somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“বৃষ্টির বেদনা-প্রজ্ঞায় নীল ...”

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




কম বয়সে হোস্টেলে থাকা ছেলেরা কি পরিমান চঞ্চল আর দুরন্ত দুষ্টের জ্যাঠামশাই,সেটা আপনি নিজ চোখে-খুব কাছ থেকে না দেখে,কল্পনাও করতে পারবেন না।তাদের সে দুষ্টামির মাত্রা বুঝাতে কি উদাহরন দিবো-সাত কূল ভেবেও তার কিনারা খুঁজে পেলাম না।এক্ষেত্রে আমরা কুকুর ছানার বলগা হরিণ,তিড়িং-বিরিং দুরন্তপনাকে কিছুটা বিবেচনায় নিতে পারি।যারা এমনি এমনি,একটা-আরেকটার পশ্চাদদেশে কামর দিয়ে ভোঁ দৌড়,চার পা ছড়িয়ে গড়াগড়ি,মোচর দিয়ে উঠেই দে ছুট,ধিরিম করে থেমেই একটা আরেকটার উপর হামলে পড়া এভাবেই সারাক্ষণ চলতে থাকে তাদের দুরন্তপনা।হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করা ছেলেদের দুষ্টামি-কুকুর ছানার দুরন্তপনাকেও হার মানায়।জামান সাহেব উত্তরার যে বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় ভাড়া থাকেন,সেই সাত তলা ভবনের পুরোটাই একটি বাচ্চাদের স্কুলসহ হোস্টেল।এবছর ছাত্র সংখ্যা কম হওয়ায় ছয়তলার দুটি ইউনিট স্কুল কর্তৃপক্ষ ভাড়া দিয়েছে তাতে জামান সাহেব এবং জাহিদ সাহেব নামে আরেক ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে পাশাপাশি থাকেন।জাহিদ সাহেব সে স্কুলেই অ্যাকাউন্টসে চাকুরি করেন।বছরের মাঝামাঝি জামান সাহেবের প্রাইভেট জবটা হঠাৎ চলে যাওয়ার আর্থিক টান-পোড়ন আর কিছুটা কম ভাড়া হওয়ার কারেনে মাস ছয়েক হলো এ বাসায় উঠা।


চাকুরি না থাকায় জামান সাহেব,বাসার বাজার,নিজের সপ্তম শ্রেণী পড়া ছেলে বিত্ত আর চতুর্থ শ্রেণী পড়া মেয়ে কৃতীকে মাঝে -মধ্যে স্কুলে নেয়া-আসা আর বিকেলবেলা মাঝেসাজে হাঁটতে বেরুনোর সময়টুকু বাদে সারাক্ষণ বাসায় বসে নেটে বিডি জবস,ফেসবুক,পত্রিকা এই নিয়ে পড়ে থাকেন।বেশী সময় বাসায় থাকার কারনে হোস্টেলের ছেলেদের বাঁদরামিটা ভালকরেই খেয়াল করেছেন।সিঁড়িতে উঠা নামার সময় প্রায়ই হুট করে কেউ কেউ গায়ের উপরে এসে পড়া,গেট দিয়ে ঢুকার সময় মাঝে মধ্যেই কেউ কেউ উপর থেকে তার ছেলেমেয়েদের গায়ে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দেয়া এধরেনের নানা বাঁদরামির কারনে জামান সাহেব,হোস্টেলের ছেলেদের উপর কিছুটা বিরক্ত হলেও,তার বাচ্চাদের বয়সী ছোট ছোট ছেলেদের,আপনজন ছেড়ে হোস্টেলের নির্বাসিত জীবনের কষ্ট বেদনার কথা মনে করে সারাক্ষণ তাদের প্রতি আপনজনের মতো একটা সহানুভুতির টান অনুভব করেন।এ বেদনার কথা তিনি তার স্ত্রীকে প্রায়ই বলেন,শুনে তার স্ত্রী উল্টো তাকে হুংকার দেয়,যে হারে সিগারেট টানছ,তুমিতো মরবেই,আর তোমার বাচ্চাদের অবস্থাও হবে হোস্টেলের ছেলেদের পরিনতি।শুনে জামান সাহেবের বুকটা হাহাকার করে উঠে।

আশা-যাওয়ার খেয়ালে হঠাতই একদিন থমকে গেলেন জামান সাহেব।বাসায় ফিরছিলেন বিকেল সাড়ে তিনটা নাগাদ,এ সময়টা হোস্টেলের ছেলেদের বিশ্রামের।নিচতলা অফিস, দু’তলা তিনতলা ক্লাসরুম,চতুর্থ পঞ্চম ও সপ্তম তলা হোস্টেল।পাঁচতলার বারান্দায় পা দিতেই দেখলেন সিঁড়ির মাঝামাঝি ভীষণ রকম সুন্দর চেহারার সাত-আট বছরের একটা ছেলে সিঁড়ির গ্রীলধরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে অঝরে চোখের জল ফেলছে।এই দৃশ্য জামান সাহেবের মনে ভীষণ ছুঁয়ে গেলো।তিনি দৌড়ে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,কি হয়েছে বাবা কাঁদছো কেন,বাবা-মা’র কথা মনে পড়েছে?চলো আমাদের ঘরে কম্পিউটারে গেমস খেলবে।ছেলেটি কিছুতেই রাজী হলোনা আমার বাসায় যেতে।তবে কাঁদছো কেন বাবা? “বৃষ্টি,মানে তার ছোট বোনের কথা মনে করে কাদছে” মিহি সুরে জবাব দিল সে।দেখো,সামনে শুক্রবারেই তোমার বৃষ্টি আপুমনির সাথে দেখা করার ব্যবস্থা আমি নিজে করবো,এখন রুমে চলো বাবা রেস্ট নিবে,সুপার দেখলে বকা দিবে।এই বলে সেদিন তাকে রুমে যেতে বলতেই সুবোধের মতো রুমে ফিরলো সে।ছয়তলা,মানে জামান সাহেবের বাসায় ফিরে,তার স্ত্রীকে ঘটনা জানালেন।লুসি(জামান সাহেবের স্ত্রী) বললো,ওর নাম প্রজ্ঞা।বছর খানেক হলো এখানে থাকে।হোস্টেলের সব দুষ্ট ছেলেদের মধ্যে সে সাংঘাতিক ব্যতিক্রম,অসম্ভব শান্ত স্বভাবের।কখনও এঁকা সিঁড়িতে,অথবা নীচতলার অজুখানার পাশে খালি জায়গার গ্রীল ধরে উদাস মনে শুন্যে তাকিয়ে থাকে প্রায়ই।


প্রজ্ঞারা দুই ভাইবোন।বৃষ্টি নামে তার চার’বছর বয়সী এক ছোটবোন আছে।দেশের বাড়ি টাঙ্গাইল সদরের আকুর-টাকুর পাড়ায়।মা নেই,বাবা বজলুর রশিদ,বিরাট আড়তদারির ব্যবসার ব্যস্ততায় তাদের সময় দিতে পারেননা।ছোট মেয়ে বৃষ্টিকে বাবার মেঝুবোনের কাছে রেখে,তাকে উত্তরার এই স্কুলে পড়তে দিয়েছে।তাই তার হোস্টেলের বন্দী জীবন৭১ এ বজলুর রশিদ দশ বার বছরের শিশু ছিল।বাবা আব্দুর রশিদের বাজারে ছোট মুদি দোকান ছিল।ছোট দুইবোন হ্যাপি ইতি মা ছিলেন গৃহিণী।যুদ্ধের সময়টায় বজলুর মা সাত মাসের গর্ভবতী আবস্থায়।মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আদান প্রদানের দায়ে একদিন বজলুর বাবাকে পাক হানাদারেরা ধরে নিয়ে হত্যা করলো।লাশটা তারা পায়নি।তার কিছুদিন পরেই মা,ছোটবোন মিনতি জন্মের সময় মারা গেলে-বজলু পৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে গেল।
দেশ স্বাধীনের পর সে বাজারে বাবার মুদি-দোকান মেরামত করে কোন রকম কষ্টে শিষ্টে ছোট তিন বোনকে আগলে রেখে বড় করে,একসময় সুপাত্রস্থ করলেন।এখন সে অনেক বড় ব্যবসায়ী।সংগ্রামের কঠিন পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বয়স যখন চল্লিশ,তখন সে বিয়ে করে।মহল্লারই মেয়ে পুতুলকে বিয়ে করে সে।পুতুল তারচেয়ে বিশ বছরের ছোট।বউকে বজলু জান দিয়ে ভালোবাসে,যদিও সে শুনেছে পাড়ার এক উঠতি মস্তানের সাথে পুতুলের প্রেম-ঘটিত ব্যাপার ছিল।তাতেও কিছু মনে করেনি সে,অমন বয়সে আজকালকার ছেলেমেয়েরা একটু একটু প্রেম টেম করেই-এটা খুববেশী দোষের না।সংসার সন্তানাদি হলে সবই ঠিক হয়ে যায়,একসময়।কিন্তু পুতুল তার বাবার বয়েসি স্বামী বজলুকে কিছুতে সহ্য করতে পারেনা।তাই বিয়ের দেড় বছরের মাথায় সন্তান নেয় বজলু,ভেবেছিল সন্তান হলে ঠিকঠাক হয়ে যাবে।কিন্তু বজলুর সে বিশ্বাস ভুল ছিল।প্রজ্ঞার জন্মের পর,পুতুলের বাড়াবাড়ি আচরন আরও দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়ে যায়।অনেক বোঝানোর পরও কিছুতেই তাকে,তার পূর্ব প্রেমিকের কথা ভুলানো যাচ্ছে না।এই নিয়ে বজলুর বুকটা সারাক্ষণ চিনচিন করতো।কিন্তু কোনদিনই সে স্ত্রি’র সাথে খারাপ আচরন করতো না।মনের কষ্ট গভীরে চেপে রেখে,স্ত্রী’র মনোযোগ পাওয়ার আশায় দিনদিন আরও বেশী ভালবাসতে লাগলেন স্ত্রীকে।তবুও স্ত্রি’র মন,পুরনো প্রেমিক থেকে ফেরানো যাচ্ছিলনা।অবশেষে মেয়ে বৃষ্টি জন্মের একবছরের মাথায় সে স্বামী সন্তান সবাইকে ফেলে পুরনো প্রেমিক,যে এখন অনেক বড় নেতা,তারসাথে পালিয়ে যায় একরাতে।তাই বৃষ্টি-প্রজ্ঞার মা,থেকেও নেই।


আগামীকাল থেকে প্রজ্ঞাদের বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে।জামান সাহেব শুনেছেন-সকালেই তার বাবা,তারসাথে দেখা করতে এসেছিল।সারাদিন একসাথে থেকে-খেয়ে,ঘুরে ফিরে-প্রজ্ঞার জন্য অনেক কেনাকাটা শেষে বিকালে বাসায় ফিরে গেছে।সন্ধ্যায় সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় জামান সাহেব দূর থেকে তাকে খুব হাসিখুসি দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল।রাত ন’টায় তিনি বাসায় ফেরার সময় স্কুলের গেঁটে অ্যাকাউন্টস জাহিদ সাহেবসহ আরও কয়েকজন টিচারকে দেখলাম জটলা করে কি যেন পরামর্শ করছে।এগিয়ে কাছে যেতেই জাহিদ সাহেব তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,একটু আগেই প্রজ্ঞার বাবা ব্রেইন স্টোকে মারা গেছেন।খবরটা শুনে জামান সাহেবের বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথায়-কুঁকড়ে উঠলো।কিছুতে সহ্য হচ্ছিলনা।তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পাড়লেন না।মনে হচ্ছিল সারাটা আকাশ মাথার উপর আছড়ে পড়লো।চারদিক অন্ধকার দেখতে পেলো সে।


কিছুক্ষন পর প্রজ্ঞার রুমে জামান সাহেবসহ কয়েকজন গেলেন।রুমে ঢুকেই তারা দেখলেন,প্রজ্ঞা তার পড়ার টেবিলে বাবার ছবি সামনে রেখে-গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছে।সবার চোখ জলে ভিজে গেলো।জামান সাহেব প্রজ্ঞার কাছে গিয়ে পিঠে হাত রেখে বললেন,প্রজ্ঞা,বাবাকে দেখতে যাবো-চলো,বাবা খুব আসুস্থ।প্রজ্ঞা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে শুধু জামান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল-অনেকক্ষণ।তারপর পড়ার টেবিল ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো,চল-যাই।এই অগ্রাহায়নেও,বাইরে অঝোর ধারায় তুমুল বৃষ্টি পড়ছিল তখন....।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৩
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×