** পর্দার সামনের দৃশ্য- নীলা ঢাকার একটি প্রাইভেট কলেজে পড়াশোনা করে। কলেজ থেকে সবাইকে কক্সবাজার নিয়ে যাবে ট্যুর এ। চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে জনপ্রতি ৩০০০ টাকা। নীলার বন্ধুরা সবাই যাবে কিন্তু নীলা বলছে ওর বেড়াতে যেতে ভালো লাগেনা । একদমই ভালো লাগেনা ওর নিজের বাসা ছেড়ে আর কোথাও যেতে। বন্ধুরা ওকে অনেক জোরাজোরি করে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে একাই চলে গেল।
পর্দার অন্তরালের দৃশ্য– নীলার বেড়াতে যেতে ভালো লাগে। আর সমুদ্র তো নীলার অসম্ভব পছন্দ। সামনা সামনি দেখা হয়নি এখনও সমুদ্র আর বন্ধুদের সাথে একসাথে সমুদ্র দেখতে যাবে ভাবতেইতো কি আনন্দ লাগে মনে। কিন্তু সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নীলার বাবা মেয়েকে একটি ভালো কলেজে পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে পারলেও একসাথে এতগুলো টাকা দেয়া নীলার বাবার পক্ষে সম্ভব না। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নীলার বন্ধুদেরকে এড়িয়ে যাওয়া, বেড়াতে যেতে ভালো লাগেনা এ অজুহাত দেখিয়ে হাসিমুখে অভিনয় করা।
** পর্দার সামনের দৃশ্য- ইয়াসিন সাহেবের অফিসে বড় বসের মেয়ের বিয়ে। ঢাকার বাইরে বসের দেশের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান। অফিসে ৫ জন কলিগ মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া ও উপহার বাবদ সব মিলিয়ে ১০০০ টাকা। ইয়াসিন সাহেব তাঁর কলিগদের বলল ওইদিন তাঁর দেশের বাড়িতে বাড়ি বণ্টনের কাজকর্ম তাই যেতে পারবেনা সে। বাড়ির কাজ বলে তাঁর কলিগরাও আর তাকে বেশী জোরাজোরি করলনা।
পর্দার অন্তরালের দৃশ্য– - এই মধ্যবয়সে কলিগরা মিলে গাড়ি ভাড়া করে বসের মেয়ের বিয়ে খেতে যাওয়া সামাজিকতা ছাড়া আর কিছুইনা । সমাজে চলতে গেলে এ ধরনের অনেক সামাজিকতা পালন করতে হয় কিন্তু এই অল্প টাকা বেতনে ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে থাকা ও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা চালাতে চালাতে হিমশিম অবস্থা । যেখানে এই ১০০০ টাকা দিয়ে তাঁর সংসারের এক সপ্তাহের বাজার খরচ হয়ে যাবে সেখানে নিছক সামাজিকতার নামে এতোগুলো টাকা পানিতে ফেলার কোন মানেই তো নেই।
**পর্দার সামনের দৃশ্য- সাবিনার মেয়ের বয়স ৭ বছর। ঢাকার একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে পড়ে সে । মেয়ের স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের মায়েদের সাথে সাবিনার খুব ভাল সম্পর্ক । দিনের অনেকখানি সময় এই ভাবীদের সাথে কাটানো হয় সাবিনার। এবারের মাদারস ডে তে সব ভাবীরা মিলে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এ খেতে যাবে বলে ঠিক করল। ওইদিন সাবিনার বাড়িতে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসবে বলে তাদের সাথে যেতে পারবেনা এড়িয়ে গেলো সাবিনা ।
পর্দার অন্তরালের দৃশ্য– সাবিনার স্বামী মোটামোটি ধরনের একটি চাকরি করে। বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ, মেয়ের স্কুলের খরচ, মেয়ের ছোট খাটো আবদার সব মিলিয়ে প্রতি মাসে খরচতো আর কমনা । মেয়ে জন্মাবার পর থেকে নিজেদের সব সাদ আহ্লাদ মানে মেয়ের পড়াশোনা ও মেয়ের সব সাদ আহ্লাদ পুরন করা। এই টানাটানির সংসারে স্কুলের ভাবীরা মিলে মা দিবসে চাইনিজ খেতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য নেই সাবিনার তাই অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়া।
** পর্দার সামনের দৃশ্য- মাত্র পড়াশোনা শেষ করে ২০০০০ টাকা বেতনে একটি এক চাকরীতে ঢুকেছে সজীব। চাকরী হয়েছে এই খুশীতে পাড়ার ছোট ভাই বন্ধুরা পার্টি চায়। সজীব, আজ দেব কাল দেব বলে এড়িয়ে যাচ্ছে । এভাবে হাসিমুখে ওদের এড়িয়ে চলতে চলতে ওরাও একদিন ভুলে যায় পার্টির কথা।
পর্দার অন্তরালের দৃশ্য– সজীবের বাবা মা গ্রামে থাকে। সেখানে ছোট খাটো একটা দোকান আছে তাঁর বাবার। মা গৃহিণী। একমাত্র ছোট বোন ক্লাস টেন এ পড়ে। বাবা অনেক কষ্টে সজীবকে ঢাকায় পড়াশোনা করিয়েছে। বাবা বৃদ্ধ হয়েছে, বেশীক্ষণ দোকানে বসতে পারেনা। ছোট বোনটার একমাত্র আবদারের জায়গা বড় ভাইয়া। আর চাকরী পেয়েছে দেখে বাবা মা আর বোনের এতদিনের জমানো অনেক আবদার এখন পুরন করতে হচ্ছে। বেতন পেয়ে নিজের খরচের জন্য অল্প কিছু টাকা রেখে বাকি সব টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় সজীব। পাড়ার ছোট ভাই ও বন্ধুদের কাছে থেকে বিপদে আপদে অনেক সাপোর্ট পেয়েছে সবসময়। চাকরী পাওয়ার পর একটা ছোট খাটো পার্টি ডিজারভ করে তারা । সজীবও চায় ওদের একদিন খাওয়াতে কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের এমন অনেক কিছু মন চাইলেও হাসিমুখে এড়িয়ে যেতে হয়। তাতে বন্ধু আর ছোট ভাইরা স্বার্থপর বা আরও অনেক কিছু বললেও কিছু করার থাকেনা ।
উপরের যে কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দিলাম সে ঘটনা গুলো আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের এক একটি পরিবার আর এক একটি মানুষের জীবনের ঘটনা। এমন অনেক ছোট বড় টুকরো টুকরো ঘটনা ঘটছে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের ঘরে ঘরে প্রতিনিয়ত।
“ মধ্যবিত্ত” এ সমাজের বুকে কঠিন বাস্তবতার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাওয়া আর অভিনয় করে যাওয়া কিছু মানুষ যারা একটি সুশীল সমাজে বসবাস করার কারনে নিম্নবিত্তের মত শুধুমাত্র তিন বেলা পেট ভরে খেয়েও থাকতে পারেনা আবার সমাজের অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, বিভিন্ন সামাজিকতা পালন করতে গিয়ে হিমশিম খায়।
এ সকল মধ্যবিত্ত সমাজের ভদ্র আর সুশীল মানুষগুলোর অবস্থাটা এমন যেন, ঘুমানোর সময় গায়ে দেয়ার যে চাঁদরটা তা দিয়ে পা ঢাকতে গেলে মাথা খোলা রাখতে হয় আর মাথা ঢাকতে গেলে পা খোলা রাখতে হয়। এভাবে সারারাত কখনো মাথা আর কখনো পা ঢেকে কোনরকম ভাবে যেমন রাত্রিযাপন করতে হয় তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষগুলোকেও জীবনের নানা ক্ষেত্রে না নিম্নবিত্তদের মত জীবন যাপন করতে পারা আর না উচ্চবিত্তদের মত এমন এক দোটানায় হিমশিম খেতে খেতে আর অভিনয় করতে করতে পার করতে হয় জীবন ।
উচ্চবিত্তদের তো কোন চিন্তাই নেই আর নিম্নবিত্তদেরও ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে পড়াশোনা করানো, বিভিন্ন সামাজিকতা পালন এই ধরনের চিন্তা নেই শুধু একটু পেট ভরে খাওয়া, গায়ে একটি জামা আর মাথা গোজার একটু ঠাই হলেই তাদের শান্তি। কিন্তু মধ্যবিত্ত ? তারা না পারে হতে উচ্চবিত্ত আর না নিম্নবিত্ত ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৩