আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ৮১তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত কবি
শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ছদ্দ নামে লেখালেখি করতেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম প্রধান কবির কবিতার ছন্দে, গন্ধে, ভাষা প্রয়োগে এবং অর্থে কেউ কেউ তাঁকে জীবনানন্দ দাশের শেষ উত্তরসূরী হিসেবও অভিহিত করে থাকেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম, "যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো"। যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওআজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন। আজ কবির ৮১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৩৩ সালের আজকের দিনে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বাহারু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের আলোচিত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর (মতান্তরে ২৫ কিংবা ২৬ নভেম্বর) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বাহারু গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম কমলা দেবী। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান এবং নানার বাড়িতে বড় হন। তিনি ১৯৪৮ সালে কোলকাতার বাগবাজারে আসেন এবং সেখানে একটি স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন এবং সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। একই সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। পাস করার পর তিনি বাংলা সাহিত্যে অনার্স করার উদ্দেশ্যে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু দারিদ্রের কারণে তিনি স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়েন, এবং সাহিত্যকে জীবিকা করার উদ্দৈশ্যে উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। তার প্রথম উপন্যাস কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সাথে তাঁর বনাঞ্চল-কুটির চাইবাসায় আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় একজন সফল লিরিকাল কবিতে পরিণত হন। একই দিনে বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলার অভ্যাস গড়ে ফেলেন তিনি। নিজের কবিতাকে তিনি বলতেন পদ্য ।
১৯৫৬ সালের মার্চে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় তাঁর যম কবিতাটি ছাপা হয়। পরে তিনি কৃত্তিবাস ও অন্যান্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। এরই মধ্যে বুদ্ধদেব বসু তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু এখানেও তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায় চৌধুরী, মলয়রায় চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়। আর্তি বা কাতরতাশব্দগুলো মতাদশর্টিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন। শেষোক্ত তিনজনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের কবিসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও শক্তি চট্টোপাধধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হতো, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন এর ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৬৬ সালে সেই মনোভাব প্রকাশ করে সম্পাদকীয়ও লিখেছিলেন। আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায়। নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরাব তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশিত উল্লেখোগ্য কাব্যগ্রন্হঃ ১। এ প্রেম হে নৈঃশব্দ্য (১৯৬২), ২। ধর্মে আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭), ৩। সোণার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮), ৪। অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার (১৯৬৮), ৫। হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (১৯৬৯), ৬। চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৯৭০), ৭। পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি (১৯৭১), ৮। প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২), ৯। সুখে আছি (১৯৭৪), ১০। ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫), ১১। অস্ত্রের গৌরবহীন একা, ১২। জ্বলন্ত রুমাল, ১৩। ছিন্নবিচ্ছিন্ন, ১৪। সুন্দর এখানে একা নয় (১৯৭৬), ১৫। কবিতায় তুলো ওড়ে, ১৬। ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯), ১৭। আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল (১৯৮০), ১৮। প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১), ১৯। যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩), ২০। কক্সবাজারে সন্ধ্যা (১৯৮৫), ২১। ও চির - প্রণম্য অগ্নি, ২২। মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয়, ২৩। সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার (১৯৮৬), ২৪। এই তো মর্মর মুর্তি (১৯৮৭), ২৫।বিষের মধ্যে সমস্ত শোক (১৯৮৮), ২৬। আমাকে জাগাও (১৯৮৯), ২৭। ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১), ২৮। জঙ্গলে বিষাদ আছে (১৯৯৪), ২৯। বড়োর ছড়া, ৩০। সেরা ছড়া, ৩১। টরে টক্কা (১৯৯৬), ৩২। কিছু মায়া রয়ে গেল (১৯৯৭), ৩৩। সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯) এবং পদ্যসমগ্র - ১ম থেকে ৭ম খণ্ড। কবিরপ্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আনন্দ পুরস্কার ও সাহিত্য একাডমি পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
জীবিকার জন্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সাক্সবাই ফার্মা লিমিটেডে স্টোর সহকারির চাকরি করতে হয়েছে। কিছুকাল তিনি ভবানিপুর টিউটোরিয়াল হোমের হ্যারিসন রোড শাখায় শিক্ষকতাও করেছেন। কিছুদিন ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে সফল হতে না-পেরে, একটি মোটর কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই তিনি ঠিক মন বসাতে পারেননি। ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৬১ বছর। দৈহিকভাবে তার মৃত্যুহলেও তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তাঁর পাঠকদের, তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে। আজ কবির ৮১তম জন্মবার্ষিকী। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে অন্যতম প্রধান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?
কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।
এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন
একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!
ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে
একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী
গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন
একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!
ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...
ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।
মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন