১.
মাথা নিচু করে শার্টের হাতা কামড়াচ্ছে অন্তু। নাজমা বেগমের তখন মাথা খারাপ অবস্থা। এই এক ছেলে বুঝি তার জীবনটা কয়লা বানিয়ে ফেলবে! এইটুক বয়সে তার বাকি দুই ছেলে-মেয়ে এতো জ্বালানো জ্বালায়নি। সবাই বলে ঘরের ছোটটা নাকি সবচে দুষ্ট হয়, তাই বলে এরকম দুষ্ট হয়? থ্রিতে পড়ে বাচ্চা...ক্লাসের কোন মেয়েকে নাকি বলেছে বিয়ে করবে! স্কুলের ম্যাডাম যখন এই কথাগুলো বলছিল, তখন নাজমা বেগমের লজ্জায় মরে যাবার মতো অবস্থা। ঘরে আসার পর যতো যাই জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে, কেন বলেছ...কোনো জবাব নেই। শার্টের হাতা কামড়াচ্ছে আর মাথা নিচু করে কাঁদছে। এইটুক ছেলেকে এই বিষয়ে কি বলবেন তাও ভেবে পেলেন না !
হাতা কামড়ানোর পর্ব খুব দ্রুতই শেষ হলো। মাথা ধরেছে বলে এস্পিরিন খেয়ে শুয়ে পড়লো অন্তুর মা। ভাইয়া-আপুর মুচকি মুচকি হাসি এড়িয়ে অন্তু ধীর পায়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়লো। কেন যে ফারিয়াকে এসব কথা বলতে গেলো! মুকিদ ঠিকই বলেছিল...এই মেয়েগুলোর মাথায় ঘিলু একেবারে নেই। আর কোনোদিনই মেয়েদের সাথে বরফ-পানি খেলবো না----মনে মনে এরকম প্রতিজ্ঞাও করে ফেললো। আর ফারিয়ার সাথে তো কোনো কথাই বলবে না। খাবার টেবিলে ভাইয়া-আপু এর মধ্যে ওকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। খাবার টেবিলের হাসাহাসি প্লাইউডের দরজা ভেদ করে যেন ওর কানে এসে লাগছে। কাল নিশ্চয়ই স্কুলেও বন্ধুরা সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। আর ক্লারা ম্যাডাম তো রসিয়ে রসিয়ে সবাইকে শুনাবেনই, সেই সাথে হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে পেন্সিল রেখে যেই চিপা দিবে...সারা দিন ওই হাতে আর কিছু করা লাগবে না। আজকে মা সামনে ছিল বলে ম্যাডাম তার প্রিয় শাস্তিটা দিতে পারেনি।
এত্তো বড় বোকামিটা ও করলো কিভাবে? ভেবেই পাচ্ছে না। আর ফারিয়াটাও এত্তো গাধা...সব কথা কি ম্যাডামকে বলতে হয়? ও নাহয় ফারিয়াকে বিয়ে করবে বলেছে, কিন্তু সেটা তো বড় হলে করবে। এখুনি বিচার দেয়ার কি দরকার ছিল? গত বছর যখন এনুয়াল কালচারাল প্রোগ্রামে অন্তু চাষা সেজেছিল আর ফারিয়া ওর বউ সেজেছিল তখন থেকেই তো অন্তু ভাবছিল একদিন ফারিয়াকে বলবে। কিন্তু তখন বুঝতে পারেনি ও যে মেয়েরা এত্তো হাদা হয়।
২.
নতুন স্কুলটায় এই একটা জিনিস খুব ভালো। এখানে ফুল-প্যান্ট পড়তে দেয়, বাচ্চাদের মতো হাফ-প্যান্ট পড়তে হয় না। ও ক্লাস ফোরে উঠেছে, এখন তো আর ছোট বাচ্চাদের মতো হাফ-প্যান্ট পড়ে ঘুরা যায় না। মাকে কত্তোদিন বলেছিল ও ফুল-প্যান্টওয়ালা স্কুলে যেতে চায়। সবচাইতে ভালো হতো টিভিতে যে স্কুলটা দেখায়, ওই যে পুলিশের মতো ড্রেস থাকে....ওইটায় পড়তে পারলে। কিন্তু বাবাকে এই কথা কে বুঝাবে! বাবা বলেছে ওই পুলিশের ড্রেস পড়া স্কুল না,এইটাই নাকি দেশের সেরা স্কুল। কে জানে! তবে কাঠ-ফাটা রোদ্দুরে এভাবে গাদাগাদি করে পিটি করতে ওর ভালো লাগে না। আগের স্কুলে রৌদ্র বেশি থাকলে পিটি করতে হতো না। টিচাররাও এরকম ভয়ংকর ভাবে বেত হাতে নিয়ে ঘুরতো না। পুরোনো স্কুলের কথা ভাবতেই কান্না পাচ্ছে যেন একটু... বাসায় কম্পলেইন না গেলে হয়তো ওকে স্কুল ছাড়াতোও না মা... কেন যে ফারিয়া হাদাটাকে বিয়ের কথা বলতে গিয়েছিল!
তবে নতুন স্কুলেও ধীরে ধীরে অন্তুর বেশ ভালো লাগতে থাকে। এখানে অনেক বন্ধু হচ্ছে ওর। ফারিয়ার মতো হাদা কোনো মেয়েও নাই। অবশ্য কোনো মেয়েই নাই... তাতে কি? ও তো প্রতিজ্ঞা করেছেই...মেয়েদের সাথে আর কক্ষণো খেলবে না। ওর কোনো মেয়েবন্ধুরই দরকার নেই।
৩.
পরীক্ষা জিনিসটা কে আবিষ্কার করেছে সেটা জানলে সাত সমুদ্র তের নদী পার করে হলেও ওই ব্যাটা ফাজিলকে দুইটা কিল-ঘুষি মেরে হাতের সুখ মেটাতো...আফসোস। তবে মাঝে মাঝে যখন রেজাল্ট আশার চাইতে ভালো হয়ে যায়, তখন মনে হয় পরীক্ষা জিনিসটা একেবারে খারাপ না। এখন ঠিক তেমনি অবস্থা অন্তুর। পুরো বাসা ওকে মাথায় তুলে নাচে পারলে। এস,এস,সি পরীক্ষার রেজাল্টে ও ভাইয়া আপুকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেই আপু খোঁচা দেয়া ছাড়া কখনো কথাই বলতো না, সেই আপু আজকে ওকে এতো দারুণ একটা গীটার গিফট করেছে যে খুশিতে আপুর উপর জমানো সারা জীবনের সব রাগ ঝেড়ে ফেলে দিল। হবসনের এই জোস গীটারটা দেখে ওর বন্ধুরাও সব টাশকি খেয়ে যাবে।
ওর খুশি খুশি চেহারা দেখেই বুঝি আপু জিজ্ঞেস করেই বসলো, “কিরে? গীটার পছন্দ হয়েছে তো?” খুশিতে অন্তুর তখন দম বন্ধ প্রায়। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে দিলো। “মজার কথা কি জানিস? আজকে গীটার কিনতে গিয়ে মুকিদের সাথে দেখা হলো। তোর মনে আছে মুকিদের কথা?” আপু জিজ্ঞেস করলো। “হুমম...দেখে চিনলে কিভাবে? আমি তো মনে হয় চিনবো না!”, অন্তু কিছুটা অবাক হয়েই বললো। “তা অবশ্য ঠিক, তুই চিনবি কিভাবে? ব্রিলিয়ান্ট মানুষজন, কবে আপুকেই ভুলে যাবি!” শুরু হয়ে গেলো আপুর খোঁচানি। কোনো কথাই মনে হয় আপুটা খোঁচানো ছাড়া বলতে পারে না।
রাতে ছাদে গীটার সন্ধ্যা হয়ে গেল...আপু টুকটাক আ উ করে কিছু একটা গাইলোও(ভালোই গেয়েছিল, সেটা বললে আবার ফুলে যাবে)। অনেকদিন পরে বাসার সবাই খুশি। এরকম দিন জীবনে কয়টা আসে? ঘড়ির কাঁটা যখন নয়টার দিকে, আস্তে আস্তে তখন সবাই খেতে নেমে গেল। একটু পরে আসছি বলে ছাদেই রয়ে গেলো অন্তু। টুং-টাং গীটারের তারগুলো নাড়িয়ে যাচ্ছিলো আনমনে......মুকিদ! কতোদিন পর ওদের কথা মনে পড়লো... আপুর কথায় এক ঝটকায় যেন ফিরে এলো সেই শৈশব...প্যান্টের ইন খুলে মাসুদের সেই ক্ষুদে মাস্তান ভাব, দুই বেনী দুলিয়ে তিতলীর কি সে দৌড়...মুকিদের কোকড়া মাথার চুল ধরে সবার টানাটানি...আর কালো বো-টাই পড়ে টিভির বাচ্চাগুলোর মতো হাত-মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ওদের সবার রাইমস...আহ শৈশব!
খাবার টেবিলে অন্তু আপুকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “আপা, মুকিদের কোনো ঠিকানা-ঠুকানা রেখেছো?” “নাহ, তুই চিনতেই পারবি না ভেবেই তো আর ঠিকানা রাখলাম না”, আপু স্বভাবসুলভ খোঁচা দিয়েই জবাব দিল। বাবা কথার মাঝেই বলে বসলো,“তোর মনে আছে অন্তু, তুই সেসময় কতো দুষ্ট ছিলি? তোর মা তোর চিন্তায় পাগল হয়ে যেত...”। পুরো খাবার টেবিল বাবা ভাইয়া আর আপুর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মাও মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। অন্তু কিছু বললো না, মাথা নিচু করে খেতে লাগলো।
রাতে ঘুমাবার সময় নিজেই অবাক হয়ে গেল...মুকিদ, তিতলী, মাসুদ... সবার কথা মনে পড়লো, ফারিয়াকে একবারও ওর মনে পড়লো না! অথচ এই ফারিয়াকে বিয়ে করবে বলাতে কি সে লংকা কান্ড ঘটে গিয়েছিল। মুকিদের কথা বলে আপু যেন এক স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিল...কোথায় লুকিয়ে ছিল এতো কথা। এতোদিন একটুও মনে পড়লো না! আপুর কথা কি সত্যি হতে পারে? এমন কি হবে যে মুকিদকে হয়তো ও চিনতে পারবে না...ফারিয়াকে প্রথম দেখে হয়তো পাশ কেটে যাবে! হঠাৎ করেই ফেলে আসা শৈশবের জন্য এত্তো মায়া লাগতে লাগলো...হয়তো সবকিছু অন্যরকম হতো যদি হাদা মেয়েটা সব কথা ম্যাডামকে বলে না দিতো। কিরকম অন্যরকম হতো?
৪.
“নাহ...কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা আসে না রে। কেউ প্রেম করে, কেউ প্রেম দেখে। আমি প্রেম দেখাদের দল”, অন্তুর কথায় আড্ডাতে হাসির রোল পড়ে গেল। প্রশ্নকর্তা সাজিদ কিন্তু বেশ সিরিয়াস। বললো, “অন্তু, ফাজলামি না। সিরিয়াসলি বুকে হাত দিয়ে বল, জীবনে কারো প্রেমে পড়িসনি কখনো?” “তার আগে এক গল্প শোন। মার্ক টোয়েনকে একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি ধূমপান ছাড়বেন না? মার্ক টোয়েন জবাব দিলো, সে তো আমি প্রতিদিনই ছাড়ি”, একটু থেমে সাজিদের দিকে মুচকি হেসে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো অন্তু, “কি বুঝলি?” তাশফিক বলে উঠলো, “সাজিদ, তুই অন্তুরে চিনলি না? ভার্সিটির সিনিয়র জুনিয়র কোন মেয়েরে আবার ওর পছন্দ হয় না? ঘন্টায় ঘন্টায় নতুন নতুন প্রেমে পড়ে। ওরে সিরিয়াসলি প্রেমের কথা জিগানোই বেকার প্রশ্ন।” অন্তুও হেসে উঠলো তাশফিকের কথা শুনে, শুধু সাজিদ মুখ ভোঁতা করে বসে রইলো, অন্তুর এই কথা ঘুরানোর স্বভাবটা বিরক্তিকর।
আস্তে আস্তে ওদের আড্ডাটা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো। কোথাকার কোন এক মেলা হচ্ছে... কোন সিনেমা যেন হল কাঁপাচ্ছে...সেই সাথে ওদেরই কোনো এক বন্ধুর প্রেমের ব্যবচ্ছেদও সমান তালে চলতে লাগলো। মাঝে থেকে অন্তুটা শুধু চুপ মেরে গেলো। হঠাৎ হঠাৎ ওর “এমন হলে কেমন হতো” টাইপ ভাবনায় পেয়ে বসে...মনটা শৈশবে ছোটাছুটি করে। তখন মনে হয়, হয়তো ভালোবাসা গল্পে ছিল... ...
বিঃদ্রঃ [/s]কিচ্ছু না
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৮