"জ্ঞান মানুষকে মুক্তি দেয় কিন্তু অহংকার মানুষকে জ্ঞান থেকে মুক্তি দেয় না"
বাংলাদেশের ৯৯.৯৯% মানুষের মাঝে এই অহঙ্কার আছে।
কোনো চৌকিদার উনার সাথে যদি ব্যাংকের কেরানীর যৎসামান্য খাতির থাকে উনি আর লাইনে দাঁড়িয়ে বিল পরিশোধ করবেন না। এতে উনার ইজ্জতে লাগবে। চৌকিদার থেকে কেরাণি, কেরাণি থেকে-ক্যাশিয়ার , ম্যানেজার হয়ে এই ইজ্জতের ধারা ক্রমবর্ধমান হারে উপরের দিকে বাড়তেই থাকে।
একবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশানে টিকেট কাটার সময় দেখলাম-সামনের এক বৃদ্ধলোককে একেবারে ধাক্কা দিয়ে লাইনের সামনে গিয়ে একজন টিকেট কাটছেন। কারণ - জানলাম, উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। লাইনে দাঁড়ালে উনার ইজ্জতের অবমাননা হবে। ভাবলাম- বৃদ্ধ একজন লোককে গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে টিকেট কাটাই যদি মুক্তিযোদ্ধার ইজ্জত হয়, তবে এরকম মুক্তিযোদ্ধার মুখে থু থু থু।
কোনো সংগঠনের নেতা, উপনেতা, পাতিনেতারা চান-সবাইকে পাশ কাটিয়ে উনাদের কাজগুলো আগে করে দেয়া হোক। তা না হলে উনাদের ইজ্জতে লাগে। কোনো অনুষ্ঠানে সামনের আসনগুলোতে নেতারা বসতে না পারলেও উনাদের বড় ইজ্জতে লাগে।
বাংলাদেশের সংগীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী পুরুষ শিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদকে একবার সামনের আসনের চেয়ার থেকে ওঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো- এক নেতাকে ইজ্জত দিতে। এরপর থেকেই এই শিল্পী অভিমানে গান গাওয়াই বন্ধ করে দিলেন।
বড় মাওলানাদের দেখেছি বিশাল মাহফিলে খুবই সুমধুর সুরে উপস্থিত জনতার উদ্দ্যেশে সালাম দিতে। কিন্তু এই একই মাওলানাকে দেখিনি একলা পথে হেঁটে যেতে অন্য কোনো মানুষকে আগে থেকে সালাম দিতে। কারণ- এতে যদি উনার ইজ্জতে লাগে।
চেয়ারে বসা যে কাউকে স্যার বলে সম্বোধন করতে হবে। না হলে। উনাদের মন খুবই খারাপ হবে। কারণে এতে উনাদের ইজ্জতে লাগে।
কোনো নেতা, নেতার খুচরা পয়সা, ভাংতি পয়সাও যদি আপনার সামনে আসে আর আপনি উনাকে শ্রদ্ধা করে ওঠে না দাঁড়ান -তাহলেও উনাদের ইজ্জতে লাগবে। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়লো- আটলান্টা সিটি কর্পোরেশানে তখন আমি নতুন কাজে যোগ দিয়েছি। অফিসের সবার সাথে ভালো পরিচয় হয়নি। ঠিক সে সময়-আটলান্টা সিটি কর্পোরেশান একটা গলফ টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। আমরা অফিসের সবাই খুব ভোরে মাঠে গিয়ে হাজির হয়েছি। আমি আর আমার সহকর্মী টামিকা পাশাপাশি চেয়ারে বসে পত্রিকার পাতা দেখছি। এমন সময়- আমার বস সোজান বললো- আরিফ-আপনার সাথে পরিচয় করে দেই। ইনি-আমাদের মেয়র শার্লি ফ্রাঙ্কলিন। এ কথা শোনার সাথে সাথে আমি একেবারে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালাম। বলে কি- আটলান্টার মেয়র আমার সামনে। টামিকা সবেমাত্র জর্জিয়া স্ট্যাট থেকে গ্রাজুয়েশান করেছে।ও দেখি চেয়ারে বসেই আছে। আর আপন মনে পত্রিকা পড়েই যাচ্ছে।মেয়র সামনে দাঁড়ানো-এতে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মেয়র বললেন-আপনি দাঁড়াচ্ছেন কেন? আপনি বসুন। আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগছে। আমিও বললাম-আপনার সাথে পরিচয় হয়ে আমিও খুবই উৎফুল্ল। টামিকা বসে রইলো- মেয়রের সাথে চোখাচোখি হলো। দুজনে মিষ্টি করে হাসলো। এরপর মেয়র সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়রের ইজ্জতের এতোটুকু হানি হলোনা।
এ প্রসঙ্গে ঢাবি'র একটা ঘটনা মনে করলে এখনো চোখে পানি আসে। একবার আমার এক বন্ধু সেলুনে সেভ করছিলো। এমন সময় সেলুনে এক লীডার আসেন। আমার বোকা বন্ধুটির তখন অর্ধেক গাল শেভ হয়েছে। ও লীডারকে দেখে কেন সাথে সাথে ওঠে দাঁড়ালোনা, সেজন্য নেতা আর উনার সাথের কিছু ভাংতি পয়সারা বোকা বন্ধুটিকে কান ধরে ওঠ বস করালো। আমি আর বন্ধুটির বাবা যিনি হলে ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন- সেলুনের ভিতরে ওর সেভ হওয়ার অপেক্ষায় বসে ছিলাম।বীতশ্রদ্ধ বাবার চোখে ছলছল করা পানি।আমার ভিতরটাও হু হু করে কাঁদছে। আমি আলতো করে বৃদ্ধা চাচার হাতে চাপ দিলাম। বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। বাবা,চেয়ে চেয়ে দেখছেন- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা উনার আদরের সন্তান বিনা অপরাধে কান ধরে ওঠবস করছে। সন্তান হয়তো মনে মনে ভাবছে- মাটি তুমি দুভাগ হও। আমি তোমার ভিতর ঢুকে যাই। কানে কানে বললাম, এখন সংযত হতে হবে চাচা। কিছু বললে- বিপদ আরো ভয়ঙ্কর হতে পারে।
একবার জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইরেক্টর ডঃ রব ম্যাকবেথের সাথে আলাপ হচ্ছিলো। কথা প্রসঙ্গে বললেন- তোমাদের ধর্মের যে জিনিসটি আমার সবচেয়ে ভালো লাগে- তা কি জানো?
আমি বললাম- আপনি বলুন।
উনি বললেন- তোমাদের প্রার্থণা। মসজিদের ভিতরে সবাই যখন ধনী-গরীব, কালো ধলো, ছোট, বড় সবাই এক লাইনে দাঁড়িয়ে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে প্রার্থণা করো -সেই জিনিসটা আমার অপূর্ব লাগে। এতো সুন্দর সাম্য যেন পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
গতবার দেশে গিয়ে শহরের মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে গেছি। দেখি, ইমামের ঠিক পেছনের জায়গাটি ফাঁকা। সেই ফাঁকা জায়গা পূরণের জন্য যখন সামনে যাবো-দেখি পাশ থেকে একজন বলছেন-ভাই, একটু সরে দাঁড়ান। এটা ডিসি সাহেবের জায়গা। উনি এইতো এক্ষুণি চলে আসবেন।
মনে মনে ভাবলাম- সাম্য বড় কথা নয়। ইজ্জতই আসল কথা। অধঃপতন আমাদের হবেনাতো । আর কার হবে!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫২