somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন কল্পক

২১ শে জুন, ২০১২ রাত ৯:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটা পেয়ালায় ছয়টা বিস্কুট দেয়া থাকলে কয়টা খাওয়া উচিত ? ‘ভদ্রতা’ দেখিয়ে একটা বা দু’টা রেখে দিব নাকি সবকটাই খেয়ে ফেলব ?

আসলে...আমার এই সমস্যাটা প্রায়ই হয় । ঠিক বুঝতে পারি না কোথাও যাওয়া হলে, কয়টা বিস্কুট বা কতটুকু চানাচুর খাওয়া উচিত । ‘ভদ্রতার কারণে কোথাও গেলে কেউ খাবার খেতে দিলে পুরোটা খাওয়া উচিত নয়’ – এই শিক্ষা আমার মা দিয়েছেন । আমি এই শিক্ষা পালন করতে গিয়ে একবার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে হাফ কাপ চা খেয়ে বাকিটা রেখে এসেছিলাম...ভদ্রতা প্রদর্শনের জন্য । কিন্তু তারপরেও মা আমাকে দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন, “তোর কি কোনোকালেই বুদ্ধি-শুদ্ধি হবে না ?”

আজকের কথা আলাদা । সকাল থেকে শুধু এক কাপ চা আর একটা সিগারেট খেয়ে আছি । এখন আছি আমার “হলেও হতে পারে ছাত্র”র বাসায় । টিউশনির খোঁজে । ছাত্রের মা আমার সামনে একটা প্লেটে ছয়টা বিস্কুট আর একটা পেয়ালায় কিছু চানাচুর দিয়ে গেছেন, প্রায় পনের মিনিট আগে । আর এগুলোর দিকে তাকিয়েই আমি এতোসব ভাবছিলাম । ভয়াবহ ক্ষিধে পেয়েছে । প্লেট থেকে একটা বিস্কুট তুলে নিলাম । ...নাহ । ড্যাম্প না ।... এর আগে যত বাসায় টিউশনির জন্য গিয়েছিলাম, সেসব বাসা থেকে প্রথম দর্শনে পানি...আর খুব বেশী হলে অল্প একটু চানাচুর দিয়েছে...যার বেশীরভাগই বাসী ।

টিউশনিটা আমার খুব দরকার । এমন না যে, আমার উপরে পুরো পরিবার নির্ভর করছে । আমার নিজের হাত খরচের জন্যই টাকাটা দরকার । বাবার যে অবস্থা, এই অবস্থায় তাঁর কাছে টাকার জন্য হাত পাতাটা ঠিক হবে না । আমরা তিন ভাই । আমিই সবার বড় । আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাইটা অসুস্থ । ওর চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে । এর মধ্যে আমি আর বাড়তি ঝামেলা বাড়াতে চাচ্ছিলাম না । তাই এই টিউশনির খোঁজ ।

ভদ্রমহিলা ভেতরের রুম থেকে বের হলেন । হাতে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি । গ্লাসটা আমার সামনের টেবিলে রেখে আমার সামনের সোফায় গিয়ে বসলেন । ...তারপর আমার ইন্টার্ভিউ নেয়া শুরু করলেন । কোথায় থাকি, কিসে পড়ি, ভাই-বোন কয়জন, বাবা-মা কে কি করে । মনে হচ্ছে যেন, আমি পড়াতে আসি নি,বিয়ে করার জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি ।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ আমি লেখাপড়া কেন ছেড়ে দিয়েছি তা নিয়ে ঘ্যান-ঘ্যান করলেন । আমার ছোট ভাই কিরকম অসুস্থ, কতদিন ধরে অসুস্থ, কোন হসপিটালে ভর্তি হয়েছে এসব জিজ্ঞাসা করলেন । আমি বিরক্তি চেপে উত্তর দিলাম । এরপর উনি জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, আমার মেজ ভাইটা কেন কথা বলতে পারে না, কবে থেকে পারে না, জন্মগত সমস্যা কি না – এসব । উনার দিকে তাকিয়ে আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম । যখন দেখলাম শাহেদ(আমার মেজ ভাই) এর কথা শুনে উনার মুখে একই সাথে খুব অবাক আর মজার কথা শোনার মত মুখভঙ্গি ফুটে উঠেছে ।

এতো সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি যখন একই সাথে রাগান্বিত, বিরক্ত এবং ক্লান্ত ...ঠিক সেই সময়েই তিনি বললেন, পরশু থেকে যাতে আমি পড়াতে আসি । সপ্তাহে চারদিন । রবি,মঙ্গল,বৃহস্পতি,শুক্র । বাংলা আর অংক । সকাল সাড়ে নয়টায় । মাস শেষে এক হাজার টাকা । আমি তো খুশিতে আত্মহারা ! এই উচ্চমূল্যের বাজারে এক হাজার টাকা অতি নগণ্য হলেও আমার কাছে অনেক কিছু । চকচকে পাঁচশ টাকার দুইটা নোট কল্পনা করেই মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠলাম । এতক্ষণ ধরে “আজাইরা প্যাঁচাল পাড়া মহিলা”কে মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষমা করে দিলাম । ...উত্তেজনার ঠেলায় অবশ্য ততক্ষণে আমি খেয়ালই করিনি, চিনামাটির পেয়ালায় থাকা সবগুলো বিস্কুটই আমি সাবাড় করে দিয়েছি । সেদিকে তাকিয়ে মা’র কথাটা আবার মনে পড়ে গেল । নাহ ! আমার আর ভদ্র হওয়া হল না ।
===================================
...ঢাকা শহরটা বেশ অদ্ভুত । মুখোশে ঢেকে রাখে এর প্রতিটি মানুষকে । প্রতিদিনই অনেক ধরণের মানুষ দেখি আমি । সবাই মুখোশ-ধারী । কেউ পরে ভালো মানুষের মুখোশ, কেউ খারাপ, কেউ অতি ভদ্র,কেউ অতিরিক্ত উগ্র । এদের কেউই জানে না যে, এরা আসলে কি । একেক সময় একেক রকমের মুখোশ পরে সবাই । আমি নিজেও মুখোশ-ধারী ।
আমার গলায় যে সানগ্লাসটা দেখতে পারছেন, এটা ফার্মগেট এর ওভারব্রিজের নিচ থেকে কেনা । গায়ের শার্টটা বঙ্গ বাজার থেকে কেনা প্রায় বছর তিনেক আগে । শার্টের বাম হাতার উপরের দিকের ছেঁড়া অংশটা মা এতো সু-নিপুণভাবে সেলাই করে দিয়েছেন যে বোঝাই যায় না প্রায় । আমার এই শার্টটা খুব প্রিয় । আসলে আমার প্রতিটা শার্টই খুবই প্রিয় । মাঝে মাঝে শাহেদের গেঞ্জি পরেও বের হয়ে যাই । সাইজে একটু ছোট হয়...তাতে কি আসে যায় ! গায়ে তো দিতে পারছি । পা এর জুতো জোড়া কবে কিনেছি সেটা ঠিক মনেও পড়ে না । তলা খসে গেছে । বেশ কয়েকবার মুচির হাতে পরেছে ।
আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি মৌচাক মোড়ের ওভারব্রিজের উপরে । আমার ফিটফাট সাজা অবস্থায় দেখে কেউ বুঝবে না, এলাকার চা এর দোকানে বাকি রেখে এসেছি ছয়শ’ আটাত্তর টাকা । আজ দিব কাল দিবো করে এখনও দেয়া হয় নি । দোকানদারের নাম দেলোয়ার । আমি সহ এলাকার লোকজন তাঁকে ডাকি দেলু মামা । ভালো লোক । সবসময়ই হাসিমুখে চা,সিগারেট এগিয়ে দেন । অনেক সময় ফ্রিতেও খাওয়ান । চা,সিগারেট আর ফিল্টারের ঠাণ্ডা পানি বেঁচে খুব একটা আয় হয় না তাঁর । তারপরও আমি জানি এখনো যদি আমি তার দোকানে যাই, উনি নিজ থেকে খুব একটা জোরাজুরি করবেন না । আমি মনের সুখে চা এর কাপে চুমুক দিয়ে, সিগারেটে টান দিবো । উঠে চলে আসার সময় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে তিনি টাকা চাইবেন । আমি যদি বলি, বাকিতে লিখে রাখেন , তাতেও তিনি উচ্চবাচ্য করবেন না । কিন্তু আমি নিজে অপরাধ বোধে ভুগতে থাকব । তাই দেলু মামার সামনেই পড়তে চাই না । এখন টিউশনিটা পেয়েছি...কিছু টাকা পেলে ধারটা শোধ করে দিবো । এটা ভেবেই স্বস্তি হচ্ছে ।
ওভারব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে এসব রাজ্যের ভাবনা ভাবতে আগে ভাল্লাগে বেশ । কেন...সেটা জানি না । হয়তো এতো মানুষের এই অবিরাম, দুরন্ত চলাফেরা,তাড়াহুড়োটা দেখতে ভালো লাগে । সবার ব্যস্ততার মাঝে আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি । সেই সব ব্যস্ত মানুষগুলোর আমাকে দেখে ঈর্ষা করার কথা ।
একটা কথা হঠাৎ করেই মনে হতে লাগল, টেলিভিশনে যে সব তারুণ্যের বিজ্ঞাপন দেখায় তাদেরকে কত্তো হাসি-খুশি ভাবে দেখানো হয় । তারা বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, দু’তিনটা করে দামী মোবাইল থাকে তাদের এক এক জনের । তারা পার্টি দেয় । ভাষা দিবসে হাফ বাংলা, হাফ ইংরেজিতে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মানসূচক কথা বলে । কখনও কোনো বিজ্ঞাপনে দেখলাম না জুতার তলা খসে যাওয়া একটা মধ্যবিত্ত বেকার ছেলেকে সেই তারুণ্যেরই অংশ হিসেবে তুলে ধরতে । মনে হয়, আমার মত ছেলেরা তারুণ্যের অংশ হতে পারে না । নিজেকে প্রায়ই অবসর প্রাপ্ত বুড়ো কেরানীর মত মনে হয়...যিনি পেনশনের টাকার জন্যে ছেলের বয়সী বড় বড় অফিসারদের “স্যার,স্যার” বলে ফাইলে সাইন করানোর জন্য বলেন । মধ্যবিত্ততা আজ আমাকে অকালেই বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে ।

রিকশায় কপোত-কপোতীদের দেখা যাচ্ছে । সেদিকে তাকিয়ে আমার মোনা’র কথা মনে পড়ে গেল ।
মোনা । নারায়ণগঞ্জের মেয়ে । আমাদের বন্ধু রাসেলের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়া । মোনা ওর বাবার সাথে ঢাকায় আসে মাঝে মাঝে । হয় বেড়াতে, না হয় কেনা-কাটা করতে । রাসেলই একদিন মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল । সাধারণ আর দশটা মফস্বলের মেয়ের মতই । কিন্তু মেয়েটা একটু বেশীই লাজুক । মিটিমিটি করে হাসত সারাক্ষণ । একটা সময় এই হাসির জন্যই আমার কাল হল । বোকার মত একদিন সরাসরি মেয়েটার সামনে গিয়ে বলে ফেলি যে, আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি । মোনা’র মুখের হাসি সেদিন মিলিয়ে গিয়েছিল । যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে আমাকে বলেছিল, অপেক্ষা করতে । আমি সেদিন অপেক্ষা করেছিলাম । আর আজ মোনা আমার জন্য অপেক্ষা করে কবে আমি ওকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিব । মোনাকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব । কিন্তু সেটার জন্যেও অপেক্ষা করতে হবে।
অপেক্ষা... হায়রে অপেক্ষা ।

সিগারেট ধরালাম একটা । গোল্ডলিফ । চার টাকা একটা পিস । পোষায় না ঠিক । আরও কম দামী সিগারেটে অভ্যস্ত হতে হবে ।

পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম একবার । সব মিলিয়ে তেইশ টাকা । কেন যেন কোনো কারণ ছাড়াই হাসি পাচ্ছে আমার ।

হঠাৎ করেই কাপড়ের দোকানগুলো থেকে হৈ-চৈ শোনা গেল । একটু পরে একজন মহিলাকে দেখা গেল... কোলে একটা বাচ্চা । মা, ছেলে দু’জনেই কাঁদছে । নিচে নেমে এগিয়ে গেলাম । কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল মহিলার স্বামী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন আজ । উনার স্বামী সকালে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছেন । সকাল গড়িয়ে দুপুর, এখন প্রায় বিকাল হতে চলল । তার স্বামী আর আসেন না । মহিলাটার কাছে কোনো টাকাও নেই । বাচ্চাটা ক্ষিধেয় কাঁদছে । মহিলাও কি করবে বুঝতে না পেরে কেঁদে উঠছেন ।
হায়রে মানুষ ! সামান্য কিছু স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের সারাটা জীবন নষ্ট করে দিতেও দ্বিধা করছে না । আমাদের আশেপাশে এরকম মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই । সবাই স্বার্থপর ...সবাই । আচ্ছা......আমি নিজেও কি স্বার্থপর না ? আমার ছোট ভাই হাসপাতালে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে । আর আমি কি না, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেয়সীর কথা ভাবছি । হা হা হা ।

আস্তে আস্তে এগুতে লাগলাম । ৪ নম্বর লোকাল বাস ধরতে হবে । মৎস্য ভবনের সামনে নেমে বাকি পথ হেঁটে যাবো ।
==========================================
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতাল । “পিজি হাসপাতাল” নামে যেটা বেশী পরিচিত । এখানের ‘ডি’ ব্লকের তৃতীয় তালার হেমাটলোজী এন্ড অনকোলোজী ডিপার্টমেন্টের ১৪ নং সাধারণ কেবিনে শোয়েব এর চিকিৎসা চলছে । শোয়েব...আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাই । Lymphoblastic Leukemia নামক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ও আক্রান্ত । শোয়েবের রোগের প্রায় ছয় মাস পার হয়ে গেছে । ডাক্তাররা বলেছেন, আরও আড়াই বছর চিকিৎসা চালিয়ে গেলে রোগটা পুরোপুরি সারানো সম্ভব । ওকে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হাসপাতালে ভর্তি করা হল । ওরাডক্সিন নামক ঔষধ খাওয়ানোর ফলে গাল-মুখ ফুলে গেছে ওর । চেনাই যায় না । ...আমার মনে পড়ে যায় শোয়েবের অসুখে পড়ার আগের কথা । সারাটা ক্ষণ দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি করত । একটা মুহূর্তের জন্যেও থামত না । প্রতিদিনই কিছু না কিছু একটা ভাঙ্গত, নিজের হাত-পা কাটত । আজ যখন আমার সেই পিচ্চি ভাইটাকেই দেখি হাতে স্যালাইনের ব্যাগ লাগানো, ঘুম ঘুম চোখে শুয়ে থাকে হাসপাতালের বেডে ...তখন মনের মাঝে যে ধাক্কাটা লাগে সেটা আমি কেন, পৃথিবীর কোনো ভাইই বোঝাতে পারবে না ।
শোয়েবের রোগটা এক ধরণের ব্লাড ক্যান্সার । তাই ওর ওয়ার্ডটাও ক্যান্সার ওয়ার্ড । এখানে সবাই ঢুকতে পারে না, পুরুষদের আরও বেশী করে নিষেধ । দরজা দিয়ে ঢুকে অনেক দূর থেকে রোগীদের সাথে দেখা করতে দেয়া হয় । আজো আমি সেভাবেই শোয়েবকে দেখতে আসলাম । শোয়েব ঘুমাচ্ছে । মা বের হয়ে আসলেন । এতক্ষণে খেয়াল করলাম শাহেদও এসেছে । তাহলে বাবারও আসার কথা । কিন্তু আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না । মা, শাহেদ একসাথেই এগিয়ে আসল আমার দিকে । হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলাম ।
“শাহেদ কখন আসছে ? বাবা কোথায় ?”
“এইতো আসছে দুপুরের দিকে । তোর বাপ শাহেদকে দিয়েই ভাগছে ।” মুখ ঝামটা দিয়ে বলল মা ।
শাহেদ হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম । বেকার হয়েও আমার এই ভাইটাকেও সময় দেয়া হয়ে উঠে না আমার । শাহেদ মা’র মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । আমিও মা’র দিকে ফিরলাম ।
“ডাক্তার কি বলে ? শোয়েবের আর কত দিন থাকা লাগবে ?”
মা’র চোখমুখ তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠল । উত্তেজিত ভাবে বললেন, “শোয়েব তো আল্লাহর রহমতে অনেক ভালোরে । ওর রোগটা A.L.L.U.K যদি M.L.A হত, তাহলে আরও অনেক দিন লাগত । আল্লাহর অনেক দয়া ।”
“আমি তো এতো কিছু বুঝি না । ওর থাকা লাগবে কয়দিন ?”
“এড্রিয়ামাইসিন দিবে, তারপর এলাস্পা, তারপর আই টি । তারপর C.B.C রিপোর্ট আল্লাহ রহমতে ভালো আসলে বাসায় নিয়ে যেতে পারব ।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “হাসপাতালে থেকে থেকে তুমিও ডাক্তারদের মত কথা বলা শুরু করে দিয়েছ মা । কিছুই বোঝা যায় না ।” মা ও হাসলেন ।
“আচ্ছা তুই এতো শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন দিন দিন ? খাস না ঠিক ঠাক ? তোর বাবা তো বলল খুব ভালোই রান্না করা শিখছে । তুই খাস না কেন ?”
“বাবার হাতের রান্না খাইছো কোনোদিন ? তাহলে আর এই কথা বলতা না ।” কথাটা বলেই আমি, আর মা দুজনেই হাসতে লাগলাম । মা’র এটা একটা বড় গুণ । ছোট বেলা থেকেই বন্ধুর মত আচরণ করে এসেছেন আমাদের সাথে । এত হাসিখুশি, ফ্রি ভাবে কথা বলেন যে, মন খুলে সব কথাই বলা যায় ।
“আপেল খাবি ? তোর খালামণি অনেক গুলো ফল কিনে দিয়ে গেছে । আমি তো খাই না । শোয়েবও এতো গুলো খেতে পারবে না । শাহেদকে দিছি । তুইও খাবি... আয় ।”
আমি কিছু না বলে চুপচাপ মা এর পিছু পিছু গেলাম । আমার এই ছোট খালামণির কাছে আমরা তিন ভাইই খুব প্রিয় । খালা নিঃসন্তান । সব সময়ই আমাদেরকে নিজের ছেলের মত দেখেন । কিন্তু আমার খালু আবার সেটা পছন্দ করেন না । তাই ইচ্ছা থাকলেও খালা আমাদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারেন না ।
শাহেদকে দেখলাম কাঁচের দেয়ালের এপাশ থেকে একমনে শোয়েবের দিকে তাকিয়ে আছে । আমি ওর পাশে দাঁড়ালাম । স্যালাইনের একটা ব্যাগ থেকে নলের মাধ্যমে শোয়েবের গায়ে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে । স্যালাইনের ব্যাগটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওকে বাইরে আনা যাবে না । আমি আর শাহেদ হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকি । এত কাছে আমাদের ভাইটা । একবার কোলেও নিতে পারি না । কষ্টটাকে চাপা দিতে শিখেছি বেশ কয়েকদিন আগে থেকে । তাই নিজেকে সামলে নিলাম । কিন্তু শাহেদের চোখের জমে থাকা পানি আমার নজর এড়ায় না । সৃষ্টিকর্তা আমার এই ভাইটাকে কথা বলার ক্ষমতা দেন নি । তাই ওর মনে জমে থাকা বলতে না পারা কষ্টের কথাগুলো চোখের পানি হিসেবেই বেরিয়ে আসে ।
মা দুটো আপেল নিয়ে আসলেন আমাদের দুই ভাই এর জন্য । শাহেদ ইশারার মাধ্যমে মা’কে জিজ্ঞেস করল, শোয়েবকে আনা যাবে কি না । মা ও ইশারায় উত্তর দিলেন, রাতের দিকে স্যালাইন খুলে নেয়া হবে । তখন আনা যাবে । শাহেদ মাথা দোলালো । এর মানে বোঝা গেল, রাতের আগে আর ওকে হাসপাতাল থেকে সরানো যাবে না ।

রাত সাড়ে আটটার দিকে মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঔষধ কিনে আনলাম । চল্লিশ টাকার মত বেঁচেছে । ওটা ফেরত দিলাম না । বাসায় যাবার জন্য বাস ভাড়াটা লাগবে । মা কে বললেও দিতেন...তবুও নিয়ে রাখলাম ।

নয়টার দিকে শোয়েবকে বাইরে আনা হল । শাহেদ, শোয়েবকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল । হাসপাতালের লোকজন অনেকেই শাহেদের দিকে তাকিয়ে আছে । কিন্তু ও নিজের কান্নাটাকে লুকাতে চাইলো না । বারবার শোয়েবের মুখটাকে ধরে হয়তো কিছু একটা বলতে চাইলো । সে ভাষা আমি, আমরা কেউই বুঝতে পারি নি । আমি,মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শাহেদ,শোয়েবকে দেখতে লাগলাম ।

...নাহ । শাহেদকে আরও শক্ত হতে হবে । চোখের পানিতে বাঁধ দেয়া শেখাতে হবে । যেমনটা আমি করে আসছি বেশ কয়েক বছর ধরে ।
==========================================
বাসায় ফিরেই প্রতিদিনকার মত বাবার গালিগালাজ ।
“লাট সাহেব বাসায় ফিরছে । আহা ! কপাল কত ভাল আমার । তা এতো তাড়াতাড়ি ফিরলি ক্যান বাপ ? আরেকটু দেরী করতি । রাস্তাঘাটে কি মধু খুঁইজা পাস, সেইসব মধু খাইতি । রমনা পার্কে যাইয়া নেশা করতি । এত্তো তাড়াতাড়ি ফিরার কি দরকার ? তোর বুড়া বাপ মরলেই বা কি ?”
আমি কোনো কথা না বলে বাসায় ঢুকে পড়লাম । রাগ হয় । প্রচণ্ড । এই বয়সে এসেও বাবার গালাগাল সহ্য করতে হয় । ছোটবেলায় খুব অল্পতেই রেগে যেতাম । বাবার রগচটা স্বভাব থেকেই হয়তো পেয়েছি আমি এই গুণ(!) তবে দিনদিন নিজেকে শান্ত করতে শিখছি । সবই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয় ।
“রাতে রান্নার ব্যবস্থা কি ?”
“সেইটা নিয়া আপনারে ভাবা লাগবে না নবাবজাদা । আমার মত হতভাগা বাপ থাকতে তোর আর চিন্তা কি !”
আমি এবারও কিছু না বলে চুপ করে রইলাম । গত মাসের বাসা ভাড়া দেয়া হয় নাই । বাড়ি ওয়ালা ধান্দায় আছে কখন কি বলা যায় সেটা নিয়ে । বাবা ব্যবসায় বড় ধরণের লস খাওয়ার পর থেকে আমাদের এই বেহাল দশা । জানি না ভাড়া কিভাবে দেয়া হবে । বাবা কোনো না কোন ভাবে হয়তো ম্যানেজ করে ফেলবেন ।
আমি রান্নাঘরে গেলাম বাবা কি করছে সেটা দেখার জন্য ।
ডাল, চাল, লবণ, হলুদ নিয়ে বাবা কি যেন করছে । আমাকে দেখে হেসে বললেন, “আজ রাতে খিচুড়ি রান্না করব । দুনিয়ার সবচেয়ে সোজা রান্না এটা ।...সাথে ডিম ভাজি । একেবারে বেহেশতী খানা ।” বাবার কণ্ঠে কিছুক্ষণ আগের রাগ একেবারেই নেই ।
“আমি হেল্প করব ?”
বাবা সাথে সাথে দূরে সরে গিয়ে বললেন, “না নাহ । তুই ঝামেলা করে ফেলবি । পরে আর মুখেই দেয়া যাবে না ।”
আমি রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম । রান্নাবান্নায় বাবার এতো উৎসাহ,হাসিমুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, মাত্র কয়েক মাস আগে শেয়ার বাজারে শেষ সম্বল প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার লস হওয়ার পর বাবা প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল ।
রাতে খাবার সময় দেখা গেল ডিম একটা । অথচ আমরা মানুষ তিনজন । বাবা ডিম ভাজিটাকে দুই ভাগ করে এক ভাগ শাহেদের প্লেটে আর এক ভাগ আমার প্লেটে দিয়ে দিলেন । নিজে বেশী করে খিচুরি নিয়ে ঘোষণা দিলেন, তাঁর এতেই চলবে । আর এতো ভালো রান্না নাকি আমাদের মা কখনোই বানাতে পারেন নি । ...বাবার “বিখ্যাত” খিচুরি মুখে দিয়ে অবশ্য একটু গোলমাল দেখা গেল । লবণের পরিমাণটা মারাত্মক পরিমাণে বেশী মনে হল । বাবা একটু ইতস্তত করে বলতে লাগলেন, “লবণটা একটু বেশী পড়ে গেছে বোধহয় । লেবু দিলে ভাল হয় ।” বাসায় লেবু খুঁজে পাওয়া গেল না । বাবা বিব্রতভাবে বললেন, “একটু পানি ঢেলে খা । তাহলে খেতে পারবি ।” আমরা সেদিনকার মত পানি ঢেলে ‘পান্তা-খিচুরি’ খেলাম ।
আমাদের বাসায় দুটোই রুম । আর একটা ছোট স্টোর রুমের মত আছে । আমি সেই স্টোর রুমটাকে নিজের মত গুছিয়ে এনেছি । রুমটাতে কোনো জানালা নেই । তাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না । মাথার কাছে টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিয়ে এক ঘুমে রাত পার করে দেই । আজও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটল না ।
খুব ভোরে মৃদু কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার । রুম থেকে বেরিয়ে বাবার রুমে গিয়ে দেখি বাবা জায়নামাজে বসে নামাজ শেষে কিছু একটা বলে বলে কাঁদছেন । আমি ভালো মত কান পেতে শুনি বাবার কথা গুলো ।
“...আল্লাহ গো ...জীবনে অনেক পাপ করছি । অনেকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছি । কিন্তু তুমি আমারে সেই শাস্তি না দিয়া ক্যান আমার ছেলেটারে দিতাছো আল্লাহ । আমার এই বাচ্চা ছেলেটা কি পাপ করছিলো আল্লাহ । সারা বাসায় আমার এই বাচ্চাটা ঘুইরা বেড়াইতো । দৌড়াদৌড়ি করত । আজ ওরে ছাড়া বাসাটা কেমন মরা মরা লাগে । আল্লাহ...আল্লাহ গো...আমার পাপের শাস্তি তুমি আমারে দাও । আমার এই মাসুম বাচ্চাটার কষ্ট আর সহ্য হয়না গো আল্লাহ । ওর সব রোগ তুমি আমারে দাও আল্লাহ । তারপরও আমার বাচ্চাটারে সুস্থ করে দাও আল্লাহ । আল্লাহ গো...”
আমি সরে এলাম । কেন যেন হঠাৎ করে আমার এই বদমেজাজি, রাগী, কিপটে বাবাটার জন্য অনেক মায়া হচ্ছে । নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠলাম আমি । অনেক...অনেক দিন পর আমি কাঁদলাম । কাঁদতে বাধ্য হলাম ।
=========================================
কয়েক মাস পরের কথা...

শোয়েবকে এর মাঝে একবার বাসায় আনা হয়েছিল । কয়েকদিন আগে আবার C.B.C রিপোর্টে রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে...এরকম ধরা পড়েছে । তাই ওকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ।
আমার টিউশনি ভালোই চলছে । ছাত্র বেশ মেধাবী, মনোযোগীও । বুঝতেই পারছেন চার দেয়ালের মাঝে বন্দি অবস্থায় বেড়ে উঠে প্রায় রোবট হয়ে গেছে ।
টিউশনির টাকা দিয়ে দেলু মামার দোকানের পাওনা পরিশোধ করা হয়ে গেছে । মা’কে প্রথম মাসের বাকি টাকাটা দিয়েছি । এর পরের মাস থেকে শোয়েবের জন্য ওর কিছু কিছু ঔষধ কিনে দেই । ...এতদিনে নিজেকে সত্যিই একজন বড় ভাই এর মত মনে হয় ।
মানিকনগরে একজন শিল্পীর সাথে দেখা হয় একদিন । সেই এলাকাতে তিনি “শিবলু ভাই” নামে পরিচিত । একদিন তিনি প্রস্তাব দেন, তার ছবি আঁকা শেখানোর একাডেমীতে যোগ দিতে । মনের মত কাজ পেয়ে আমি আর দ্বিমত করিনি । গাধার মত খেটেও মাস শেষে খুব কম টাকা পাই তবুও অনেক দিন আগের মনের মাঝের সুপ্ত ইচ্ছাটা জেগে ওঠায় আমি ‘না’ করি না ।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষে আঁকাআকিতে আমার ভালো হাত থাকায়, ইচ্ছা ছিল চারুকলাতে ভর্তি হবার । কিন্তু আমার বাবার তাতে মত ছিল না । তিনি আমাকে জোর করে ভর্তি করিয়ে দেন প্রাইভেট একটা ইউনিভার্সিটিতে বি বি এ পড়াতে । প্রথম বছরটা কোনোমতে পার করলেও দ্বিতীয় বছরে এসে অথৈ সমুদ্রে পড়ি আমি । কিছুই বুঝতাম না ক্লাসে কি পড়ানো হচ্ছে না হচ্ছে । তাই শেষমেশ ভার্সিটিতে যাওয়াই বন্ধ করে দেই ।

এখন টিউশনির জন্য ছাত্রের বাসায় বসে আছি । পড়ানো শেষে বের হবার আগে আমার ছাত্রের মা এসে আমার সামনে একটা খাম তুলে দিলেন । একটু হলেও অবাক হই আমি । আজ ২৯ তারিখ । মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতন দেবার কথা না । আমি ভদ্র মহিলার দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, তিনি এই মাসে বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন । আমার বোঝার বাকি থাকে না আমি এই টিউশনিটা হারাতে যাচ্ছি । খামটা নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম ।
রাসেলের হোস্টেলে যাওয়া হয় না অনেকদিন । আজ যাওয়া যায় । মন-টন যদি তাতে একটু ভালো হয় । মোনারও খোঁজ নেয়া হবে ।

রাসেল ওর রুমের দরজা খোলার সাথে সাথে ওর পেটে ঘুষি হাঁকালাম । এটা আমাদের পুরনো রীতি । রাসেল আমার স্কুল জীবনের বন্ধু । এখন পর্যন্ত ওর সাথেই শুধু যোগাযোগ রাখা হয় ।
রাসেল পেট চেপে হেসে বলল, “আয় শালা । ভিতরে আয় ।”
“আমি শালা মানে ? শালা তো তুই । সালাম দে দুলাভাইকে ।”
হঠাৎ করেই রাসেলের মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল । গাল চুলকাতে লাগল । ওর উদ্বিগ্ন-ভাবটা চোখ এড়ায় না আমার ।
“কিরে... কি হয়েছে ?”
“দোস্ত...তোকে একটা কথা জানানো হয় নাই ।... তোর মোবাইল ছিনতাই হয়ে যাবার পর তো আর মোবাইল কিনলি না ।”
“কি কথা ? মোনার বিষয়ে কিছু ?”
“হ্যাঁ । আসলে দোস্ত...মানে ...”
আমার আর বুঝতে বাকি থাকে না বাকি ঘটনা । আস্তে করে বসে পড়ি আমি ওর বিছানায় ।
“যা বলি...ঠিক ঠাক উত্তর দিবি । কোনোরকম ভণিতার দরকার নাই ।... মোনার বিয়ে হয়ে গেছে ?”
“হ্যাঁ । আসলে...”
“একদম চুপ । কবে হয়েছে বিয়ে ?”
“সপ্তাহ দেড়েক আগে । দোস্ত বিশ্বাস কর...”
“একদম চুপ । সিগারেট আছে তোর কাছে ?”
“হু । কোনটা খাবি ? বেনসন নাকি গোল্ড লিফ ?”
“যেটা সবচেয়ে সস্তা সেইটা দে...”
আমি রাসেলের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে সেটা ধরিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম । মনে হচ্ছে যেন কানের পাশ দিয়ে গরম কোনো স্রোত বয়ে যাচ্ছে । ...আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে সিগারেট টানার পর উঠে দাঁড়ালাম আমি । রাসেল আমাকে থামাতে চাইলো কিছু একটা বলে । আমি ওকে থামিয়ে দিলাম ।
“রাসেল...তোকে কিছু বলা লাগবে না । আমি জানি মোনা যথেষ্ট পরিমাণে ভালো একটা মেয়ে । কিন্তু মোনার থেকেও অনেক বড় দায়িত্ব এখন আমার ঘাড়ে আছে । আমার ছোট দুইটা ভাই আছে । যার মধ্যে ছোট ভাইটা হাসপাতালে ভর্তি । ওদেরকে আমারই দেখতে হবে ।...আমার বাবা-মা আমাকে সারাটা জীবন অনেক কষ্টের মাঝেও যতটা সম্ভব ভালোভাবে বড় করে তুলেছেন । আমাকে তাঁদের দেখাশোনাও করতে হবে...” রাসেল খুব ভালো করেই জানে কথাগুলো আসলে ওকে বলছি না । আমি নিজেকেই বোঝাচ্ছি, নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি ।

রমনা পার্ক । রাসেলের হোস্টেল থেকে এসে সরাসরি এখানে চলে এসেছিলাম । বেঞ্চিতে বসে ছিলাম । কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেরও খেয়াল নেই । প্রায় বিকাল হয়ে গেছে । মোনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি । মোনার সাথে সম্পর্কটা সময়ের হিসাবে হয়তো খুব বেশী দিনের ছিল না । তবে গাঢ়তার দিক দিয়ে একটু বেশীই ছিল । তবে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা আমি চালিয়ে যাচ্ছি ।

মোনাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো হয়তো আর দেখা হবে না । এইতো...

হাসপাতালের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি ।
হাসপাতালে এসে আবার নতুন চমকের মুখোমুখি হওয়ার পালা । মা পাগলের মত কাঁদছেন । আমাকে দেখে প্রায় দৌড়ে এসে বললেন, “বাপ...তুই এতক্ষণ কই ছিলি ? শোয়েবের রক্ত লাগবে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব । তুই ব্যবস্থা কর বাপ...”
আমি কোনোমতে মা’কে শান্ত করে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে যাই হঠাৎ কি হল । ডাক্তার জানালেন গতকাল শোয়েবকে দেয়া রক্তের ব্যাগের লাইনটা একজন নার্স ভুল করে খুলে রেখেছিল । যার কারণে প্রয়োজনীয় রক্ত শরীরে ঢুকতে পারে নি । অণুচক্রিকার পরিমাণ আশংকাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে । তাই এখন জরুরী ভিত্তিতে চার ব্যাগ রক্ত যদি শোয়েবের শরীরে দেয়া না যায় তাহলে অবস্থা আরও খারাপ হবে । মনের মাঝে সেই নার্সকে কষিয়ে চড় লাগাবার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করলাম । মা’কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা কোথায় ?”
“তোর বাবা গেছে গ্রামের বাড়িতে । মনে হয় গ্রামের কিছু জমি বেচে দিবে ।...তুই একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না বাপ ।”
“তুমি শান্ত হও । বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর পরিচিত কেউ আছে কি না । আমি দেখছি ।”

আমি রাস্তায় বেরিয়ে গেলাম । কি করব বুঝতে পারছি না । ব্লাড ব্যাংকের রক্ত সেইফ না । পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের মাঝে খুঁজতে লাগলাম । অবশেষে একজনকে পেলাম যার রক্তের গ্রুপ ‘এ পজিটিভ’ । ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে । আমি ওকে নিয়ে পিজি’র ব্লাড ব্যাংকে নিয়ে যেতে যেতে খবর পেলাম বাবার পরিচিত একজন লোক এসে রক্ত দিয়ে গেছেন । আমি ছিলাম না ...তাই শাহেদই ব্লাড ক্রস ম্যাচিং সহ অন্যান্য কাজ গুলো করেছে । আমি দেরী না করে আমার বন্ধুটিকে নিয়ে গেলাম ব্লাড ব্যাংকে । সেখানেও কিছু দৌড়াদৌড়ির কাজ শেষে রক্ত নিয়ে আবার ছুটলাম শোয়েবের কেবিনে । সেখানে রক্ত দেয়া শেষে ডাক্তার জানালেন এই দুই ব্যাগ রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় প্লাটেলেট তারা সংগ্রহ করে নিচ্ছেন । কিন্তু শোয়েবের R.B.C এর পরিমাণও বেশ কম । তাই আমাকে আজ রাতের মধ্যেই যেমন করে হোক আরও দুই ব্যাগ রক্ত যোগার করতে হবেই ।
আমি প্রায় দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আমার সেই বন্ধুটিকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় জানালাম । কিন্তু আমার কাজ এখনো শেষ হয় নি । আমি দৌড়ে দৌড়ে রক্ত-দানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোতে খোঁজ নিতে গেলাম । কিন্তু আজ যেন পুরো ঢাকায় হঠাৎ করেই ‘এ পজিটিভ’ রক্ত উধাও হয়ে গেল । অনেক খুঁজে, মানুষের হাতে-পায়ে ধরেও আমি রক্ত পেলাম না ।
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে গেছে । পুরো পৃথিবীটা যেন আমার কাছে ছোট হয়ে আসতে লাগল । পিজি হাসপাতালে ‘এ’ ব্লকের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলের মত হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা আমাকে দেখে সেদিন অনেক মানুষ ফিরে তাকাচ্ছিল । কিন্তু কেউই এগিয়ে এসে বলছিলেন না... “ভাই আমার রক্তের গ্রুপ ‘এ পজিটিভ’ । আমি রক্ত দিতে চাই ।”

রাত দশটা ।
আমি আর শোয়েবের কেবিনে যাই নি । মা’র উদ্ভ্রান্ত মুখের আহাজারি শুনতে ইচ্ছে করছে না । পাথরের মত হয়ে বসে আছি ব্লাড ব্যাংকের সামনের চত্বরটাতে । কিছুক্ষণ পর দুই জন লোক আমার সামনে এসে দাঁড়াল । আমি মুখ তুলে তাকাতেই জিজ্ঞেস করল,
“আপনার নাম সাঈদ ?”
“হ্যাঁ ।”
“আপনি ‘এ পজিটিভ’ রক্ত খুঁজছিলেন ?”
“জী।”
“আমরা রক্ত দিতে এসেছি । কোথায় গিয়ে কিভাবে কি করতে হবে একটু দেখিয়ে দিবেন ?”
আমি বোকার মত চেয়ে থাকলাম মানুষ দু’টোর দিকে । বুঝতে পারছিলাম না যেন কি করতে হবে । বেশ কিছুক্ষণ পর আমার সংবিৎ ফিরে আসে ।
আমি তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম ব্লাড ব্যাংকের দিকে । একটাবারের জন্যও মাথায় আসলো না তারা আমার নাম জানে কিভাবে বা আমার যে রক্ত দরকার সেটাই বা জানে কিভাবে ।
আমি ব্লাড ব্যাংকে ঢুকে দেখি শাহেদ বসে আছে । আমাকে দেখেই ওর মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল । আমি ওকে ইশারায় বললাম, “রক্ত পাওয়া গেছে । মা কে গিয়ে বলে আয়, চিন্তা না করতে ।”
লোক দুজন রক্ত দেয়ার পর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করি তারা আমার খোঁজ পেলেন কিভাবে । তারা আমাকে জানান ফেসবুকে “রক্ত প্রয়োজন” বিজ্ঞাপন দেখে তারা এসেছেন । আমার অবাক হবার সীমা রইলো না । কারণ আমি এরকম কিছুই করি নি । কিছুক্ষণ পরে জানতে পারি ফেসবুকে রক্ত চেয়ে পোস্ট করেছে শাহেদ ! ও মা’র মোবাইল দিয়ে ফেবুতে এই কাজ করেছে । আমি হতভম্বের মত শাহেদ সহ নাম না জানা সেই দু’জন লোককে জড়িয়ে ধরলাম । এই নাম না জানা দুই জন মানুষ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপলক্ষ হয়ে উঠেছিলেন যা আমি কক্ষনো ভুলতে পারবো না । কোনোদিন না । ...শাহেদকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তুই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাই । অনেক দিন তোকে অনেক কাজে দূরে সরিয়ে রেখেছি । আমাকে মাফ করে দিস ভাই ।”

আমার জীবনের স্মরণীয় সেই রাতটির প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে রইলো পিজি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক আর সেখানের স্টাফ সহ নাম না জানা সেই দুজন রক্ত-দানকারী ।
========================================
আমি একজন কল্পক ।
আমি কল্পনায় দেখি... আমাদের আর্টের একাডেমীটা অনেক বড় করা হয়েছে... সুবিধা বঞ্চিত শিশুরাও এখান থেকে বিনা পয়সায় ছবি আঁকা শিখতে পারছে ।
আমি দেখি শোয়েব সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠেছে । আমার ঘাড়ে বসে আমার কান টেনে আবার আমাকেই ধমক দিয়ে বেড়াচ্ছে । আমার ছবি আঁকার খাতা কুচি কুচি করে ছিঁড়ছে ।
আমি দেখি...বাবার ব্যবসাটা আবার দাঁড়িয়ে গেছে । আমরা প্রতি শুক্রবারে মুরগীর মাংশ খেতে পারছি ।
আমি দেখি...শাহেদকে আবারো স্কুলে পাঠানো হচ্ছে । ও খুব দ্রুত লেখাপড়া শিখে নিচ্ছে । মা’র মোবাইলের ইন্টারনেট দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন অনেক কিছু জেনে নিচ্ছে ।

আমি কল্পক । আমাকে তো কল্পনা করতেই হবে । আমাদের আশেপাশে আমার মত আরও অনেক কল্পক রয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি । আমরা কল্পনা করি । আমরা শত বার পথভ্রষ্ট হই । কিন্তু তবুও আশা হারাই না । নিজের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে খুঁজে পাই বেঁচে থাকার আসল অর্থ ।

মোনা আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারে নি । আমি তো পারি ! আমি আমার পরিবারকে ভালো অবস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য অপেক্ষা করবো । যতদিন লাগে...লাগুক ।

একটু পরে নতুন টিউশনি খুঁজতে বের হব । আমার জন্য দোয়া করবেন ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১:৩১
৩১টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×