ধর্মীয় বানীর একটা শব্দের অর্থ এবং তার তাৎপর্য নিয়ে দুই দল ধর্মবিশ্বাসীর ভেতরে সহিংসতার অনেক নজির থাকলেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের শব্দ বিন্যাস এবং সেসবের তাৎপর্য নিয়ে দুই দল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের ভেতরে কখনও কোনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাস নেই।
একটি ধর্মাচারণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মতবিরোধে ধর্মবেত্তাদের হত্যা করার নজির থাকলেও বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতির ভিন্নতায় কখনও প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে নি, তারপরও আমি বুঝি না কেনো ধর্মকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণিত হতে হবে? ধর্ম এবং বিজ্ঞানের ভেতরে সুদুর অতীতে কোনো এক সময় এক ধরণের ঐক্যবদ্ধতা থাকলেও গত ৫ শতাব্দীতে ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটো ভিন্ন ধারায় বিকশিত হচ্ছে, ধর্মের বিকাশ ধর্মপুস্তকের বানীর বিস্তার ও ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ কিন্তু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, যেকোনো বিষয় নিয়েই বিজ্ঞান কাজ করছে এবং কাউকে নতুন কোনো বিষয় উদ্ভাবন কিংবা নতুন কোনো ভাবনা বিস্তারের জন্য হত্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয় নি।
প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্য ধ্বংস করে যখন নিউটনের ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো তখন নিউটনের ধারণায় বিশ্বাস স্থাপনকারী কেউই নতুন ধারণায় বিশ্বাস স্থাপনকারীদের হত্যা করতে অস্ত্রে শান দেয় নি।
ধর্ম বিশ্বাসের উপরে টিকে থাকে, বিশ্বাস যুক্তিনিরপেক্ষ, বিশ্বাসী নিজের বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা গরিমা প্রমণা করতে যুক্তি উৎপাদন করে, যৌক্তিক লড়াইটা বিশ্বাসের মৌলিক ভিত্তিকে অনড় রেখে চলতে থাকে কিন্তু যুক্তিনির্ভর বিশ্বাস এক ধরণের কাঁঠালের আমসত্ব, তার অস্তিত্ব কল্পনা করা কঠিন।
বর্তমানে বিজ্ঞানের প্রসারে বিশ্বাসী ধর্মকে বিজ্ঞানসিদ্ধ করবার প্রবল প্রয়াসে লিপ্ত, কিন্তু বিজ্ঞান কখনও ধর্মের সীমানায় হানা দিয়েছে এমন না, বিভিন্ন সময়ে ধর্মবিশ্বাসী এবং ধর্ম অবিশ্বাসীদের ভেতরে যৌক্তিক লড়াই হয়েছে, ভীষণ রকম বাদানুবাদ হয়েছে, ধর্মবিশ্বাসী বিজ্ঞানসিদ্ধ নয় বলে ধর্মকে ছুড়ে ফেলে নি বরং নিজের বিশ্বাসের পক্ষে অটল যুক্তি খুঁজে না পেয়ে নিজেই ধর্ম পরিত্যাগ করেছে।
কেউ সংশয়ী, কেউ বিশ্বাসী কেউ অবিশ্বাসী কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব জীবন দর্শণ রয়েছে, সে জীবন দর্শণে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে সামাজিক স্থিরতা ও সামাজিক লেনদেনের শর্তও যুক্ত, যারা একদা প্রবল ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন তারা একটা পর্যায়ে ধর্মে আস্থা রাখতে পারেন নি, আবার একদল মানুষ বৈজ্ঞানিক ধারণা অনুসরণ করতে গিয়ে কোথাও খেই হারিয়ে প্রবল ধর্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন, কিন্তু কেউই নিশ্চিত বলতে পারে না তারা বিজ্ঞানে ইশ্বরের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করেছে কিংবা ইশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করেছে।
প্রত্যেকের নিজস্ব খোঁজ ছিলো, তার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা- অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিজস্ব সংশয় ছিলো, যারা ধর্মে আশ্রয় খুঁজেছিলেন তারা ধর্মে তার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে তেমন শক্ত কিছু খুঁজে পান নি, তারা ধর্ম ত্যাগ করেছেন, যারা বিজ্ঞানে নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা খুঁজছিলেন তারা এক সময় বিজ্ঞানেও আস্থা হারিয়েছেন, কিন্তু অপরাপর যারা আস্থা হারায় নি তারা কেউই সেইসব আস্থা হারানো মানুষদের প্রতি কোনো সহিংস আচরণ করেন নি।
সম্প্রতি হিগস বোসনের অস্তিত্বের সপক্ষে প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তারা গত ৫০ বছর ধরে এর অস্তিত্ব অনুমাণ করছিলেন, সেই অস্তিত্বের উপরে ভিত্তি করে তারা তত্ত্বকে আরও প্রসারিত করেছেন কিন্তু যদি ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হয় হিগস বোসন আসলে অস্তিত্ববিহীন তারা এই ৫০ বছরের অর্জনের পুনর্মূল্যায়ন করে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করবেন।
আমাদের মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হলো সে বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক থাকলেও কি প্রক্রিয়ায় সেটা বিকশিত হয়েছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভেতরে তেমন মতভেদ নেই, সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন বিদ্যমান পর্যবেক্ষণগত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক অনুমাণ হলো সুদুর অতীতে কোনো এক সময় বিগব্যাং হয়েছিলো, এর পর থেকেই মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে- বিগব্যাংবিহীন মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক কল্পনাও বিদ্যমান,
এখন কসমোলজি বলছে বিগব্যাং হয়েছে এবং মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে- সুতরাং বিভিন্ন ধর্মপুস্তকে বিভিন্ন বানী খুঁজে বিশ্বাসীরা বলছেন সেখানে অতীতে ইশ্বরই নিজ বানীতে বলেছেন মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে- সে প্রসারণের ধরণও তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে পরবর্তীতে যদি মহাবিশ্ব প্রসারিত না হয় কিংবা বিগ ব্যাং এর ধারণাটাই নাকচ হয়ে যায়, যেমনটা নিউটনের ধারণার ক্ষেত্রে ঘটেছে, তাহলে পুনরয়া বিশ্বাসীরা ধর্মপুস্তক খুলে খুঁজে পাবেন ইশ্বর বলেছেন মহাবিশ্ব স্থির- জনপ্রিয় ধারণায় বিশ্বাসীর বিশ্বাস প্রভাবিত হয়- বিজ্ঞান এমন ধারণাগত সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করছে না।
তারপরও বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে প্রমাণের চেষ্টা আমাকে আশ্বস্ত করে, যুগটা যে বিজ্ঞানের এবং প্রকৃতি বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক কাঠামোই একমাত্র কার্যকরী কাঠামো এ বিশ্বাসটা ধর্মবিশ্বাসীদের ভেতরেও বিদ্যমান, ইশ্বরের বিশ্বাসের পাশাপাশি এ বিশ্বাসও তাদের ভেতরে তৈরি হচ্ছে, পরবর্তীতে তারা পারস্পরিক সহিংসতারঅভ্যাসটুকু ত্যাগ করতে পারলেই ব্যক্তিগত বিশ্বাস হত্যাপ্রবণ হয়ে উঠবার অভ্যাসটুকু কাটিয়ে উঠবে তারা