক্ষণিকের জন্য বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি কিন্তু এরিকার চোখ ফাঁকি দেয় না! সে এগুলো উপভোগ করে। এজন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সুমনের দিকে বিরামহীনভাবে থাকিয়ে এরিকা মিট মিট করে হাসে যাতে সুমনের রাগটা আরো চড়া হয়। সুমনও যে ব্যাপারটা বুঝে না তা কিন্তু নয়। স্বভাবতঃ সুমন খুব নিরিবিলি ও নম্র চরিত্রের মানুষ হলেও হঠাৎ করে রেগ যাওয়ার একটা বাতিক আছে সেই নেংটা কাল থেকে।
আজকে সুমনের রেগে যাওয়াটা কিন্তু এরিকার সাথে কোন ঝগড়া-ঝাটি কিংবা মান অভিমান নিয়ে নয়; স্রেফ প্রকৃতির অসম্ভব সুন্দর এক খেয়ালের অংশ হয়েছিল বলে। গত এগারো বছর থেকে লন্ডনে থাকলেও আজকের মত এতো ভারী তুষারপাত সুমন কোন দিন দেখে নাই। সকালে কাজে যাওয়ার সময় রাস্তা একদম ফাঁকা ছিল। ফেরার সময় মনে হচ্ছিল তুষাপাতের সফেদ মরুদ্যান। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফের ঠিলা; রাস্তা-ফুটপাত-পার্ক সব মিলে-মিশে একাকার!
তবে গত কয়েকদিন থেকে ওয়েদার ফরকাস্টে সতর্কতা জারি ছিল। দুই দিন থেকে স্থানীয় প্রশাসন রাস্তায় লবন-বালু ছিটিয়ে দিচ্ছিলো যাতে স্নোতে হাঁটা-চলা করতে মানুষ পিছলে পড়ে না যায়। যে কোন সময় ভারী তুষারপাত হতে পারে এমন আভাস থাকলেও এতো -ভা-রী- হবে কেউ ভাবেনি। দুপুরের দিকে এমন তুষারপাত হয়েছে যে, সুমন নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় আসতে পারে নাই। বাধ্য হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে নর্থ গ্রীনউইচ স্টেশনে এসে বাকি পথ হাঁটা। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় সুমনের মতো অফিস ফেরৎ সবাই হেঁটে হেঁটে যার যার গন্তব্যে ফিরতে হয়েছে।
পথে কম করে হলেও তিনবার পা পিছলে ধবধবে সাদা স্নোয়ের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে হয়েছে সুমনের। মেজাজটা বিগড়ে তিনশত ষাট ডিগ্রী হয়ে আছে। তার উপর বাসায় ফিরে ফ্ল্যাটের দরজায় কয়েকবার বেল টিপেও এরিকার কোন সাড়াশব্দ নেই। শেষমেষ দরজাটা যখন খুললো তখন সুমনের স্নো মাখা ভেজা শরীর আর অভূক্ত অসহায় বদনখানি দেখে এরিকা খিল খিল করে হেঁসে উঠলো। বউয়ের এমন নির্দয় হাসিটি সুমনের বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হতে লাগলো। তিন বছরের ছেলে স্কোপও দৌড়ে বাবার বেহাল দশা দেখতে হাজির। যদিও ছেলে স্কুপের কথা পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি তবুও বাবার আওয়াজ শুনলেই ছেলেটি যত ব্যস্ত থাকুক না কেন হাজির হবেই।
সুমন রাগটা দমাতে বউয়ের দিকে কঠিন হৃদয়ে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে হুট করে শাওয়ারে ঢুকে পড়ে। সুবিধা হলো ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থা থাকায় এতো শীতেও গোসল করতে বেগ পেতে হয় না। গরম-ঠান্ডার সংমিশ্রণে কষ্ট-অভিমান প্রশমিত হবে নিশ্চিত!
এরিকার সাথে সুমনের পরিচয় সাত বছর আগে কাজের সূত্রে। দু'জনেই তখন স্টারবাক্সের বেরিস্তা। সুমন গত দেড় বছর হলো প্রমোশন পেয়ে স্টারবাক্সের ম্যানেজার। তবে এরিকা কোম্পানী পরিবর্তন করে ক্যাফে নিরোতে সুপারভাইজার হিসেবে জয়েন করেছে। দু'জনের চাকরিই কফি শপে। শুধু কোম্পানী আর পদবী উনিশ-কুড়ি।
ছেলে স্কোপকে ঘুম পাড়িয়ে এরিকা তাড়া দিল, জলদি খেতে আস? আমাকে কাজে যেতে হবে। সুমনের খেয়াল হলো আজ এরিকার ইভিনিং ডিউটি। ছেলের জন্য দু'জনেই ডিউটি ভাগ করে রাখে যাতে বাসায় ছেলেটি একা থাকতে না হয়। এরিকা হাঙ্গেরিয়ান। সাড়ে আট বছর থেকে লন্ডনে থাকে। সুমনের সাথে যখন পরিচয় তখন ইংরেজি তেমন বুঝতো না। অনেকটা ইশারা ইঙ্গিতে একে অন্যের বোঝা-পাড়াটা হত। এখন এরিকা ইংরেজিতে বেশ পাকা। অনেকটা ব্রিটিশদের মত এক্সেন তার। তবে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া করতে দু'জনের জানা ইংরেজিটা হয়ত যথেষ্ট ছিল না! ঝগড়ার সময় বাংলা বনাম হাঙ্গেরিয়ান কথার বাতচিত চলে!! এজন্য সারাদিন মন খুলে কথা বলতে পারলেও ঝগড়াটা একদম জমে না তাদের!!!
সুমন খাটে হেলান দিয়ে ট্যাবটা হাতে নিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে নিল যাতে পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্কোপের কোন ডিস্টার্ব না হয়। এরিকা না থাকলে এ সময় সুমন ইউটিউবে গান শুনে। বাংলা কমেডি নাটকগুলোও তার বেশ পছন্দ। হঠাৎ ট্যাবের মনিটরে বায়োস্কোপের একটি ছবি চোখে ভাসতেই আঙুলের ডগা দিয়ে চাপ দিল। বাজতে লাগলো-
"তোমার বাড়ির রঙ্গের মেলায়
দেখেছিলাম বায়স্কোপ,
বায়স্কোপের নেশায় আমায় ছাড়েনা।।
ডাইনে তোমার চাচার বাড়ি
বায়ের দিকে পুকুরঘাট,
সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না।।"
কতবার যে গানটি শুনেছে খেয়াল নেই সুমনের। গানটি তার আত্মার সাথে, রক্তের সাথে, নিঃশ্বাসের সাথে, আবেগের সাথে মিশে আছে। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানকে সময় দেওয়া, কজের ব্যস্ততা আর প্রবাসে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার নিরন্তর চেষ্টায় অবিরাম ছুটতে গিয়ে বায়োস্কোপের স্মৃতিগুলো অনেকটা আড়াল হয়ে গেছে সুমনের কাছে নিজের অজান্তেই। অথচ বায়োস্কোপ তার জীবনের সাথে মিশে আছে অক্সিজেনের মত।
সুমনের বাবা আবুল মন্ডল ছিলেন বায়স্কোপের কারবারি, অন্যভাবে বললে "বায়োস্কোপ ওয়ালা"।। তবে যারা বায়স্কোপ দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের পেশাকে কী বলে তা সুমন মনে করতে পারলো না। বাবার এ পেশাটি ছিল দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। একজন মানুষ তার পেশার প্রতি কতটুকু নিবেদিত প্রাণ হতে পারে; পূর্ব পূরুষদের এ পেশাটাকে ভালবেসে আগলে রাখতে পারে তা বাবা আবুল মন্ডলকে দেখে বুঝেছিল সুমন।
প্রতিদিন আবুল মন্ডল নিয়ম করে বিভিন্ন হাট বাজার, মেলা, বিয়ে-সাদীর অনুষ্ঠানে বায়স্কোপ নিয়ে হাজির হতেন। এলাকায় কোথায় কী অনুষ্ঠান হবে সব খবর বাবার জানা থাকত। কখনো ফাঁকা দিন থাকলে এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সামনে গিয়ে বাচ্চাদের বায়স্কোপ দেখাতেন। তবে স্কুলের বাচ্চাদের যে ছবিগুলো দেখাতেন তা শিক্ষনীয় ছিল। সপ্তাহে একদিন সুমনদের স্কুলেও যেতেন তিনি। বাবা একহাত দিয়ে খঞ্জন বাজাতেন, অন্য হাত দিয়ে কাঠের বায়স্কোপটির হেন্ডেল ঘোরাতেন। মুখে গান ধরতেন আর বায়স্কোপের চারটি ছিদ্র দিয়ে দামাল ছেলেরা হুমড়ি খেয়ে মাথা ঢুকিয়ে ছবি দেখত। অবাকের বিষয় বাবা এসব বাচ্চাদের কাছে থেকে কোন পয়সা নিতেন না।
একদিন সুমন প্রশ্ন করেছিল, বাবা তুমি বায়োস্কোপ দেখিয়ে স্কুলের বাচ্চাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নাও না কেন? উত্তরে বাবা আবুল মন্ডল বলেছিলেন, আমিতো বেশি লেখা পড়া জানি না। বলতে পার শুধু বায়স্কোপ দেখানোটা ভালভাবে পারি, অন্য কিছু তেমন পারি না। আমি মনে করি দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের সবার উচিৎ যার যার অবস্থান থেকে সমাজকে, দেশকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া; সমাজ পরিবর্তনে সহযোগী হওয়া। আমি দায়িত্ববোধ থেকে তাই করছি মাত্র। বাবার একটা উপলব্ধি ছিল মানুষ পড়ে/মুখস্ত করে যা শিখে ছবি দেখলে শেখাটা তার আরো সহজে মনে দাগ কাটে।
মা সব সময় বলতেন সংসার আর চলে না। তুমি অন্যকিছু একটা কর। আর এখনকার দিনে মানুষ বায়স্কোপ দেখে নাকি? ছেলেটিও বড় হচ্ছে, আয় রোজগার ভাল না হলে ছেলের লেখাপড়ার খরছ চালাবে কেমনে? বাবার এক কথা উপায় একটা না একটা হবেই। মায়ের পীড়াপীড়িতে নিজের সামান্য জমিতে চাষবাসও করেছেন তবে বায়োস্কোপের নেশাটাই মূল ছিল। সংসারের অভাব অনটনে মা মাঝে মাঝে বাবাকে বকা দিলেও কখনো নেশাটি ছাড়ার জন্য চাপাচাপি করেননি। মা জানতেন বাবার ভাল লাগা মন্দ লাগার বিষয়টি। মানুষ বেঁচে থাকে তার পছন্দের খেয়ালটি নিয়ে; এটাকে বাদ দিয়ে সংসার, জীবন কোনটিই হয় না।
বাবা একদিন প্রশ্ন করেছিলেন বড় হয়ে কী হতে চাও? সুমন বলেছিল বায়স্কোপ ওয়ালা। শুনে বাবার মুখটি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। মা বিষয়টি খেয়াল করে দৌড়ে এসে বলেছিলেন, আমার ছেলে আধুনিক বায়স্কোপ ওয়ালা হবে। কথাটি যে বাবাকে খুশি করতে বলেছেন তা বয়স কম হলেও বুঝেছিল সুমন। বাবা নিজের পেশা নিয়ে সব সময় অন্তরদ্বন্ধে ভোগতেন। কখনো চাইতেন না ছেলের জীবন তার মতো কষ্টের হোক, অনিশ্চিত হোক। বাবা সব সময় আশঙ্কা করতেন তার মৃত্যুর পর কী বায়স্কোপ কেউ দেখবে না? একটা সময় হয়ত আসবে বায়স্কোপ নামটি কেউ মনে রাখবে না।
সত্যি সত্যি নিজের অস্তিত্বের সাথে তার বায়স্কোপের মৃত্যকে মেনে নিতে পারতেন না আবুল মন্ডল। প্রতিটি মানুষ তার কর্মে বেঁচে থাকতে চায় মৃত্যুর ওপারেও।
দশ বছর হতে চললো বাবা মারা গেছেন, হিসাব করে দেখল সুমন। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডনের পথে রওয়ানা দিয়েছিল সে। লন্ডনে আসার এক বছরের মাথায় বাবা চলে যাবেন তা ভাবতেই পারেনি। সামনে থাকলে বাবার শেষ ইচ্ছাটি জানতে পারতো। খুব ইচ্ছা ছিল বাবা মাকে লন্ডনের রঙিন বায়স্কোপ দেখানোর। তা আর হয়ে উঠেনি। যদিও পরে মা একা এসে ঘুরে গেছেন।
ছেলে স্কোপের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল সুমন। ছেলেটি বাবার পাশে নিশ্চিন্তে তখনো ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হল আজ বাসায় ফেরার সময় রাস্তার পাশে ছোট বাচ্চারা স্নো ম্যান বানাচ্ছিল। একটা স্নো ম্যান চারকোনা আকৃতির ছিল। সাথে চারটি বড় বড় চোখ। অনেকটা বাবার কাঠের সবুজ বায়স্কোপের মত দেখতে।
এরিকার কী এমন কোন স্মৃতি আছে? নিজেকে প্রশ্ন করল সুমন। থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। কিভাবে জানবে সুমন? এরিকাকে তো সে কোনদিন তার অতীত স্মৃতি নিয়ে প্রশ্ন করেনি! এছাড়া হাঙ্গেরিতে শ্বশুরবাড়িতেও সুমন কোনদিন যায়নি। দেশটি সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানে না সে। তবে এরিকা মাঝে মাঝে গুগলে সার্চ করে তার শ্বশুরের দেশ সম্বন্ধে অনেক কিছুই জেনেছে। ইদানিং বাংলাটাও একটু একটু পারে।
আচ্ছা ছেলে স্কোপ কোন ভাষায় প্রথমে পাঠ নেবে? বাংলা, হাঙ্গেরিয়ান নাকি ইংরেজিতে? উত্তর খুঁজে পায় না সুমন। আগে তো কখনো এ বিষয়টি মাথায় আসেনি সুমনের! বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষে মানুষে দূরত্ব কমলেও ভাষা-সংস্কৃতির নিজস্ব প্রভাব রয়ে গেছে। এগুলো জীবনের সাথে সম্পর্কীত।
সুমন মনে মনে ভাবলো টিভি সিনেমা তো এ যুগের বায়স্কোপ। আর ইউটিউব হলো আধুনিক বায়স্কোপের সর্বশেষ সংস্করণ। তাহলে কী বাবার বায়স্কোপটি হারিয়ে যাবে? না, কখনো না। হারিয়ে যেতে পারে না। চোয়াল শক্ত করে ভাবল সুমন।
সিদ্ধান্ত নিল আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে টাকা জমিয়ে দেশে গিয়ে একটি অর্কাইভ তৈরি করবে। ভবিষ্যতে সম্ভব হলে সরকারি/বেসরকারি সহযোগিতায় একটি জাদুঘর বানানোর চেষ্টা করবে; যেখানে থাকবে বায়োস্কোপ সহ হারিয়ে যাওয়া দেশের সব ঐতিহ্য। এ উদ্যোগের সাথী হবে স্ত্রী এরিকা এবং ছেলে স্কোপ দু'জনেই। বিশ্বাস আছ প্রিয়তমা অমত করবে না।
আরেকটি কথা ছেলে স্কোপ নামটি হলো বায়স্কোপ থেকে আনা অংশ বিশেষ; যাতে বাবা আবুল মন্ডল নাতির নামটির মাধ্যমে সুমনের কাছে বেঁচে থাকেন অন্তত একটি প্রজন্ম হলেও। এরিকার বাবা-মায়ের কী এমন কোন সখ-আহ্লাদ ছিল?
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
উৎসর্গ: গল্পটি আমার জানেমন সামু ব্লগের সুপারস্টার (স্বঘোষিত)!! মন্ডল বাড়ির পাজী পোলা মিস-টার মোঃ নিজাম উদ্দিন মন্ডল ভাইকে উৎসর্গ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৮