somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিহঙ্গ এ্যাই রক্কু (গল্প)

২৭ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৪:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অনেক চেষ্টা করেও বাড়ির সদর দরজার তালা খুলতে ব্যর্থ হলেন জামাল সাহেব। ঘন্টা খানেক চেষ্টার পর এখন কিছুটা ক্লান্ত। অপারগতায় রাগে আর গরমে এক্কেবারে কাহিল হয়ে পড়েছেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পেছনের ছোট দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেও তিনি নাছোড় বান্দা। ৩ বছর ২০ দিন পর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করাটা রীতিমত অপমানের; এজন্য যেকরেই হোক লকটা খুলতেই হবে। এক্ষুণি। তাছাড়া বাড়িতে যেহেতু চার-পাঁচদিন থাকবেন সেহেতু তালা না খুলে উপায় নেই
-- দাদু, চাবিটা আমার কাছে দেন, একটু চেষ্টা করে দেখি।
পাশের বাড়ির নাতি সম্পর্কিত ছয়ফুল দাদার পেরেশানি দেখে বলে উঠলো।
-- পাক্কা এক ঘন্টা চেষ্টা করেও হয়নি আর তুমি ছোকরা বাকি আছো .........
-- দাদু, ডেট ওভার মালিকের উপর তালা মিয়া মনে হয় গোস্বা করেছে!!
-- ডেট ওভার? এখনো চাইলে তোদের মতো তাগড়া জোয়ান দু-চারজনকে দুই হাতে তুলে আনায়াসে আছাড় মারতে পারবো।
-- রাখেন আপনার প্যাচাল। সরেন। দেখি আমি চেষ্টা করে।

ছয়ফুলের চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই; কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না। না পারলে দাদা ছেড়ে কথা বলবে না; অতএব, ছয়ফুলের নিরন্তর চেষ্টাটা কন্টিনিউ চলতে থাকলো।

জামাল সাহেব লক্ষ্য করলেন ভেতর ঘরের জানালার গ্রীল ধরে ছোট নাতনীটা দাদার তালা খোলার মিশনটি মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে আর খুশিতে লাফাচ্ছে। শ্বশুরের কাণ্ডকারখানা দেখে তফাতে দাঁড়ানো ছেলে বউটাও মিটমিট করে হাসছে। বড়ই বেয়াড়া বউটা!! এ কেমন মেয়েরে বাবা। শ্বশুরের এমন পরিস্তিতিতে মেয়েটির হাঁসি কী মানায়? এ যুগের বউগুলো কেমন যেন বেয়াদব বেয়াদব ঠেকলো জামাল সাহেবের কাছে। এখন রাগলে চলবে না মিশন সাকসেসফুল করে দেখিয়ে দিতে হবে এই বুড়ো এখনো হাঁসির পাত্র নহে।

-- দাদা, চাবিতে একটু সরিষার তেল মাখিয়ে চেষ্টা করুন। তালাটি খুলতে পারে।
পাশের ঘরের নাতনী রাহেলা একটি বাটিতে কিছু সরিষার তেল নিয়ে এসে জামাল সাহেবের হাতে দিতে দিতে বললো।
-- দেয়, দেয়। আগেকার দিনে জং ধরলে আমরা কেরোসিনে তালাচাবি চুবিয়ে লক খোলার চেষ্টা করতাম; এতে দারুন ফল পাওয়া যেতো। এখন সেই দিনটিও নেই, কোরোসিনও নেই। গ্রামে গ্রামে এখন বিদ্যুৎ। কেরোসিনের কুপির জায়গায় স্থান করে নিয়েছে চার্জার লাইট। পর্যাপ্ত ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন হওয়ায় দিনদিন লোডশেডিং কমছে।

ছয়ফুলের হাত থেকে চাবিটি নিয়ে জামাল সাহেব লক্ষ্য করলেন বেশি জোরে চেষ্টা করতে গিয়ে চাবিটা কিছু বাঁকা হয়ে গেছে। একটি হাঁতুড়ি দিয়ে হালকা চ্যাপ্টা করে চাবিটি তেলের মধ্যে চুবিয়ে তালার মধ্যে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে ঘুরাতে লাগলেন যাতে তালার ভেতরে তেলের ছোয়ায় জংটা নষ্ট হয়।

এভাবে চার-পাঁচ বারের চেষ্টায় সফল হলেন জামাল সাহেব; তালাটি খোলায় মুক্তি মিললো মালিকের।

হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে আসতেই চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিতে দিতে জামাল সাহেবের স্ত্রী বলে উঠলেন।
-- বলেছিলাম সদর দরজার চাবিটা মনাফের কাছে দিয়ে যেতে; না কথাটি তো শুনলে না। এখন তো প্রমাণ হলো; সব কিছুতে তোমার ঘাউড়ামি!!
-- কি প্রমাণ করলেন আপনি?
রেগে স্ত্রীর কাছে পাল্টা প্রশ্ন করলেন জামাল সাহেব। বেশী রাগলে স্ত্রীকে তিনি আপনি বলে সম্বোধন করেন।
-- আমেরিকায় যাওয়ার আগেই বলেছিলাম, কবে দেশে আসবো তার কোন ঠিক নেই। চাবিটা কেয়ারটেকারের কাছে দিয়ে যাও; তখন কথাটি তো কানেই তুললে না। এখন তো নিজের চোখেই দেখলে।
-- আগে যখন ৩-৪ মাস পর পর শহর থেকে বাড়িতে আসতাম তখন তো কোন সমস্যা হয়নি; এখন হবে কেন?
-- তিন-চার মাস আর ৩ বছর কী এক?

জামাল সাহেব বিষয়টি নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। স্ত্রীর কথায় যুক্তি আছে। পরাজয়টা তাই নীরবে কোন প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিলেল। মনে আছে একবার সরকারী খরছে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে জাপান গিয়েছিলেন তিনি। তখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। আসার সময় অনেক সৌখিন জিনিসের সাথে তালাটিও নিয়ে এসেছিলেন। গোল্ডেন কালারের সম্পূর্ণ পিতলের তৈরী তালাটি দেখতে খুব সুন্দর আর মজবুত ছিল। গত কয়েক বছরে রোদে বৃষ্টিতে ভিঁজে সখের তালাটা এখন খসখসে অমসৃণ আর বয়োজেষ্ট হয়ে গেছে। আগে বাড়িতে আসলেই তালার জং পরিষ্কার করতেন। কেরোসিন দিয়ে ঘসে ঝকঝকে তকতকে করে রাখতেন। গত তিন বছরের অনাদর আর অবহেলায় তালাটির জীবন প্রায় বিপন্ন। প্রিয় তালাটার এমন রুগ্ন দশা দেশে বড্ড মায়া হলো তার।


চা নাস্তা করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আদরের নাতনি মীম, বড় ছেলের বউ আর ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়িটা প্রদক্ষিণ করতে বের হলেন জামাল সাহেব। সাথে কেয়ারটেকার মনাফ।
-- বাড়িটার কী অবস্থা করে রেখেছিস?
মনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন জামাল সাহেব।
-- আপনি যেমন যেমন বলেছেন সবই তো ঠিকঠাক মতো করেছি।
-- ঠিকঠাক?
-- হ। আমি প্রতিদিন একবার করে বাড়িটি ঝাঁড়ু দিয়েছি; আগাছা পরিষ্কার করেছি; ফুলের বাগানে নিয়মিত পরিচর্যা করেছি; গাছগুলোর ডাল ছাটাই করেছি। আর.................
হাতের ইশারায় মনাফকে থামিয়ে দিলেন জামাল সাহেব।
-- করেছিস ভাল কথা। তাহলে ঘরের সামনের আঙিনায় এতো ঘাস আসলো কোথা থেকে? ফুলের বাগানে একটাও ফুল নেই কেন? বাড়িতে ঢোকার রাস্তাটি ভেঙে গর্ত হলো কেমনে? ঘরের ওয়ালে এতো শ্যাওলা জমলো কেন? পুকুর ঘাট এতো পিচ্চিল হলো কেমনে?
-- আমার কাজ তো আগেও কোনদিন আপনার পছন্দ হয়নি, এখনো হবে না। এতো কষ্ট করে সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম আর এখন জুটছে শুধু শুধু তিরস্কার।
-- ভালই তো তর্ক করা শিখেছিস?
অবস্থা বেগতিক দেখে ছোট ছেলে বাবলু বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো-
-- মনাফ যা করেছে এজন্য তাকে আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ বাবা। সে তার মতো করে বাড়িটি সুন্দর পরিপাটি করে রাখার চেষ্টা করেছে। কোন কাজ পুরোপুরি অন্যের মন মতো করা যায় না, কী বলেন ভাবী?
-- আমারও তাই মনে হয়। তাছাড়া আমরা তো চার-পাঁচদিন এখানে থাকছি; প্রয়োজন হলে বাড়তি মানুষ লাগিয়ে আরো ভাল করে বাড়িটি পরিষ্কার করে নেওয়া যাবে। কথাটি কী ভুল বল্লাম, বাবা?
-- নারে মা, ঠিকই বলেছিস। ভাবছি বাবলুর বিয়ের অনুষ্ঠানটা বাড়িতেই করবো? অবশ্য তোদের অমত থাকলে ভিন্ন কথা।
-- অমত থাকবে কেন বাবা? মায়ের সাথে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে মাও খুশি হবেন; কি বলিস বাবলু?
বাবলু আমতা আমতা করছে, লজ্জায় মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। নিজের বিয়ের বিষয়ে বাবার সামনে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে সে। তবে ইশারায় ভাবীকে সমর্থন সূচক হাঁসি দিয়ে জানিয়ে দিল।

বিকালে খাওয়া-দাওয়ার পর চেয়ার পেতে বাড়ির উঠানে বসে আছেন জামাল সাহেব। তাকে ঘিরে গ্রামের অসংখ্য মানুষ। সবাই আমেরিকা ফেরৎ জামাল সাহেবকে দেখতে এসেছেন; স্বপ্নের আমেরিকার গল্প শুনতে এসেছেন। তিন বছর পর প্রতিবেশী প্রিয় মানুষগুলোকে দেখে তিনি বেশ তৃপ্ত। সবার ভালমন্দ খোঁজ-খবর নিলেন। প্রতিবেশী বাচ্চাদেরকে আমেরিকা থেকে আনা চকলেট আর ধুমপায়ীদের বাংলাদেশ বিমান থেকে কেনা বেনসন সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। বিদেশী সিগারেটের ধোয়ায় পরিবেশটি মৌ মৌ করতে লাগলো। তাদের আগমনের খবর শুনে বাড়িতে বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজনও এসেছেন।

একটা সময় ছিল প্রতিবার কলেজ বন্ধ হলে বাড়িতে এসে জামাল সাহেব সবার ঘরে ঘরে যেতেন। সবার ভালমন্দ খবরা-খবর নিতেন। বাড়ির চাচা চাচি ভাইবোন সবার সাথে গল্পগুজব করতেন। প্রতিবেশী বাড়ির খোঁজ নিতেন। সারা গ্রাম টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন।

লীজাদের বাড়িতেও যেতেন।

একসাথে মেট্রিক পাশ করলেও লীজা পড়তো স্থানীয় বাকেরগঞ্জ কলেজে। আর তিনি পড়তেন শহরের নামকরা একটি সরকারী কলেজে। ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত একসাথে লেখাপড়ার সুবাদে বেশ ভাব হয়েছিল তাদের মধ্যে।

যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন দূরত্বেের কারণে একে অন্যের ভাললাগার বিষয়টি টের পান উভয়েই; এই ভাল লাগাটা ভালবাসায় রূপ নিতে বেশিদিন লাগে নাই। বিষয়টি জানাজানি হতেই উভয় পরিবার থেকে নিষেধাজ্ঞা আসে। দেখা করতে কঠোরভাবে বারণ করা হয়। একটা সময় তার অজান্তেই ইন্টার পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই লীজার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। বিয়ের পর অভিমানে লীজা কোন দিন জামাল সাহেবের সাথে যোগাযোগ রাখেনি।

শোকে ও অপমানে বেশ কয়েক বছর নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন জামাল সাহেব। ছুটির বিশেষ দিনগুলোতে বাড়িতে আসলেও গ্রামে ঘুরতে বের হতেন না। পারতপক্ষে গ্রামের কারো সাথে যোগাযোগ রাখতেন না। তবে বিয়ের কয়েক বছর পর লীজার সাথে একবার দেখা হয়েছিল তার। কিন্তু লীজা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল; সেদিন চেনেও না চেনার ভান করেছিল। জামাল সাহেবেরও নিজের মধ্যে অজানা এক সংকোচ হয়েছিল। এজন্য আগ বাড়িয়ে তিনিও কথা বলতে পারেন নাই লীজার সাথে।

একটা সময় প্রিয় যে মানুষটিকে কতবার যে ভালবাসি বলেছিলেন সেই মানুষটিকে আজ সামনাসামনি পেয়েও কেমন নিশ্চল। নেই আবেগের বাড়াবাড়ি। ভাবখানা এমন যেন কোনদিন পরিচয়ই ছিলো না। অথচ বাড়িতে আসতে দেরী হলে কত আবেগপূর্ণ চিটি লেখতো লীজা। মাত্র কয়েক বছরে সবকিছু ভুলে গেল? ভালবাসার যে মানুষটিকে নিয়ে দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখতো সে মানুষটিকে আজ কেমন আছো বলতেও সংকোচ হয়। তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি এটাও বুঝাতে সংকোচ হয়।

মনে পড়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় পরিচয় হওয়া শ্রাবন্তীর কথা। তিনি তাকে মনে প্রাণে ভালবাসতেন; হয়তো শ্রীবন্তীও। কিন্তু শ্রাবন্তী খুব উচ্চবিলাসী হওয়ায় সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। সিটিজেন পাত্রকে বিয়ে করে ছয় মাসের মাথায় আমেরিকা চলে গিয়েছিল শ্রাবন্তী। আমেরিকার নিউজার্সি থেকে একটি চিটিও জামাল সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিল। প্রেরকের ঠিকানায় শুধু নাম আর নিউজার্সি লেখা-

"জামাল,
হোপ এভরিথিং গোয়িং ওয়েল। আই এম গুড এজ ওয়েল উইথ মাই হাভি। ইট ওয়াজ মাই ড্রিম টু সেটেল্ড ইন ইউএস। আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট লাভ। আই অলয়েজ কেয়ার লাভ উইথ মানি, অলসো কম্পানি উইথ চারমিং ইয়াং এন্ড সাকসেসফুল গাই। সরি টু সে ইউ আর নট লাইক দ্যাট এট অল। সো টেক ইট ইজি। লুক ফরওয়ার্ড। হোপ ইউ কেন গেট এ লাভলি বিউটিফুল ওয়াইফ। বেস্ট উইসেস।
বাই-
মিসেস শ্রাবন্তী ফয়েজ।"

তখন অনেক অপমানিত হয়েছিলেন জামাল সাহেব। ভাবতেন একবার আমেরিকায় যেতে পারলে সামনে গিয়ে বলবো, দেখো আমিও আমেরিকায় আসতে পারি। আমারও সে যোগ্যতা আছে। অথচ গত তিন বছর থেকে আমেরিকার বোস্টনে থাকলেও একটিবারও শ্রাবন্তীর সাথে দেখা করার কথা মাথায় আসেনি তার। যদিও বোস্টন আর নিউজার্সির দূরত্ব খুব বেশি নয়। শুনেছেন এখন শ্রাবন্তীর ডিভোর্স হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যার যার মতো থাকে।

সে এখন নিঃসঙ্গ। একা একটি ফ্ল্যাটে থাকে। সাথে একটা সাদা বিড়াল।


অনেকদিন পর আজ হঠাৎ মনে পড়লো জাপানীজ কোকিকোর কথা। সে ভাল বাংলা জানতো। বাংলা সাহিত্যের উপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের কোর্স সম্পন্ন করে গেছে। এজন্য বাঙালিদের দোভাষী হিসাবে টোকিওতে কাজ করতো সে। জাপানীরা ইংরেজীতে খুব কাঁচা। এজন্য দেশটির যে কোন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে দোভাষী প্রয়োজন হয়। কোকিকোর চাকরিটাও তাই। জামাল সাহেবের সাথে আরো কয়েকজন বাঙালি থাকলেও তার সাথেই মেয়েটির বোঝাপড়াটা সবচেয়ে ভাল ছিল। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন-
-- কোকিকো নামটির মানে কী?
উত্তরে বলেছিলো-
-- তুষারপাত/স্নো।
কোকিকো জাপানি ভাষায় বলে উঠলো-
-- ওয়াতাছিওয়া, আনাতা ও আইছতিমেছু।
বলো তো মানেটা কী?
-- স্যরি, বুঝতে পারি নাই।
-- তুমি আমার সাথে কথাগুলো রিপিট করো।
কয়েকবারের চেষ্টায় যখন ঠিকঠাক হলো তখন বললো-
-- আমি তোমাকে ভালবাসি।
যদিও পরে কথাটি এমনিতেই ফান করে বলা বলে পরিবেশটা হালকা করেছিলো সে।
দেশে আসার দিন টোকিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বিদায় দিতে এসে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেছিলো-
-- ওয়াতাছিও কেছিতে ওয়ছুরেনি, মেতে নি।
এবার আর ট্রেন্সলেট করতে হয়নি, কারণ ততোদিনে জাপানি ভাষাটি কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছেন তিনি।
অর্থ হলো- কখনো আমাকে ভুলবে না, আবার দেখা হবে।

সত্যি তুষারপাতের মতো শুভ্র ও সুন্দরী ছিল সে। বয়স চল্লিশের কোঠায় হলেও কোকিকোকে কিশোরীদের মতো লাগতো। চমৎকার হাঁসি ছিল তার। একটা সময় বয়ফ্রেন্ড থাকলেও পরে আর বিয়ে করেনি। তাকে যে পছন্দ করতো তা বুঝতেন জামাল সাহেব। তবে মুখ ফুটে কখনো সে বলে নাই। আসার সময় বউ বাচ্চার জন্য অনেক গিফট কিনে দিয়েছিলো কোকিকো।

সাথে গোল্ডেন কালারের সদর দরজায় লাগানো তালাটি।

বলেছিল যতদিন তালাটি থাকবে ততোদিন যেন অন্তত তাকে মনে রাখেন তিনি। তালাটির কথা ঠিকই মনে আছে তবে কোকিকোর স্মৃতি কী আগের মতো টাটকা আছে? সম্ভবত না, হাজারো স্মৃতির স্তুপে অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
-- অন্ধকারে বারান্দায় একা একা বসে কী ভাবছো দাদু?
রাহেলা উঠান থেকে বারান্ধায় পা ফেলতে ফেলতে জানতে চাইলো।
-- বুড়ো মানুষের আবার ভাবনা?
চমকে উঠে স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলেন তিনি। আনমনে স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমেছে খেয়াল নেই তার।
-- অন্ধকারে বসে আছ কেন?
বারান্দার লাইটটি জ্বালিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো রাহেলা।
-- থ্যাংক ইউ, গিন্নি।
-- গিন্নি?
-- তুই তো আমার ছোট গিন্নিই।
-- ভিমরতি ধরছে, তাই না? যতই গ্রীনজার্ডধারী হো না কেন, কোন চান্স নেই!!
-- আচ্ছা বলতো গিন্নি- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্ররা সাহিত্য রচনা না করলে মৃত্যুর এতোদিন পরও মানুষ কী তাদের মনে রাখতো?
-- কঠিন প্রশ্ন দাদু। হুম..... সম্ভবত না।
-- হুম, আসলে প্রেম ভালবাসা হলো মিথ্যা আবেগ। আবেগ কেটে গেলে একটা সময় মানুষ তা ভুলে যায়। এ আবেগটি মূল্যহীন হয়ে পড়ে। মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্ম আর প্রিয় মানুষদের দেওয়া উপহারের স্মৃতি নিয়ে।
-- আরেকটি কথা দাদু, ভালবাসার মিথ্যা আবেগে মানুষ আত্মহত্যা করে কিন্তু বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আবেগে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে। নিজের বিবেককে শানিত করে। সমাজ ও দেশকে পরিবর্তন করে।
-- হুম, ঠিক বলেছিস গিন্নি।


আসুন বিনে পয়সায় তিনটি জাপানি শব্দ জেনে নেই- নিহঙ্গ (জাপানিজ), এ্যাই (ভালবাসা), রক্কু (তালা)। [Japanese Love Lock]

ফটো ক্রেডিট,
গুগল।

চাইলে পড়তে পারেন-
আমার সবচেয়ে লাইক/কমেন্ট প্রাপ্ত পোস্ট।
গল্প লেখার সহজ পাঠ।
সবচেয়ে পঠিত প্রবন্ধ।
আলোচিত ফিচার 'দি লাঞ্চিয়ন'।
ব্রিটেনের প্রবাস জীবন- স্মৃতিকথা।
সবচেয়ে পঠিত গল্প।
সবচেয়ে লাইকপ্রাপ্ত গল্প।
ছবি ব্লগ (লন্ডনের ডায়েরি-১)।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ২:৫৮
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×