এটা আমরা স্বীকার করি আর না করি ক্রিকেটে বাংলাদেশে সম্ভবত পাকিস্তানের সাপোর্টারই সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার আগেকার সময়কার ঘটনা বিচারে এটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ, যুদ্ধের সময়কার আবেগ, পরিস্থিতির তীব্রতা এবং বাঙালির জানবাজি রেখে লড়াই - ইতিহাসের এই অংশটুকু ফ্লুক নয়, একেবারেই জলজ্যান্ত বাস্তব। তারপরেও আমাদের এই পাকিপ্রেম কেন?
খুব ছোটবেলায় আমিও পাকিস্তানকে সাপোর্ট করতাম, স্কুল লাইফেই সেই লুপ থাকে বেরিয়ে আসি। এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়; কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষ সেই লুপেই অনবরত ঘুরপাক খায়। এর মধ্যে সাধারণ তথাকথিত নিরীহ মানুষও যেমন আছে, উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারী মানুষও আছে। "পাকিস্তান আমাদের ওপর এত অত্যাচার করার পরেও পাকিস্তানকে সমর্থন করেন কেন?" - এই প্রশ্ন শুনলে এই বিশাল সংখ্যক মানুষ সাধারণত একটু অসহিষ্ঞু হয়ে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেন -
ক) খেলাকে রাজনীতির সাথে মিশাবেন না।
খ) পাকিস্তান ভালো খেলে তাই সাপোর্ট করি।
গ) তারা আমাদের মুসলমান ভাই।
আচ্ছা, এই বিষয়গুলোর ওপর একটু আলোকপাত করা যাক।
ক) খেলাকে রাজনীতির সাথে মিশাবেন নাঃ
এই কারণটার ওপরে সাধারণত সার্টিফিকেটওয়ালা উচ্চশিক্ষিতরা বেশি জোর দেন। রাজনীতি এবং আন্ত্রজাতিক সম্পর্ক থাকবে রাজনীতির যায়গায়, খেলাধুলা ইজ জাস্ট ফ' ফান। এটা একটি স্বতন্ত্র বিষয়। ফুলস্টপ। আমার কাছে বিষয়টাকে এত সরল সমীকরণ মনে হয় না। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে প্রত্যেকটা মানুষই রাজনৈতিক জীব। বাংলাদেশের জন্ম হওয়া এবং না হওয়া দ্বারা যেহেতু আমার ব্যক্তিজীবনও প্রভাবিত হয়, আমার বোনকে ধর্ষণ করলে তার প্রভাব যেমন আমার ভাবনা ও জীবনে এসে পড়ে, আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে হত্যাকারীর প্রতি ঘৃণাকে যেহেতু এড়াতে পারি না, সেহেতু ব্যক্তিজীবন, খেলাধুলার ফান এবং রাজনৈতিক জীবন বিচ্ছিন্ন জিনিস নয়, পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। খেলার মাঠে আমরা যখন একটি দলকে সমর্থন করি, সেই দলের পিছনের দেশটির নামও তখন তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। "খেলাকে রাজনীতির সাথে মিশাবেন না" - কথাটি তাই আমার কাছে খেলো মনে হয়, জুতসই কারণের অনুপস্থিতিতে শর্টকাটে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা মনে হয়।
খ) পাকিস্তান ভালো খেলে তাই সাপোর্ট করিঃ
এই যুক্তি (?) সাধারণত স্কুল-কলেজের পোলাপান লেভেলে বেশি চলে। এটা অবশ্য একটু চানাচুর টাইপ কথা। হালকা চাপ দিলেই গুঁড়া হয়ে যায়। পাকিস্তান ঠিক কোনদিক দিয়ে ভালো খেলে তা সহজে বোধগম্য নয়। রেজাল্ট হিসেব করলে আইসিসি র্যাংকিং এ ৭ নম্বর দলটি পছন্দের লিস্টে আসার কথা না, স্কিল হিসেব করলে অস্ট্রেলিয়া-সাউথ খ আফ্রিকা-বর্তমান ইন্ডিয়া এরা আগে চলে যায়, সাহস হিসেব করলে ওয়েস্ট-ইন্ডিজ ১ নম্বরে। সবচেয়ে বড় কথা 'ভালো খেলা'টা ডায়নামিক ব্যাপার। ভালো খেলার সূচক যা-ই হোক, কোন নির্দিষ্ট টীম বছরের পর ধরে ভালো খেলে না, অবস্থান পালটায়। কিন্তু এই সমর্থক গোষ্ঠীর সমর্থন তাতে পালটায় না। বেশি চাপাচাপি করলে যথারীতি উষ্মাসহকারে "আমার যাকে ইচ্ছা তাকে সাপোর্ট করি, তোমার কি?" লেভেলে কথা চলে যায়। 'কেন?'র উত্তরের সমাধা আর হয় না।
গ) তারা আমাদের মুসলমান ভাইঃ
এই কারণটা বেশি কাজ করে তথাকথিত সরলমনা ধর্মভীরু(?) আমজনতার মধ্যে। আমজনতার কতভাগ সরলমনা আর কতভাগ প্রকৃতপক্ষে ধর্মভীরু তা ভিলেজ পলিটিক্স সম্পর্কে অবগত মানুষ ভালো করে জানে, সে বিষয়ে কথা না বাড়াই। কিন্তু যে কোন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই বুঝা উচিত, পাকিস্তান এবং ইসলাম সমার্থক নয়। পাকিস্তানী শাসকদের দৃষ্টিতে আধা মালাউন বাঙালিদেরকে সাচ্চা মুসলমান বানাতে তাদের মেয়েদেরকে রেপ করে ইসলামের বীজ বপন করা, নিরস্ত্র মানুষকে লাইন দিয়ে গুলি করে হত্যা করা, গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া, এটা ইসলাম নয়। এই কাজ যারা করে, তারা কিভাবে 'ইসলামী' ভাই হয়? এটা বুঝতে সার্টিফিকেট লাগে না, উচ্চশিক্ষা লাগে না, যেকোনো সুস্থ মানুষই মাথাটা খাটালেই বুঝতে পারে। আমরা মাথাটা খাটাই না।
আচ্ছা, তাহলে তো কোনো যুক্তিতেই পাকিস্তানকে সমর্থন করা যায় না। এরপরেও এত বিশাল সংখ্যক মানুষ পাকি সমর্থক কেন? ব্যাপারটি নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই, মানুষের বিশ্বাস, মোটিভেশন নিয়ে পড়াশুনাভিত্তিক জ্ঞানও নেই। কিন্তু এর কারণ বলে যা মনে হয়, তা হলো, মানুষের পক্ষভিত্তিক অবস্থান গ্রহণের প্রবণতা। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদেরকে ধর্মভিত্তিক বায়াস করা কৌশলটার প্রভাব আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নি। ধর্মভিত্তিক রায়টগুলোর প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী, চেতনে হোক, অবচেতনে হোক - আমাদের জিন এখনো সেই প্রভাব বয়ে বেড়ায়। সুতরাং ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো একপক্ষকে ভালো, অন্য পক্ষকে খারাপ - এই সরল সমীকরণে ফেলার প্রবণতা খুব শক্তভাবে বিরাজ করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত আমাদেরকে সাহায্য করেছে যতোটা না বাংলাদেশের জনগণের প্রয়োজনে, তারচেয়ে বেশি তাদের নিজের প্রয়োজনে। এটাই বাস্তব, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলভিত্তিও এটাই, এক্ষেত্রে দয়াদাক্ষিণ্য বলে কিছু নেই, সম্পর্কটা কেবলই বৈষয়িক। কিন্তু এই জিনিসটা বুঝতে আমরা প্রায় পুরোপুরিই ব্যর্থ হই। আমরা ভাবতে ভালোবাসি আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মত কোনো এক দেশ আমাদেরকে উন্নত করে দিয়ে যাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের বন্ধু ভারত যখন যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় আর আলাদিনের দৈত্যের মত এগিয়ে আসে না, বাংলাদেশ পরিণত হয় তাদের পণ্যের বাজারে, তখন আমাদের অনেকে এমনও মনে হয়, আহা! মালাউনদেরকে বিশ্বাস করাটাই ভুল, পাকিস্তানই ভালো ছিলো! তারা অন্তত 'এই' করতো না, 'সেই' করতো না, বাবরী মসজিদ ভাঙতো না, বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমকে অবজ্ঞা করতো না।
সুতরাং, ইন্ডিয়া খারাপ। "অতএব, পাকিস্তান ভালো!"
এটা একটা ভুল অ্যাপ্রোচ। আমাদের দেশকে আমাদেরকেই গড়তে হবে। ভারত হোক, পাকিস্তান হোক, চীন হোক, আমেরিকা হোক, স্বার্থ না থাকলে কেউ আমাদেরকে এক পেনি দিয়েও সাহায্য করবে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভিক্ষা; কিংবা দয়াদাক্ষিণ্যনীতি একেবারেই অচল।
এখন আসা যাক, একাত্তরে যুদ্ধের ঘৃণা আমরা এখনো বয়ে বেড়াবো কি না, বয়ে বেড়ালে আমাদের লাভ কি - সেই প্রসঙ্গ। এই বিষয়ে আপনার যুক্তি আপনার। যেমন, রাজাকারদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ার নীতি যদি আপনার কাছে, বাস্তব সম্মত মনে হয়, তাহলে পাকিস্তানের (ইনডিভিজুয়াল পাকিস্তানী বলছি না, কনসেপ্টটা সমগ্রর) প্রতি ঘৃণা না রেখেও আপনি অনায়াসে জীবন-যাপন করতে পারেন। আমার কাছে ব্যাপারটা ভিন্ন। অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিগত অনুধাবন থেকে আমি বিশ্বাস করি, দেশের জন্মের বিরোধিতা করা রাজাকার কখনোই দেশের উন্নতির জন্য কিছু করবে না, তার পুরোটাই ধান্দা, সুযোগ পেলেই দেশের পাছা মেরে লাল করে সে হো হো করে হেসে আমাকে আপনাকে দেখাবে একাত্তরে তার ভূমিকাই ঠিক ছিলো। একইভাবে আমার ভাইকে হত্যাকারী, আমার বোনকে ধর্ষণকারীর প্রতি ক্ষমাশীল হওয়াটা আমার কাছে তীব্র অপমানের মনে হয়। আপনার যদি সেই অপমানের অনুভূতি না থাকে, আমি কি করতে পারি? আপনার অনুভূতি, আপনার আত্মমর্যাদাবোধ আপনারই!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৫১